একসময় দেখি লাল একটি জামা পরে নাতালি ঢুকছে, জিলের নাতালি। নাতালি ঢুকেই জিলকে নিয়ে দরজার বাইরে অদৃশ্য হয়ে গেল। জিল কি এখন নাতালির সঙ্গে চলে যাচ্ছে কোথাও! আমার মন খারাপ হয়ে যায়। জিল, তুমি তো বলেছো নাতালির সঙ্গে তোমার গভীর কোনও প্রেম নেই! তবে যাচ্ছে! কোথায়!
মিশেল ইডেলের সংগঠনের মেয়ে তেরেসকে দেখি । মিশেল ফোন করেছিলেন হোটেলে, আমাকে নিতে আসবেন সন্ধ্যা সাতটায়। আন্তোয়ানেত ফুকের বাড়িতে নেমন্তন্ন। জিল উদয় হয়। মন ভাল হয়ে যায়। হোবিয়া মিনার হাসি-মুখটিও পলকের জন্য চোখে পড়ে। লোকটি আমার ছায়া মাড়ান না। ভাষার অসুবিধের জন্য এই দূরত্ব তিনি নিজেই তৈরি করেছেন। ইচ্ছে করে ফরাসি ভাষাটি শিখে নিতে, কিন্তু কি করে সম্ভব! নাতালির সঙ্গে চেষ্টা করে দেখেছি, হয় না। জিভকে গোল করে পেঁচিয়ে গলার তল থেকে অদ্ভুত অদ্ভুত শব্দ ওরা বের করে, ওরকম শব্দ শত চেষ্টা করলেও আমার গলা থেকে বেরোবে বলে মনে হয় না। অনুষ্ঠান শেষ হতেই আমাকে ঘিরে ধরলো অনেকে। জার্মানি থেকে এসেছেন এক নারী সংগঠনের নেষনী। তিনি আমাকে আমন্ত্রণ জানিয়েছেন জার্মানির অনুষ্ঠানে বক্তৃতা করার।
আমি বলে দিই, দেশে গিয়ে জানাবো আপনাকে। এখনই কথা দিতে পারছি না। অনুষ্ঠানের ফরাসি দর্শকরা আমার কাছে ভিড় করেন অটোগ্রাফ পেতে।
আপনার বই কবে বেরোবে?
সম্ভবত সেপ্টেম্বরে।
আমরা অধীর আগ্রহে বসে আছি আপনার বই পড়ব বলে।
আমি বিষণ্ন হাসি। আমার দিকে বড় মায়ায় তাকিয়ে একটি মেয়ে বলল, আপনি কি ফ্রান্সেই থাকবেন এখন থেকে?
না, আমি কাল দেশে ফিরে যাচ্ছি।
দেশে কেন ফিরবেন? ওখানে যদি আপনাকে মেরে ফেলে!
আমি দেশে ফিরছি শুনে আরও পাঁচ ছজন ফরাসি মেয়ে বিস্ময়ের ঘোরে বলতে থাকে, না না না দেশে ফিরবেন না। দেশে আপনি কি করে বেঁচে থাকবেন ফতোয়া নিয়ে! এমন একটা ফতোয়া দিয়ে দিল, আর আপনি ফেরার কথা ভাবছেন, কি করে ভাবছেন!
তাই বলে নিজের দেশ ছাড়ব! অসম্ভব।
আপনার বুঝি প্রাণের মায়া নেই? যে করেই হোক বেঁচে থাকতে হবে তো। বেঁচে না থাকলে লিখবেন কি করে!
মানুষগুলোর চোখের উদ্বেগ উৎকণ্ঠা মায়া মমতাগুলো আমি অনুবাদ করে নিই।
এরপর যে কজন বাঙালি এসেছিলেন অনুষ্ঠানে, আবার ঘিরে ধরলেন আমাকে। চলুন আমাদের বাড়ি চলুন।
আজ তো পারছি না ভাই। রাতে নেমন্তন্ন আছে।
তবে কাল!
কাল চলে যাবো।
আমরা কি কিছুই করতে পারবো না আপনার জন্য?
এবার তো হল না। পরের বার এলে নিশ্চয়ই যাবো আপনাদের বাড়িতে।
পার্থ প্রতিম পরিচয় করিয়ে দিলেন শিশির ভট্টাচার্যের সঙ্গে। শিশির কালো মত খাটো মত বাচ্চা বাচ্চা চেহারার এক লোক। শিশিরকে বললাম, শুনেছি ভাল অনুবাদ করেন, আপনার কথা আমি আমার প্রকাশককে বলব, এখানকার ফরাসিদের বাংলায় আমার খুব একটা আস্থা নেই।
সকলেই খুশি হল যে বাঙালিদের কাউকে দিয়েই অনুবাদের কাজ হবে বলে। খানিক পর পার্থ আমাকে খানিকটা দূরে সরিয়ে প্রলয় রায় নামের এক লোকের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিয়ে বললেন, প্রলয় রায় চট্টগ্রামের ছেলে। বহুদিন থেকে আছেন এদেশে। প্রলয় বেশ ভাল অনুবাদ করতে পারবে। কিছু অনুবাদও করেছে। তুলনা হয় না। কোনও বাঙালিই ওর মত ভাল ফরাসি লিখতে পারে না।
প্রলয় আর শিশির দুজনের নম্বরই পার্থর কাছ থেকে নিলাম। জ্যঁ শার্ল এর বাংলায় আমি মোটেও সন্তুষ্ট নই। প্রলয়ের নামই না হয় ক্রিশ্চান বেসের কাছে প্রস্তাব করব, ভাবি মনে মনে। এক জাপানি দাঁড়িয়ে ছিল হাঁ করে। কাছে এসে বললেন, জাপান থেকে তারা আমার সঙ্গে যোগাযোগ করতে চান। আমি যেন কী একটা বিশাল কিছু হয়ে গেছি। কিন্তু আমি কি হয়েছি কিছু? খুব ভাল জানি যে আমি কিছুই হইনি। যে আমি, সে আমিই আছি, অবকাশের আমি, গোবেচারা আমি, খানিকটা বোকা বুদ্ধু, খানিকটা আদর্শ মানা, খানিকটা স্রোতে গা ভাসানো, কিছু বোঝা, কিছু না বোঝা মেয়ে।
জিলের সঙ্গে বাকিটা সময় কাটানো সম্ভব হয়নি। মিশেল ইডেল আর আন্তোয়ানেত ফুকের সঙ্গে মধ্যরাত অবদি কাটাতে হয়।
১. প্যারিসের ডায়রি – ০৬
এপ্রিলের চার তারিখ। আমার চলে যাবার দিন। এয়ারফ্রান্সে প্যারিস থেকে ব্যাংকক, থাই এয়ারলাইন্সে ব্যাংকক থেকে ঢাকা, ঢাকা থেকে বাংলাদেশ বিমানে কলকাতা, কলকাতায় কদিন কাটিয়ে আবার ঢাকা। যারা আমাকে প্যারিসে এনেছেন, তাদের আজ প্যারিসের দিকে হাত নেড়ে আমার বলতে হবে, প্রিয় প্যারিস, তোমাকে বিদায়, প্রিয় প্যারিস, জ তেম। ত্রিশ্চান বেস আমার যাবার খবর শুনে হোটেলে চলে এলেন। সই করার জন্য কনট্রাক্ট ফরম এনেছেন ক্রিশ্চান। সই করার পর বললেন, পৌঁছেই যেন তাঁকে কোরানের নারী যে বইটি মাত্র লিখে শেষ করেছি, পাঠিয়ে দিই। নাতালি আমার কাপড় চোপড় সুটকেসে ভরে দিচ্ছে। অনেকের সঙ্গে দেখা হওয়ার কথা ছিল, হল না। সময়ের অভাবে হল না। ক্রিশ্চান বেস কে পই পই করে বলে দিয়েছি, আমার লেখা কোনও ফরাসি জানে এমন বাঙালিকে দিয়ে অনুবাদ করাবেন। ক্রিশ্চান কথা দিয়েছেন যে তিনি তাই করবেন, তবে লজ্জার অনুবাদ জ্যঁ শার্ল প্রায় শেষ করে এনেছেন, এটি নতুন করে অনুবাদ করার সম্ভবত প্রয়োজন নেই। প্রয়োজন নেই, এ কথা আমি ঠিক মেনে নিই না।
প্যারিস ছেড়ে চলে যাবো, ভাবতেই বুকের মধ্যে হু হু করে ওঠে। জানি না আর কখনও আসা হবে কী না প্যারিসে, হয়ত কোনওদিনই আর হবে না। অথবা হলেও এত ভালবাসা এত আদর হয়ত পাবো না।