–কবে তুমি প্যারিসে আসবে জিল?
— জুলাইয়ের শেষ দিকে। তখন একটি বাড়ি ভাড়া নেব প্যারিসে।
— বাড়ি ভাড়া কেন? নাতালির বাড়িতেই তো থাকতে পারবে।
–আরে না। তোমাকে তো বলেছি যে নাতালির সঙ্গে আমার সম্পর্ক শেষ হয়ে যাচ্ছে।
–যাহ আমার বিশ্বাস হয় না। কেন শেষ হবে সম্পর্ক! খুব চমৎকার মেয়ে নাতালি।
–কেন তোমার বিশ্বাস হয় না? আমি কি মিথ্যে বলছি? নাতালিকে আমি ভালবাসি না।
জিল আজ আমার ঘরে ঢুকতেই বলেছিলাম, জিল কাল নাতালিকে আমি বলেছি জিলের সঙ্গে আমার একটি ব্যাপারে মিল আছে। জিল এক নাতালির সঙ্গে থাকছে, আমি থাকছি আরেক নাতালির সঙ্গে। জিল লাজুক হেসেছে। ্উদাস তাকিয়ে থাকি জানালায়। জিল বলে, তুমি যদি জুলাইয়ের আগে জার্মানিতে আসো, তবে জার্মানি থেকে সোজা চলে যাবে মঁপেলিয়েতে। ওখানে আমার বাড়িতে থাকবে। সামনে সমুদ্র। তোমার খুব ভাল লাগবে। দুজন আমরা স্পেনে বেড়াতে যাবো। স্পেন খুব সুন্দর দেশ।
মঁপেলিয়ে। মঁপেলিয়ে। জিল মঁপেলিয়ের স্বপ্নে বিভোর।
আর তা যদি না হয়!
আর যদি না হয়, তবে কী?
তুমি তো সেপ্টেম্বরে আসছোই। ক্রিশ্চান বেস তোমাকে তো নিয়ে আসছেন তোমার বইয়ের প্রকাশনা উৎসবে। তখন তো আমাকে চিনবেই না। বলবে জিল, কোন জিল? জিল নামে কাউকে তো চিনি না।
জিলের পেটে কনুইয়ের গুঁতো পড়ে, বাজে বোকো না তো!
—বাজে বকছি না। যা সত্যি তাই বলছি। আমি দিব্য চোখে দেখতে পাচ্ছি তোমাকে ঘিরে থাকবে সাংবাদিকরা, প্রকাশকরা। এডিশন স্টক ফ্রান্সের খুব বড় প্রকাশনী। তাছাড়া ক্রিশ্চান বেসের তো টাকার অভাব নেই। ওকে বোলো তোমাকে যেন ক্রিয়োঁতে রাখে। বলবে ক্রিয়োঁ ছাড়া আমি থাকব না। তখন ক্রিশ্চান কিছুতেই না বলতে পারবে না। তাছাড়া তার লোক দেখানোও হবে, বলবে দেখ দেখ আমার লেখককে আমি ফ্রান্সের সবচেয়ে দামি হোটেলে রেখেছি। এটা তার প্রচারের কাজেও দেবে। ক্রিয়োঁতে যদি থাকো, আর জিল নামের এই বেচারাকে যদি চিনতেই পারো, তবে এরকম টি শার্ট পরে তোমার সঙ্গে দেখা করতে গেলে সোজা বলে দেবে, সুট টাই পরে এসো, তাছাড়া দেখা হবে না।
—না জিল। বড় বড় হোটেলে আমার থাকতে ইচ্ছে করে না। আমার ইচ্ছে করে খুব সাধারণ ভাবে থাকি আর ঘুরে ঘুরে জীবন দেখি মানুষের। পুরো জগতটা দেখি। মানুষের চেয়ে আকর্ষণীয় আর কী আছে। বিশাল দামি হোটেলে থেকে কি আমি মানুষের সত্যিকার জীবন দেখতে পারি!
জিল মাথা নাড়ে। ঠিক বলেছো।
বিমান বন্দরে নেমে আমার সুটকেসখানি ট্রলিতে উঠিয়ে ঠেলছিল যখন, জিলকে অপলক দেখছিলাম। জিলের জন্য আমার হৃদয়ে রিন রিন করে একটি বীণা বাজে, বেজেই চলে।
যখন বিমানের পথে যাবো, জিল দাঁড়ায় আমার মুখোমুখি। বলে, আমি তোমাকে চিঠি লিখব। তুমি অবশ্যই অবশ্যই লিখবে। মনে থাকবে তো!
বিষণ্নতার ওপাশ থেকে আমি মাথা নাড়ি। লিখব।
বিদায় বলেছি। চলে যাচ্ছি। জিল বলে, আর পাঁচমিনিট থাকো। মনে মনে বলি, কী হবে আর এই পাঁচ মিনিটে?
জিল হঠাৎ আমাকে আলতো করে জড়িয়ে দু গালে গাল ছুঁইয়ে চুমু খেলো। এ ফরাসিদের অভ্যেস। সবার সঙ্গে ফরাসিরা এই করে। এমনকী একদিনের পরিচয়েও করে। তবুও জিলের এই স্পর্শ, এই চুম্বন আমাকে অদ্ভুত এক ভাল লাগা দেয়। জিলের হাত ছুঁয়ে বলি, কষ্ট ছুঁয়ে কণ্ঠ খানিক কাঁপে, বলি, যাই।
চলমান সিঁড়ি যখন আমাকে ক্রমশ এক একাকীত্বের দিকে নিয়ে যাচ্ছিল, পেছনে ফিরে আর দেখিনি জিল দাঁড়িয়ে আছে কি নেই।
২. তাণ্ডব – ০১
ডায়রি লেখার অভ্যেস আমার মোটেও নেই। নতুন বছরের আগে আগে বেশ অনেক ডায়রি মেলে। প্রতিটি নতুন বছর আসার আগে ভাবি নিয়মিত রোজনামচা লিখব। এমন নয় যে শুরু করি না। প্রথম দিন লিখতে গিয়ে পুরো পাতা ভরে গেল, এমনকী মার্জিনেও লিখতে হল, এত কথা মনে। দ্বিতীয় দিনেও তাই। তৃতীয় দিনে মার্জিনে লেখার প্রয়োজন হল না। চতুর্থ দিনে পাতা অর্ধেক ভরল। পঞ্চম দিনে ভুলে গেছি লিখতে। ষষ্ঠ দিনের দিন বসে পঞ্চম আর ষষ্ঠ দুদিনের কথা লিখতে গিয়ে দেখা যায় কিছু খুঁজে পাচ্ছি না লেখার। অর্ধেকের চেয়ে কম ভরল পাতা। এরপর পুরো তিন দিন রোজনামচা লেখার কথা বেমালুম ভুলে বসে থাকি। হঠাৎ তিন দিন পর দুটো বাক্য লেখার পর তৃতীয় বাক্যটি অসমাপ্ত রেখে তখনকার জন্য ডায়রির চেয়ে অধিক জরুরি কোনও একটি বিষয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ি। ক্রমে ক্রমে ডায়রির খাতাটির ওপর আরও বই খাতা জমে খাতাটি অদৃশ্য হয়ে থাকে কয়েক সপ্তাহ। তার পর একদিন টেবিল ঝেড়ে মুছে গোছাতে গিয়ে ধুলোর আস্তর জমে ওঠা ডায়রিটি হাতে পড়তে এক ঝলক আলো নাচে চোখে, মনে মনে বলি জ্ঞওহ তাই তো, আমার তো কথা ছিল প্রতিদিন এতে লিখব।’ কথা তো কত কিছুই থাকে। কটি কথা আর মানা হয়! টেবিল শেষ পর্যন্ত গোছানো হয় না, ডায়রির পাতা উল্টে উল্টে লেখাগুলো পড়ি। পড়তে পড়তে ভাবি, এখন থেকে বাকি দিনগুলোর কথা লিখে রাখব, জীবনের কত কথা ভুলে যাচ্ছি দিন দিন । যেদিন মনে হল, সেদিনের কথা দু ছষেন লিখে রেখে দিই, এর পর দিন লেখা আর হয় না। ভাবি এক সময় লেখা যাবে, এ আর এমন কী! মনে তো আছেই সব কিছু। মনে থাকবে। যে সব কাণ্ড ঘটে গেল, তা কি আর ভোলার মত। কিন্তু, আমার মস্তিষ্কটি আমার সঙ্গে প্রতারণা করে খুব। যে ঘটনাটি কখনও ভোলার নয় বলে বিশ্বাস করি, সেটিই কদিন পর মনেই পড়ে না কখনও ঘটেছিল। মন এক আশ্চর্য জিনিস। কোনও এক দুপুরে একটি লাল জামা পরে জামগাছের তলে দাঁড়িয়ে জাম খাচ্ছিল!ম, সেটি স্পষ্ট মনে আছে। কিন্তু কোন বছর আমি ডাক্তারি পাশ করেছি, সেটি দিব্যি ভুলে বসে আছি, এর ওর কাছে জিজ্ঞেস করতে হয়। প্রয়োজনের কথাটি মনে থাকে না, অপ্রয়োজনীয় কথায় মন বোঝাই হয়ে থাকে। মন জিনিসটি অদ্ভুত। কী জিনিস মন নেবে, কী নেবে না, তা আমার সাধ্য নেই অনুমান করি।