কলকাতায় সময় ফুরোতে থাকে দ্রুত, খুব দ্রুত। ইচ্ছে করে আঁচলের খুঁটে বেঁধে রাখি দুরন্ত সময়টিকে, পারি না। সময় কর্পুরের মত হাওয়ায় উড়ে যায়। দেশে ফিরে যাওয়ার আগে আগে কলকাতায় সময় সত্যিই দ্রুত ফুরোয়। কলকাতাকে ছেড়ে যেতে ইচ্ছে করে না, কিন্তু যেতে হয়।
ঢাকায় ফেরার পর দেখি তাণ্ডব শুরু হয়েছে সারা দেশে। স্টেটসম্যান পত্রিকায় দেওয়া সাক্ষাৎকারটি ছাপা হয়েছে বাংলাদেশের পত্রিকায়। আমি কোরান সংশোধন করতে চাই, এ খবরটি ফলাও করে প্রচার করে মৌলবাদীরা এক ভয়ংকর আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়েছে। এ হচ্ছে কি! আমি তো কোরান সংশোধনের কথা বলিনি। আমার কথা কে শোনে! ভেবেছিলাম লজ্জা বাজেয়াপ্ত হওয়ার পর মৌলবাদীদের পালে যে হাওয়া লেগেছিল, ফতোয়া জারির পর সরকারের নিষিক্রয়তা যেমন উসকে দিয়েছিল আগুন, সে হাওয়ার জোর, সে আগুনের তাপ ধীরে ধীরে কমে যাচ্ছে। কমেওছিল কিছু। পুলিশ পাহারাও অনেকটা আছে আছে নেই নেই রকম ছিল। কিন্তু হঠাৎ করে হাওয়া ক্ষিপ্ত, তপ্ত, নতুন করে দ্বিগুণ তেজে ত্রিগুণ বেগে ধাবিত হচ্ছে! আমার কত বড় স্পর্ধা যে আমি পবিত্র কোরান শরীফে কাঁটাছেড়া করতে চাইছি, স্বয়ং আল্লাহর বাণী সংশোধন করতে চাইছি! এর মানে এই যে আমি মনে করছি আল্লাহ সঠিক কথা বলেননি, আল্লাহ ভুল বলেছেন, আমি সর্বশক্তিমান আল্লাহর চেয়ে বেশি জ্ঞান রাখি, আমি আল্লাহর চেয়ে নিজেকে বেশি ক্ষমতাবান মনে করছি। মৌলবাদীদের কাছে এর চেয়ে বড় অস্ত্র আর কী থাকতে পারে! দেশী বিদেশি সাংবাদিকদের ভিড়, প্রশ্নের পর প্রশ্ন, আদৌ কি আমি বলেছিলাম কোরান সংশোধনের কথা? আমি কি পাগল হয়েছি যে কোরান সংশোধন করতে চাইব! ধরুন সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় একটি বই লিখেছেন। সেটির আমি সমালোচনা করতে পারি, কিন্তু সেটি আমি সংশোধন করতে পারি না। আমার বইয়ের কথাই বলছি, আমার বই সংশোধন করার অধিকার একমাত্র আমার আছে, অন্য কারওরই নেই। আমার মৃত্যু হলেও আমার বই যে সব ভুল ষনুটি নিয়ে আছে, সেভাবেই থাকবে। এরকমই তো নিয়ম। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ভেঙে মোর ঘরের চাবি নিয়ে যাবি কে আমারে লিখেছিলেন, আমরা কেউ কি চাইব ভেঙে মোর ঘরের চাবির বদলে ভেঙে মোর ঘরের তালা করে দিতে? না। চাইব না। প্রশ্নই ওঠে না। কোরানে তো লেখাই আছে যে এর কোনও শব্দও পরিবর্তন করা যাবে না। কোরান একটি বহুল পঠিত গ্রন্থ, আমি কোন ছার যে এটি সংশোধনের দাবি করব! এ ব্রহ্মাণ্ডের কেউ এ দাবি করতে পারে না।
আমি আর যে সব বইয়ের উদাহরণ দিলাম, তা মানুষের লেখা, কিন্তু কোরান তো আল্লাহ তায়লার লেখা। আমি তুলনা করি কি করে কোরানের সঙ্গে মানুষের লেখা বইয়ের? তুলনা করি এই জন্য যে কোরানও মানুষেরই লেখা। ক্ষমতালোভী, স্বার্থা−ন্বষী, নারীবিদ্বেষী,নিষ্ঠুর নির্দয় পুরুষের লেখা। এ মানুষের নির্বুদ্ধিতা যে মানুষ বিশ্বাস করে আল্লাহ জিবরাইলকে পাঠিয়েছেন মুহম্মদের কাছে তাঁর কথাগুলো পৌঁছে দিতে। মুহম্মদ জিবরাইলকে দেখতে পেতেন না, কিন্তু আওয়াজ শুনতেন জিবরাইলের গমগমে কণ্ঠস্বরের। তিনি যা শুনতেন, তা লিখে নিতেন। নিজে তো লিখতে পড়তে জানতেন না, অন্যকে লিখতে বলতেন। সে যুগে, আজ থেকে চৌদ্দশ বছর আগে অন্ধতা, অজ্ঞানতা, মূর্খতা চারদিক ছেয়ে ছিল, তখন অলৌকিক শক্তিতে বিশ্বাস করত লোকে, এ কোনও অবাক করা ব্যাপার নয়। কিন্তু এই বিংশ শতাব্দির শেষ প্রান্তে দাঁড়িয়ে, এই বিজ্ঞানের যুগে, যখন মানুষের জ্ঞান বুদ্ধি যুক্তি চিন্তা অনেক অগ্রসর, মানুষ কী করে বিশ্বাস করে এসব রূপকথা?
তবে কিসের সংশোধনের দাবি করছেন? শরিয়া নামের বর্বর আইনকে বিদেয় করার দাবি করছি। এই আইনের সংশোধন এ যাবৎ অনেক হয়েছে, কোনও সংশোধনই নারী পুরুষের বৈষম্য দূর করেনি। নারী পুরুষের সমান অধিকার প্রতিষ্ঠা করা শরিয়া আইনের মূল লক্ষ্য নয়, বরং এর উল্টো। কোনও সংশোধনই মূল লক্ষ্যের পরিবর্তন ঘটাবে না। যদি আমরা রাষ্ট্রের সংবিধানটি অক্ষত রাখি, যে সংবিধান বলে যে সব মানুষের অধিকার সমান, তবে আইনটি রক্ষা করার কোনও যুক্তি নেই।
সব পত্রিকায় আমার বিবৃতি ছাপা হয়েছে যে আমি কোরান সংশোধনের কথা বলিনি তারপরও তাণ্ডব থামার কোনও লক্ষণ নেই। মৌলবাদীরা আর্তনাদ করছে, ইসলাম ভেসে গেল, কোরান ধ্বংস হয়ে গেল। কে ভাসাচ্ছে, কে ধ্বংস করছে? তসলিমা। সুতরাং জ্বালাও পোড়াও, ফাঁসি চাও, আন্দোলনে নামো। মুসলমান তোমরা যে যেখানে আছো বেরিয়ে পড়ো, বজ্রকণ্ঠে স্লোগান দাও, তসলিমার ফাঁসি চাই। তসলিমার মৃত্যু চাই। হ্যাঁ, আমার মৃত্যু চাওয়ার লোকের সংখ্যা বাড়ছে। মিছিলে লোক আগের চেয়ে অনেক বেশি। সময় গেলে বেশির ভাগ আন্দোলনের তেজ এ দেশে কমে আসে জানতাম। কিন্তু যত সময় যাচ্ছে, তত বাড়ছে তেজ। চারদিকে কেবল একটিই হুংকার, তসলিমাকে হত্যা কর, ইসলাম বাঁচাও। রাজনৈতিক অরাজনৈতিক যত ইসলামী সংস্থা সংগঠন আছে দেশে, সবখানেই ফুঁসে ওঠা লোকের ভিড়, জোট বাঁধো, পথে নামো, ইসলাম বাঁচাও। প্রতিদিন আমার ফাঁসি চেয়ে জঙ্গী মিছিল বেরোচ্ছে। প্রতিদিন। লিফলেট বিলি হচ্ছে, হাজার হাজার লিফলেট —
২. তাণ্ডব – ০২
সম্মানিত দেশবাসী!
আসসালামু আলায়কুম,
কেন তসলিমার বিরুদ্ধে আন্দোলন? তসলিমার এজেন্ট এবং ইসলাম বিদ্বেষী শক্তি জনগণকে বিভ্রান্ত করার জন্যে এ প্রশ্ন তুলছে। এদেশের সর্বস্তরের জনগণ তার মৃত্যুদণ্ড দাবী করেছে। স্মরণাতীতকালের সর্বত্মক হরতাল পালিত হয়েছে এ দাবীতে। তার বিরুদ্ধে আদালতে মামলা রয়েছে। বিশ্ব ইহুদি-খ্রিস্টান চক্রের আশ্রয়ে দীর্ঘদিন বিদেশে থেকে সে ইসলামের বিরুদ্ধে তৎপরতা চালিয়েছে। সম্প্রতি আবার ফিরে আসায় স্বাভাবিকভাবেই দেশপ্রেমিক ইসলামী জনগণের মধ্যে ক্ষোভের সঞ্চার হয়। এবারে দেশী-বিদেশী ইসলাম বিরোধী চক্রটি তাকে কেন্দ্র করে মাথা চারা দিয়ে উঠবার চেষ্টা করছে। প্রধানমন্ত্রীর সাম্প্রতিক এক বক্তব্য তাদের ইসলাম ও দেশ বিরোধী কর্মকাণ্ডের বৈধতা ও উৎসাহ যুগিয়েছে। প্রধানমন্ত্রীর ভাষায়, তসলিমার বিরোধিতাকারীরা বাড়াবাড়ি করছে। অথচ তসলিমা আল্লাহ রাসুল ও কুরআনের বিরুদ্ধে বিষোদগার করছে, বাংলাদেশের মানচিত্রকে অন্য দেশের সাথে মিশিয়ে না দিয়ে স্বস্তি পাচ্ছে না। সে অবাধ যৌন সংসর্গের প্রকাশ্য ইন্ধন যোগাচ্ছে, বিয়ের শৃঙ্খল ভাঙবার জন্যে নারীদের আহবান জানাচ্ছে আর অকথ্য, অশ্লীল ভাষায় গালাগাল করেছে আলেম উলামা পীর মাশায়েখ ও মসজিদের ইমামকে। মসজিদকে বলছে বৈষম্যের প্রতীক। শেখ হাসিনা কেন মাথায় ঘোমটা দেয় এজন্যে যার আত্মহত্যা করার ইচ্ছে হয় —- এই দেশদ্রোহী ও ধর্মদ্রোহীর জন্যে একটি চিহ্নিত মহলের উকালতি নিঃসন্দেহে উদ্দেশ্যমূলক। একটা ভদ্র সমাজের মানুষ, স্বাধীন দেশের গর্বিত নাগরিক কি তা মেনে নিতে পারে? ধর্মীয় বিশ্বাস এবং মূল্যবোধকে নিয়ে কটাক্ষ ও উপহাস করার অধিকার তাকে কে দিল?