আমি নিচে নেমে এলে জিল শাড়ির আঁচলটি হাতে নিয়ে মিষ্টি করে হাসে। চোখদুটোও হাসে তার। টেলিভিশনে গিয়ে দেখি প্রচণ্ড সব ব্যক্তিত্বের মহিলা। আমার খুব ভাল লাগে মেয়ে-সাংবাদিক আর মেয়ে-ফটোগ্রাফারদের দেখতে। আমাদের দেশে হাতে গোনা মেয়ে সাংবাদিকতার কাজ করে। করবেই বা কি! লেখাপড়া শেষ করতে না করতেই তো তাদের বিয়ের পিড়িতে বসতে হয়, আর প্রভু স্বামীরা যা আদেশ করে মেয়েরা তো তাই মাথা নত করে পালন করে। পুরুষের পাশাপাশি বসে লেখালেখি করা, খবর যোগাড় করতে ছুটোছুটি করার কাজ মেয়েদের মানাবে না সিদ্ধান্তই নিয়ে নেওয়া হয়। যে মহিলাটি আমার সাক্ষাৎকার নেবেন, তিনি আমাকে বাংলায় প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার জন্য অনুরোধ করেন। ফরাসিরা ইংরেজি পছন্দ করে না। ইংরেজি জানলেও পারতপক্ষে বলতে চায় না। মাতৃভাষাটিই এদের কাছে পছন্দ। কথা বললে আমি আমার মাতৃভাষায় কথা বলব, অনুবাদক তারা যত খরচা হোক আনিয়ে নেবে, তবু আমাকে ইংরেজিতে কথা বলতে দেবে না। ইংরেজি ভাষাটি ফরাসিরা মোটেও পছন্দ করে না। ইংরেজের সঙ্গে এদের দীর্ঘ দীর্ঘ কালের বিরোধ এর পেছনে কাজ করে সম্ভবত।
কাকে ডাকবে বাংলা থেকে ফরাসি অনুবাদের জন্য? জ্যঁ শার্ল দাঁতের ডাক্তারের কাছে গেছে, আসতে পারেনি। সাড়ে ছটায় এটি প্রচার হবে, সুতরাং এক্ষুনি লাগবে। অতএব নাতালি, তুমি পারবে? নাতালি ভয়ে নীল হয়ে, তার ওইটুকু বাংলা বিদ্যে নিয়ে মোটে ভরসা পায় না। অতএব আমাকেই বাংলায় বলে বাংলাটুকুর ইংরেজি অনুবাদ লিখে দিয়ে আসতে হয়, নাতালি ও থেকে ফরাসি করে নেবে। সে রয়ে যায় টিভিতে। হোবিয়া মিনা বলবেন আমাকে নিয়ে, আমার পরই।
জিল এবার আমাকে নিয়ে গেল, প্রায় দৌড়ে, শার্লস এ লিজের ফন্যাকে। ফন্যাককে সাহিত্য সাংস্কৃতিক কেন্দ্র বলা যায়। বই পত্র, গানের যন্ত্র, ক্যাসেট সিডি সব বিক্রি হয়, পাশাপাশি সাহিত্যিক সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানাদি হয়। প্রায়ই লেখকরা তাঁদের বই থেকে পড়েন। আন্তর্জাতিক প্রেস ফ্রিডম দিবস পালন হচ্ছে ফন্যাকে। বড় একটি প্রদর্শনী হচ্ছে। রিপোটার্স সাঁ ফ্রন্টিয়ার্স এখানে আয়োজন করেছে আলোচনা সভার। জিল বলল, তোমার এখানে ইংরেজিতেই বলতে হবে মনে হচ্ছে। জ্যঁ শার্ল তো আসতে পারছে না। বাংলা থেকে ফরাসি করার কেউ নেই। আমার ইংরেজির যে হাল, পছন্দ মত কোনও শব্দই খুঁজে পাওয়া যায় না। রেডিও টিভিতে যা হোক ফরাসিতে তক্ষুনি তক্ষুনি অনুবাদ হয়ে যায় যা বলি। কিন্তু একেবারে দর্শক শ্রোতার সামনে! একটি চেয়ারও খালি নেই। ঘরটি পুরো ভরে গেছে। ফরাসিরা ভাল ইংরেজি জানে না, এটিই আমার ভরসা। এরকম যখন ভাবছি, তখনই দেখি এক ঝাঁক বাঙালি। ঝাঁকের মধ্যে নীলরতন, পার্থপ্রতিম মজুমদার। পার্থ বাংলাদেশের ছেলে, মূকাভিনয়ে পাকা। ঢাকায় আমার সঙ্গে দেখা করতে আমার বাড়িতে গিয়েছিলেন, তখনই আলাপ। পার্থর সঙ্গে প্যারিসের অভ্যেসে হাত মেলালাম।
–একজন বাঙালি খুঁজছিলাম, আপনাকে পাওয়া গেল।
বাঙালিরা ততক্ষণে আমাকে ঘিরে ধরেছে, কবে এসেছি, কোথায় উঠেছি, কতদিন থাকব, ইত্যাদি হাজার রকম প্রশ্ন। উচ্ছঅজ্ঞসত সব।
পার্থপ্রতিম, যেন আমার হাজার বছরের বন্ধু, বারবারই বলতে লাগলেন, ‘কেন আমাদের খবর দাওনি যেদিন এলে? সেদিনই ফোন করে দেওয়া যেত না! আমাদের বাড়িতে নেমন্তন্ন করতে পারতাম!’ পার্থর পাশে দাঁড়িয়ে থাকা এক লোক বললেন, ‘চলুন আমাদের বাড়িতে যাবেন আজকে, একবেলা অন্তত খাবেন।’ কালই চলে যাবো শুনে ইস ইস আহা আহা করে ওঠে সবাই। কেন আগে থেকে ওরা জানল না, কোথায় আছি আমি। তাহলে তো আমাকে হোটেল থেকে তুলে নিয়ে যেতে পারতেন। আগে জানলে আমরা তো একটি অনুষ্ঠানের আয়োজন করতে পারতাম। এখানে বাঙালিদের ছোটখাটো সংগঠন আছে, সব সংগঠনের পরিচালকরাই চুক চুক করে দুঃখ করছেন। সকলকেই আমার বিনীত স্বরে জানাতে হল, এখন তো আর সময় নেই ভাই। কালই চলে যাবো। কেন আর কটা দিন থাকছি না। এভাবে প্যারিসে এসে তাদের বাড়িতে না গিয়ে দুটো বাঙালি খাবার না খেয়ে বিদায় নেব, এ কেমন কথা হল!
গপ্প করলে চলবে না, মঞ্চে বক্তারা বসে গেছেন। আমাকে ডাকা হচ্ছে। মঞ্চে আমাকে নিয়ে বসালেন রিপোর্টার্স সাঁ ফ্রন্টিয়ার্সের সভানেষনী, অনুষ্ঠানের উপস্থাপকপি রচালক। সভানেষনীর বাঁ পাশে বসনিয়ার সাংবাদিক, ডান পাশে আমি, আমার পাশে ক্যামেরুন, ক্যামেরুনের ডানে আলজেরিয়া। ফ্রান্সের লোকেরা আফ্রিকার খবর খুব ভাল রাখে। আলজেরিয়া তো বলতে গেলে ফ্রান্সের ঘনিষ্ঠ আত্মীয়। বসনিয়ার খবরও বেশ রাখে। কেবল ভারতবর্ষ সম্পর্কে আগ্রহ খুব নেই। জানেও না খুব বেশি কিছু।
এক এক করে প্রশ্নের উত্তর দিচ্ছেন সাংবাদিকরা। সকলেই ফরাসি ভাষায় বলছেন। আমাকেই কেবল ইংরেজিতে বলতে হবে। ইংরেজি থেকে ফরাসিতে অনুবাদ করে দেবে কেন। যেহেতু এক ভাষা থেকে আরেক ভাষায় অনুবাদ করতেই হবে, তখন বাংলা থেকেই নয় কেন। বাঙালির দলটির দিকে যেই না প্রস্তাবটি দেওয়া হল, প্রীতি সান্ন্যাল নামের এক বাঙালি মহিলা মঞ্চে এলেন আমার অনুবাদ করতে। একটি উত্তরের অনুবাদ করে তিনি দর্শকের আসনে বসা কাউকে দেখে আমার চেয়ে ভাল অনুবাদক একজনকে দিচ্ছি বলে নিজে কেটে পড়ে যাঁকে পাঠালেন, তিনি অমিতাভ চক্রবর্তী। প্রীতি সান্ন্যালের নিজের ওপর আস্থা কিছুটা কম। জিল দাঁড়িয়ে আছে, চেয়ার একটিও খালি নেই যে বসবে। বার বার তার দিকে আমার চোখ চলে যায়। জিলের চেয়ে সুদর্শন আর কোনও ফরাসিকে কি আমি এ অবদি দেখেছি! নাহ! দেখিনি। জিল গলগল করে ফরাসিতে কথা বলে, শুনতে বেশ লাগে। তার ইংরেজি বলাও বেশ মজার, বেশির ভাগ বাক্যই সে শুরু করে আই অ্যাম গোয়িং দিয়ে। আই অ্যাম গোয়িং টু কাম টু ইয়োর হোটেল, আই অ্যাম গোয়িং টু গো টু নাতালিস হাউস, আই অ্যাম গোয়িং টু বাই এ টিকেট এরকম। হঠাৎ নাতালিকে দেখি, নীলরতনকেও। নীলরতন আমার দেওয়া শার্টটি পরে এসেছে। অমিতাভ চক্রবর্তী অনর্গল আমার কানের কাছে মুখ এনে বলে যাচ্ছেন মঞ্চের বক্তারা কে কি বলছেন। বক্তাদের বক্তব্য শেষ হলে দর্শকদের মধ্য থেকে প্রশ্ন শুরু হল। মূলত ফরাসি-ভিড় থেকে প্রশ্ন। একজন জার্মান ভদ্রলোক জানতে চাইলেন, ইউরোপ থেকে তাঁরা কি করে আমাকে সাহায্য করতে পারেন। আমি বললাম, দেশ ও বিদেশের যুক্তিবাদী বিবেকবান সচেতন মানুষের সহযোগিতা ছাড়া আমার পক্ষে পাসপোর্ট পাওয়া সম্ভব হত না। পশ্চিমের দেশগুলো যে দেশগুলো বাক স্বাধীনতা এবং মানবাধিকারে বিশ্বাস করে, অনেকে আমার পাসপোর্ট ফেরত দেবার জন্য, আমার নিরাপত্তার জন্য, লজ্জা বইটির ওপর থেকে সরকারি নিষেধাজ্ঞা তুলে দেওয়ার জন্য প্রচুর চিঠি লিখেছেন। তাদের আন্দোলনের ফলেই আমি আমার পাসপোর্ট ফেরত পেয়েছি। আপনাদের কাছে আমি সত্যিই কৃতজ্ঞ। হয়ত একদিন আমি নিরাপত্তা পাবো দেশে। হয়ত লজ্জা বইটির ওপরও আর নিষেধাজ্ঞা থাকবে না।