ক্রিশ্চান বললেন, কাল তোমার আর্তে অনুষ্ঠান দেখলাম। কে ছিল তোমার অনুবাদক?
— না। ওরাই যোগাড় করে নিয়েছিল। তবে শুনেছি যে মেয়েটি অনুবাদ করেছে, ওর বাবা ফরাসি, আর মা বাঙালি। খুব ভাল বাংলা যে বলতে পারে তা নয়। শক্ত শক্ত শব্দ বুঝতে পারে বলে মনে হয়নি।
ক্রিশ্চান বলল, তোমার আসলে ইংরেজিতে বলা উচিত।
আমার ইংরেজির যে হাল! কোনওরকম কাজ চালাই। এ দিয়ে কোনও সাক্ষাৎকার চলে না। ওরাই বলে আমাকে বাংলায় বলতে।
–কী বল তোমার ইংরেজির হাল খারাপ। সেদিন দুপুরে নোভেল অবজারভেটরের জ্যঁ দানিয়েলের সঙ্গে বেশ গুছিয়ে তো বললে। তোমার লেখালেখি, তোমার সংগ্রাম। সময় পেলে তুমি বেশ সুন্দর বলতে পারো। এখন থেকে সিদ্ধান্ত নাও তুমি ইংরেজিতে দেবে যে কোনও সাক্ষাৎকার।
–দেখ, আমাদের দেশে ইংরেজি চর্চা একেবারেই নেই। মুখে বলতে গেলে দেখি অভ্যেস না থাকায় শব্দ খুঁজতে হয়।
–তোমার বক্তব্য যেন সব জায়গায়, যেখানেই কথা বলছ, স্পষ্ট হয়, সে কারণেই বলছি। কারণ অনুবাদক, ধরো হঠাৎ করে একজন অনুবাদক পেলে, তোমার চিন্তাচেতনাবিশ্বাস সম্পর্কে যার কোনও স্পষ্ট ধারণা নেই, সে তোমাকে, তুমি যাই বল, ভাল বুঝতে পারবে না। অনুবাদও করতে পারবে না।
ক্রিশ্চান গম্ভীর হয়ে জ্ঞান দিয়ে যাচ্ছেন আমাকে। তাঁর ব্যবসাবুদ্ধি যেমন ভাল, তাঁর সহমর্মিতাও দেখার মত। সুটকেস গোছাতে গোছাতেই কথা বলছিলাম ক্রিশ্চানের সঙ্গে।
হঠাৎ পার্কার কলমটি খুঁজে পাচ্ছি না। ক্রিশ্চান ঢুকে গেল তাঁর ওই মিনিস্কার্ট পরা শরীর নিয়ে খাটের তলে, নাতালি আতি পাতি করে খুঁজছে, আর চুক চুক করে দুঃখ করছে, ক্রিশ্চান খুঁজছে আর বলছে, কি রকম রং বল, আমি দৌড়ে দোকানে গিয়ে এক্ষুনি কিনে নিয়ে আসছি। খোঁজ খোঁজ খোঁজ। শেষ অবদি পাওয়া গেল কলম যে শার্টটি পরা ছিলাম, তার পকেটে।
আবারও টেলিভিশনের অনুষ্ঠানের কথা ওঠালেন ক্রিশ্চান। বললেন, তোমার বিশ্বাস আর আদর্শ সম্পর্কে আমি জানি। কিন্তু আর্তের অনুষ্ঠানে তোমার বক্তব্য খুব বলিষ্ঠ মনে হয়নি। আরেকটি কথা, তুমি যখন মৌলবাদিদের বাকস্বাধীনতা বন্ধ করার জন্য প্রস্তাব কর, এর পেছনে তুমি কোনও ভাল যুক্তি দেখাতে পারো না। আমি বললাম, কেন, আমি তো বলেইছি যে মৌলবাদীরা সমাজকে পেছন দিকে টানছে। নারী পুরুষের সমান অধিকার মানে না তারা। মেয়েদের বিরুদ্ধে ফতোয়া দিচ্ছে, ওদের পুড়িয়ে মারছে, পাথর ছুঁড়ে মারছে। মুক্ত বুদ্ধির যে কোনও মানুষের ওপর হুমকি আসছে। ধনী আরব দেশগুলো থেকে টাকা আসে তাদের কাছে, হাতে তাদের অস্ত্র। মাদ্রাসা গড়ে উঠছে প্রচুর, আর মাদ্রাসা থেকে প্রতিবছর বেরোচ্ছে অগুনতি মৌলবাদী। এরা দেশের সর্বনাশ ছাড়া আর কিছুই করছে না। একসময় আমাদের দেশে তো ছিলই ধর্মভিত্তিক রাজনীতি নিষিদ্ধ। সেরকম তো আবার হতে পারে!
ক্রিশ্চান, মনে হয়নি, আমার যুক্তিতে তুষ্ট। কাটিয়ে নিয়ে বললেন, অনুবাদক যেভাবে বলেছে, তাতে যুক্তিটি বলিষ্ঠ হয়নি।
আমি বুঝি যে ক্রিশ্চান গণতন্ত্রের কথা ভাবছে। একটি গণতান্ত্রিক দেশে সকলের অধিকার থাকা উচিত রাজনীতি করার। এটা নিষিদ্ধ ওটা নিষিদ্ধ এসব শুনলে ইউরোপের মানুষ পুরোনো সোভিয়েত ইউনিয়নের চিত্র কল্পনা করে শিউরে ওঠে। সোভিয়েতের ভয় সোভিয়েত ভেঙে যাওয়ার পরও যায়নি। কিন্তু মৌলবাদীরা যদি গণতন্ত্র ব্যবহার করে ক্ষমতায় এসে যায় কোনও দিন, তবে তো প্রথম যে কাজটি করবে তা হল কবর দেবে গণতন্ত্রের, কবর হয়ে যাবে মুক্তচিন্তার, বাক্ স্বাধীনতার। নির্বাচনে জেতা খুব কি কঠিন হবে ওদের জন্য! ধর্মকে ব্যবহার করছে যাচ্ছেত!ই ভাবে। অশিক্ষিত অজ্ঞ মূর্খ মানুষগুলো আল্লাহ খোদার মান রক্ষা করতে গিয়ে এদের দলে যোগ দিলে আশ্চর্য হওয়ার কিছু নেই। ক্ষমতায় না এসেই সরকারের আশকারা পেয়ে মৌলবাদ বিরোধী নেতাদের গলা কাটতে দ্বিধা করছে না। এরকম তো নয় যে তারা কোনও আলোচনায় যেতে চায়। আমি কলম ব্যবহার করেছি আমার মৌলবাদ বিরোধী লড়াইয়ে, মৌলবাদীরা কি আমার যুক্তি কলম ব্যবহার করে খণ্ডাতে চায়? না, তা চায় না। তারা তলোয়ার নিয়ে পথে নামে। কোমরে তাদের রাম দা। ক্রিশ্চান যদি মনে করেন গণতন্ত্র মানেই হল যে কোনও আদর্শ নিয়েই রাজনীতি করার অবাধ অধিকার, তবে ইউরোপের অনেক দেশেই তো নাৎসি রাজনীতি নিষিদ্ধ। এমনকী রাস্তায় সোয়াস্তিকার চিহ্ন নিয়ে দাঁড়ালে পুলিশ ধরে নিয়ে যায়। তবে? এখানে গণতন্ত্র কোথায় গেল। আর গণতন্ত্রই যদি এত সবকিছুর উর্ধ্বে, তবে হিটলারের নাৎসি দল তো বিপুল ভোটেই জিতেছিল জার্মানির নির্বাচনে!হিটলার তো ক্যু করে ক্ষমতায় আসেনি।
ভাবতে ভাবতে সিগারেট ধরাই। নাতালি ধমকে বলল, সিগারেট রাখো, খেতে হবে না।
–এই শেষ।
–না, ফেলে দাও। খেও না।
নাতালির চোখে আদর, শাসন।
নীলাঞ্জনা সুন্দরীটি এত আপন হয়ে উঠছে কেন আমার! তাঁর নীল চোখে আমার জন্য ভালবাসা স্থির হয়ে আছে। কেন নাতালি আমাকে ভালবাসে! আমি বাঙালি বলে, যেহেতু সে বাংলা শিখেছে? নাকি আমার কথা পত্রিকায় ছাপা হয় বলে, আমাকে রেডিও টেলিভিশনে ডাকে বলে সে ভেবেছে আমি বিখ্যাত মানুষ, তাই? নাকি আমার ওপর ফতোয়া জারি হয়েছে বলে করুণায়? নাকি আমার কিছু পদ্যের ফরাসি অনুবাদ পড়ে তার ভাল লেগেছে বলে? কোনটি? আমি অনুমান করার চেষ্টা করি। স্থির হতে পারি না কোনও একটি কারণে। এর মধ্যে জিল চলে এসেছে, সেও গুছিয়ে নিয়ে এসেছে তার ব্যাগ। আজ সে চলে যাচ্ছে মপোঁলিও।