স্টেটসম্যানে আমার সাক্ষাৎকারটি যেদিন ছাপা হল, সেদিন সকালেই নিখিল সরকার আমার হোটেলে ফোন করলেন। বেশ রুষ্ট হয়ে জিজ্ঞেস করলেন, তুমি কি স্টেটসম্যানের সাংবাদিককে বলেছো যে তুমি কোরান সংশোধন করতে চাও?
— না তো!
–লিখেছে তো!
–কি বলছেন এসব! কোরান সংশোধন? কোরান আবার সংশোধন করা যায় নাকি? এরকম উদ্ভট কথা আমার মাথায় কোনওদিন আসেনি। বলার প্রশ্ন ওঠে না। আমি কোরান বিশ্বাস করি না, আমি কেন এর সংশোধন চাইব! কোরান বিশ্বাস করলে তো কোরান সংশোধনের প্রশ্ন আসে।
–বলনি, তাহলে লিখল কেন? নিশ্চয়ই এধরনের কিছু বলেছো!
–শরিয়া আইনের কথা বলেছিলাম। না এর সংশোধন চাইনি। কারণ সংশোধনে কাজের কাজ সত্যিকার হয় না। বলেছিলাম শরিয়া আইন পাল্টাতে চাই। মানে একে বিদেয় করতে চাই। এই আইনের বদলে নারী পুরুষে সমান অধিকার আছে এমন আইনের কথা বলেছিলাম।
–কী বলতে যে কী বল!
–কী বলতে কী নয়। আমি যা বলেছি, স্পষ্ট করে বলেছি। এটা কোনও নতুন কথা নয়। এ কথা আমি দীর্ঘদিন থেকে বলে আসছি। লিখে আসছি। আমি নিশ্চিত, যে মেয়েটি সাক্ষাৎকার নিতে এসেছিল, সে জানেনা কোরান আর শরিয়ার মধ্যে পার্থক্য। শরিয়া বলতে সে কোরান বুঝেছে।
–যাই হোক, দেরি কোরো না। এক্ষুনি একটা সংশোধনী পাঠিয়ে দাও।
–এরকম কত ভুল লেখে পত্রিকায়, তার জন্য সংশোধনী তো কোনওদিন পাঠাইনি!
–এ যে সে ভুল নয়। এই মন্তব্য নিয়ে বিপদ হতে পারে।
দেরি না করে নিখিল সরকারের আপিসে গিয়ে স্টেটসম্যান সম্পাদকের কাছে চিঠি লিখে দিই যে আমি কোরান সংশোধনের কথা বলিনি, এ কথা বলার প্রশ্নও ওঠে না কারণ আমি ধর্মে বিশ্বাস করি না। সব ধর্মগ্রন্থই আমি মনে করি এ যুগের জন্য অচল। সব রকম ধর্মীয় আইন সরিয়ে, যেহেতু ধর্মীয় আইনে নারী তার অধিকার থেকে বঞ্চিত হয়, নারী পুরুষের মধ্যে বৈষম্যহীন একটি আইন ব্যবস্থার দাবি আমি দীর্ঘ দিন থেকে করছি। ধর্মই যদি না মানি, তবে কোরান সংশোধনের বিষয়টি সম্পূর্ণই অপ্রাসঙ্গিক। — এটি লিখে আমার স্বস্তি হয়। স্টেটসম্যানের লেখাটি পড়ার পর সত্যি আমার মন খারাপ হয়ে গিয়েছিল, একটি ভুল বাক্য আমাকে কী রকম আস্তিক বানিয়ে ছাড়ল। ধর্মে বিশ্বাস করলেই তো প্রশ্ন আসে ধর্মগ্রন্থ সংশোধনের। একটু পাল্টে পুল্টে একে মেনে চল, একে মাথায় তুলে রাখো। ছিঃ, আমি কি তাই বিশ্বাস করি নাকি! এতকাল ধরে তবে কিসের সংগ্রাম করছি আমি! আমি কি ক্রমাগতই বলে চলছি না যে পুরুষতন্ত্র আর ধর্মের শেকল ছিঁড়ে বেরিয়ে আসা না পর্যন্ত মেয়েদের সত্যিকার মুক্তি নেই!
আবৃত্তিলোক থেকে একটি অনুষ্ঠান করা হল, সম্বর্ধনা অনুষ্ঠান বলা যায় একে। কবিতা পাঠ হবে। কে কবিতা পড়বে? আমি। আর কেউ? না, আর কেউ নয়, একা আমি। এর কোনও মানে হয়! ওঁরা বললেন, মানে হয়। শক্তি চট্টোপাধ্যায় বসলেন আমার বামে, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় ডানে। আপনারাও পড়ুন কবিতা, আমি কাতর অনুরোধ করি। না, আজ আমরা তোমার কবিতা শুনব। শক্তি বলেন। আমি সংকোচে মরি। বাংলা সাহিত্যের দুজন শ্রেষ্ঠ কবির মাঝখানে বসে কবিতা পড়তে যে মনের শক্তি লাগে, সেটি আমার নেই। নেই, তবু বসতে হয় কবিতা পড়তে। মুখে পড়ছি কবিতা আর মনে মনে বলছি ধরণী দ্বিধা হও। ধরণী দ্বিধা হয়নি। আমাকে বোধহয় আকাশে ছুঁড়ে না দিয়ে ধরণীর শান্তি নেই। কবিতা পাঠের পর খাওয়া দাওয়া, খাওয়া দাওয়ার আগে অবশ্য চিরাচরিত মদ্যপান। সন্ধের পর এই মদ্যপানটি কলকাতার উμচজ্ঞবত্ত আর মধ্যবিত্তের অনেকটা নিয়মিত ব্যাপার। ঘরে ঘরে মদ নিয়ে বসে যাচ্ছেন স্বামী, এমনকী স্ত্রীও। অতিথি এলে তো কথাই নেই, আর কিছু না চলুক, মদ চলবেই। সন্ধের অতিথিকে ঢাকার শিল্পাঙ্গনের মধ্যবিত্তরা সম্ভবত এখনও চা দিয়েই আপ্যায়ন করেন। শক্তি চট্টোপাধ্যায় সামান্য মদ্যপান করেই, লক্ষ্য করি, আমার পেছন পেছন হাঁটছেন আর বলছেন, তসলিমা তোমাকে আমি এত ভালবাসি কেন, বল তো! এই সেরেছে। এই তুচ্ছ মানুষটিকে এত আদর যত্ন করা হচ্ছে, এমনকী আকাশে তোলা হচ্ছে, তারপর কবি শক্তি চট্টোপাধ্যায় যদি এখন এই ভরা আসরে এমন হুট করে আমার প্রেমে পড়ে যান, তবে এত আমি সামলাবো কি করে! কান দুটো ঝাঁ ঝাঁ করতে লাগল। লজ্জায় আমি কোথায় মুখ লুকোবো তার জায়গা খুঁজে পাচ্ছি না। আমি শক্তিদা কিছু খাবেন, আমি আপনার জন্য খাবার নিয়ে আসি, বলে তাঁর পাশ থেকে দ্রুত সরে যাই, যেন এর মধ্যে তিনি তাঁর প্রেমকে আপাতত স্থগিত রাখার প্রয়াস পান। তাঁর জন্য খাবার আনতে যাই, যেন মুখে খাবার পুরতেই তিনি ব্যস্ত থাকেন, যেন প্রেমের বাক্য আওড়ানোর কোনও সময় তাঁর না জোটে। কিন্তু পেছন পেছন আবার তিনি, ফিসফিস করে বলছেন, তোমাকে কেন এত ভালবাসি আমি! খাবারের থালাটি তাঁর হাতে দিই, তিনি বাধ্য শিশুর মত বসে খেতে শুরু করলেন। লক্ষ করি ঠিকমত তিনি খেতে পাচ্ছেন না, খাবারগুলো মুখে তুলতে গেলে ছড়িয়ে পড়ছে এদিক ওদিক। মীণাক্ষী চট্টোপাধ্যায়, শক্তির স্ত্রী ছিলেন খানিকটা দূরে। তাঁর কাছেই দৌড়ে যাই, বৌদি, শিগগিরি আসুন, শক্তিদা কেমন যেন করছেন। খেতে পাচ্ছেন না।
ও কিছু না! বলে মীণাক্ষী যার সঙ্গে মন দিয়ে গল্প করছিলেন, করতে লাগলেন। শক্তির কেমন করাকে তিনি মোটে পাত্তাই দিলেন না। আমি এদিকে মহা মুশকিলে পড়েছি। একা আমি শক্তির প্রেম সামাল দিতে পারছি না। তিনি তো খাওয়া দাওয়া ফেলে আবার আমাকে বলতে শুরু করেছেন যে তিনি আমাকে খুব ভালবাসেন। কেন আমাকে তিনি এত ভালবাসেন, তা বারবারই আমাকে জিজ্ঞেস করছেন। আমি কি করে জানব তা! আমার কাছে তো উত্তর নেই। এ এমনই এক অস্বস্তিকর ব্যাপার যে আমি না পারছি বসে বসে শুনতে তাঁর প্রেমের প্রলাপ, না পারছি কাউকে বলতে। এমন বোকা কি যেখানে সেখানে মেলে! বুঝতে আমার দুদিন লেগেছে যে শক্তি চট্টোপাধ্যায় সত্যি সত্যিই আমার প্রেমে পড়েননি। পেটে মদ পড়লে তিনি একটু উল্টো পাল্টা বকেন, এই যা।