নাতালিকে বলি, প্যারিসের শেষ সিগারেট আমাকে খেতে দাও।
নাতালি অভিমানে ঠোঁট ফুলিয়ে বলে, না।
নাতালিকে যত দেখি, অবাক হই। বাংলায় কবিতা লেখার ইচ্ছে তার। জিলকে বলেছিলাম নাতালি বেশ ভাল বাংলা বলে। জিল বলেছিল, তবে নিশ্চয়ই ওই নীলরতনের প্রেমে পড়েছে সে, প্রেমে পড়লেই ভাষা শেখার আগ্রহ হয়, প্রেমিকের সঙ্গে বাংলা চর্চা করছে বলেই ভাল বাংলা বলছে। অবশ্য নাতালির বেলায় তা হয়নি। ও বলেছে সেদিনই নীলরতনকে প্রথম দেখেছে। নাতালি বাংলাকে ভালবেসেই বাংলা শিখেছে, বাঙালি ছেলের প্রেমে পড়ে নয়। নীলরতনের জন্য মায়া হয়, আমাকে বড় কাঁদো কাঁদো গলায় বলেছিল, ‘দিদি আমাকে তো তাড়িয়ে দেবে এ দেশ থেকে, লেখাপড়া শেষ, পাশ করে বেরোচ্ছি আর দু মাস পর, এখন তো আর থাকার উপায় নেই। আপনি যদি চেষ্টা করেন, তাহলে আমার হয়ত থাকা হবে এখানে। কারণ দেশে যে ফিরে যাবো, দেশে গিয়ে কি করব? ওখানে তো চাকরি নেই, কিছু নেই।’ নীলকে বলেছি, কিন্তু আমি কি করে চেষ্টা করব, কোথায় কার কাছে কি বলব? নীলরতন চুপ করে ছিল। কতটা অনিশ্চয়তা আর দুর্ভাবনা থেকে আমাকে অনুরোধ করেছে সে, বুঝি! জিলকে বলেছি যদি সম্ভব হয় নীলরতনকে যেন সাহায্য করে। জানিনা জিলের পক্ষে আদৌ সম্ভব হবে কি না। হবে না হয়ত। নীলরতন কেন প্যারিসেই থেকে যেতে চায়! আমি নীলরতন হলে দেশে ফিরে যেতে চাইতাম। নিজের দেশের জন্য যা হোক কিছু ভাল করতে চাইতাম। কিন্তু আবারও ভাবি, দেশের জন্য চাইলেই কি কিছু করা সম্ভব! নীলরতন যদি বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক হওয়ার জন্য আবেদন করে, তবে কি খুব সহজে সে শিক্ষকের চাকরিটি পাবে? হিন্দু হওয়ার অপরাধে তাকে কি দুর্ভোগ পোহাতে হবে না! হবে! মুসলমান নামের মানুষেরা যে দুর্ভোগ পোহাচ্ছে না, তা নয়। আসলে ক্ষমতাসীনদের পেয়ারের লোক না হলে দুর্ভোগ পোহাতে হয়ই কোনও না কোনওভাবে। বাংলাদেশ একটি গণতান্ত্রিক দেশ, এই যে বলি এত, বলে বলে মুখে ফেনা তুলে ফেলি, আসলেই কি এটি কোনও গণতন্ত্র। ভোটের বাজারে কিছু টাকা খাটিয়েই গরিবের ভোট যদি কেনা যায়, তবে তাকে গণতন্ত্র বলি কি করে! সত্যিকার গণতন্ত্র কোনওদিন আমরা পাবো না যতদিন না দারিদ্র্য মোচন হচ্ছে, যতদিন না শিক্ষার প্রসার হচ্ছে, যতদিন না সাধারণ মানুষের মধ্যে রাজনৈতিক অর্থনৈতিক সামাজিক সচেতনতা আসছে। ততদিন পর্যন্ত কি? গণতন্ত্রের চর্চা তো চলতেই হবে নাকি কোনও একনায়ক বা একনায়িকার শাসন চাও? প্রশ্নটি ক্রিশ্চান হয়ে আমি আমাকে করি। আপাতত নিশ্চুপ থাকি আমি। গণতন্ত্র সমাজতন্ত্র পুঁজিবাদ মৌলবাদ এসবের মধ্যে মানবাধিকার বাক্ স্বাধীনতা ব্যক্তি স্বাধীনতা এক চিমটি করে করে দিতে থাকি আর ভাবতে থাকি। আমার ভাবনার সুতো হারিয়ে যায় নাতালির সুরে।
–আমি ঢাকায় যাবো আগস্টে।
–হ্যাঁ নিশ্চয়ই যাবে। আমার বাড়িতে থাকবে।
–আমার জন্য কিছু কবিতা পড়ে দেবে? আমি ক্যাসেটে তুলে রাখব।
নাতালি মহাখুশিতে আমার পড়া বাংলা কবিতাগুলো তুলে নেয়। নারীদ্রব্য কবিতাটি তার খুব ভাল লাগে বার বার বলল। এরপর আমার হাতদুটো ধরে সে বলল, আমার জন্য তো অনেক করলে, এবার একটি জিনিস করতে পারো আমার জন্য?
–নিশ্চয়ই করব। তোমার জন্য আমি সব করতে পারি। বল কি চাই?
–আমার জন্য তুমি সিগারেট ছাড়ো।
আমি হেসে উঠি। বলি, আমি তো ভাই ধরিনি সিগারেট যে সিগারেট ছাড়ব! এ আমার শখের খাওয়া।
জিল আমার ভারি সুটকেসটি নিয়ে নিচে নেমে যায়। আমিও নিচে নেমে আনমনে একটি সিগারেট ধরাই। নাতালি আমার হাত থেকে সিগারেট নিয়ে ফেলে দিয়ে বলল, সিগারেট খেলে কি হয় জানো?
শান্ত কণ্ঠে বলি, জানি। ক্যান্সার।
সোফায় গা এলিয়ে দিয়ে শুদ্ধ বাংলায় বলল, আমার বাবা আকাশে থাকে। কেন জানো?
সিগারেটের কারণে?
হ্যাঁ। কি হয়েছিল বল তো!
ব্রংকোজেনিক কারসিনোমা। সে জানি।
জানো?
হেসে বলি, হ্যাঁ।
তারপরও খাও?
আমি ম্লান হাসি।
নাতালি তার জ সুই লিব্রে লেখা ব্রোজটি তার জামা থেকে খুলে আমার শার্টে লাগিয়ে দেয়।
চিঠি লিখবে তো!
হ্যাঁ লিখব।
নাতালির চোখ ছলছল করে।
জিল বলে, নাতালি তো আছেই তোমার সঙ্গে। তুমি না হয় এয়ারপোর্টে ওর সঙ্গে চলে যাও। আমি যাবো অন্য এয়ারপোর্টে, অরলিতে।
হেই জিল, আজ শেষ দিন, আজও পালাতে চাও!
নাতালি বলল, ও আসলে নাতালির সঙ্গে সময় কাটাতে চায়।
ঠিক বলেছো।
জিল ধমকে ওঠে, পাগল হয়েছো। আমি ওর বাড়িতে যাবো না। আমি তো অরলিতে যাবো।
তিনজন আমরা ট্যাক্সিতে উঠে বসি। জিল দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলে, কাল রাতে খুব ইচ্ছে ছিল তোমার সঙ্গে কাটাই। কিন্তু তুমি তো চলে গেলে ওদের সঙ্গে।
–তুমিও যেতে পারতে।
–আমাকে নেমন্তন্ন করেনি, আমি যাবো কেন!
–তাতে কি!
–নাহ, তোমাদের ব্যবসায়িক কথাবার্তায় আমাকে মানাতো না।
— মোটেও ব্যবসায়িক কথাবার্তা ছিল না। ছিল নারীবাদী আলোচনা।
অনেকটা পথ গিয়ে নাতালি বলল, বিমান বন্দরে গিয়ে কী লাভ। আমার খুব খারাপ লাগে প্রিয়জনদের চলে যাওয়া দেখতে। আমাকে বরং এখানে নামিয়ে দাও। আমি সরবনে যাবো, দুদিন ক্লাস করি না।
নাতালি নেমে গেলে আমরা ট্যাক্সি ছেড়ে দিয়ে বিমানবন্দরে যাওয়ার বাসে উঠে পড়ি। প্যারিসে মেট্রো চড়া হল, বাস চড়া হবে না কেন! তাই বাস চড়ার আবদার আমার। বাসটি সোজা বিমানবন্দর যাবে। বাসে দুজন পাশাপাশি বসি। জিল বলে, তুমি যখন বন্ধুবেষ্টিত থাকো, আমার তখন তোমার সঙ্গে থাকতে ভাল লাগে না। তুমি যখন একা থাকো, তখন আমার ভাল লাগে, দুজন বসে গল্প করতেই তো ভাল।