ইহুদিদের খাবার খুব আলাদা স্বাদের। জিল বলে।
আমি বলি, তা কেন হবে? কোনও খাবারই ধর্মভিত্তিক নয়। এগুলো দেশভিত্তিক, এলাকা ভিত্তিক।
জিল সবেগে মাথা নেড়ে আমাকে অস্বীকার করে বলে, না, ইহুদিদের খাবার অন্যরকম।
–কী বলছো আবোলতাবোল! কোনও খাবারকে তুমি বলতে পারো না এই খাবার ইহুদিদের, এই খাবার মুসলমানদের বা খ্রিস্টানদের। ফ্রান্সে যে ইহুদিরা হাজার বছর থেকে বাস করছে, তাদের খাবার ইহুদি-খাবার হবে কেন, হবে ফরাসি খাবার! বাংলাদেশের মুসলমানের খাবার আর ইরাকের মুসলমানের খাবার এক নয়। ভারতের খ্রিস্টানদের খাবার আর ইতালির খ্রিস্টানদের খাবার এক নয়। আরবের ইহুদি আর জার্মানির ইহুদির খাবারও এক নয়।
জিল বলে, এক।
এক হওয়ার তো কারণ নেই।
জিল আবারও বলে, এক। এক, কারণ সব দেশেই তাদের বিশেষ খাবারগুলো তারা এক রকম করে তৈরি করে।
না, আমি তোমার কথা মানতে পারলাম না।
না মানতে পারলে আমার কিছু করার নেই। কিন্তু আমি যা বলছি, তা ঠিক। ইহুদিরা প্রতিটি দেশেই একরকম করে খাবার তৈরি করে।
আমি সজোরে মাথা নেড়ে বললাম, ধর্মের সঙ্গে খাবারের কোনও সম্পর্ক নেই, থাকতে পারে না। আমি নিশ্চিত ভারতের ইহুদি আর ফ্রান্সের ইহুদি একরকম খাবার তৈরি করে না। ভারতের উত্তরাঞ্চলের হিন্দু আর দক্ষিণাঞ্চলের হিন্দুদের খাবারই ভিন্ন। এসব নির্ভর করে এলাকার ওপর। নির্ভর করে সেই এলাকার সংস্কৃতির ওপর।
জিল তার মত ফেরায় না। আমিও না।
যে কটি খাবারের কথা বলা হয়েছে, এক এক করে সব আসে। সবগুলোর মধ্যে কিছু না কিছু বেগুন আছে, তাও আবার বিস্বাদ। ঝাল। জিলের থালায় বড় একটি মরিচ সেদ্ধ। শাকপাতার ভেতর ভাত ভরে মুড়ে দিয়েছে। কি অদ্ভুত খাবার বাবা! আমার পক্ষে খাওয়া সম্ভব হয় না। আমার থাল থেকে জিল খেল, আমি জিলের থেকে খানিকটা। ব্যাস।রেস্তোরাঁ থেকে বেরিয়ে যখন হাঁটছি, হঠাৎ দেখি একটি রেস্তোরাঁর নাম ভলতেয়ার রেস্তোরাঁ, ভলতেয়ারের নামে রাস্তা।
এখানে কি ভলতেয়ার থাকতেন?
জিল বলে, না, সম্মান জানানো হচ্ছে।
জ্যঁ শার্ল বলে, তসলিমার নামেও একদিন প্যারিসে রাস্তা হবে।
হো হো করে হেসে উঠি।
মডার্ন আর্ট মিউজিয়ামটি বাইরে থেকে দেখলে মনে হবে আস্ত একটি তেলের কারখানা। নানারকম নল দিয়ে বানানো মিউজিয়ামের দেয়ালটি। এলাকাটিতে লোকের ভিড়, কিছু না কিছু লেগেই আছে। নাতালি বলল এখানে নাকি বেশ কিছু বাঙালি কাজ করে। পথে কোনও বাঙালি দেখলেই সে হেসে আমার দিকে তাকায়, কানে কানে বলে, দেখলে বাঙালি। কিছু বাঙালি দেখলাম, রাস্তায় দাঁড়িয়ে চালের মধ্যে নাম লিখে লকেট বিক্রি করছে। অত ছোট চালের মধ্যে কি করে নাম লেখা যায়, তা আমার মাথায় ঢোকে না। মেট্রোয় রেল চড়া হল, কোনও বাদামঅলা বাঙালি চোখে পড়ল না। নাতালি বলল, গরম পড়ে গেছে, ওরা বাইরে চলে এসেছে।
১. প্যারিসের ডায়রি – ০৫
একটি পার্কার কলম কেনার শখ হল হঠাৎ। ভীষণ দাম।
–জিল, আমাদের দেশেও পার্কার কলম পাওয়া যায়। কিন্তু এত দাম নয় তো ওগুলো!
–ওগুলো নিশ্চয়ই আসল নয়, নকল। তাই দাম কম। তুমি প্যারিস থেকেই পার্কার কেনো। এগুলো আসল।
–পার্কারের গায়ে ঠিক এরকমই তো লেখা থাকে, কেন আসল হবে না আমাদের দেশেরগুলো?
জিল বলে, হয়ত নিবটা এত ভাল না, এগুলোর যেমন ভাল।
জিল তার মত পাল্টাবে না কিছুতেই। শেষ অবদি দাম দিয়েই একটি পার্কার কলম কেনা হয়। যে কোনও দাম দেখলেই আমি আট দিয়ে গুণ করে ফেলি। বইয়ের দোকানে ঢুকেও কিছু আর কেনা সম্ভব নয়। বিশাল একখানা বই ল্যুভরের ওপর। দামেও কুলোতে পারব না, ওজনেও না। তাই বাদ। আরও কিছুক্ষণ বইয়ের দোকানগুলোয় সময় কাটাবো, তার সময় নেই। টেলিভিশনে যেতে হবে, জিল তাড়া দিল।
–ধ্যুৎ এত টেলিভিশন আমার ভাল লাগে না। হলই তো কত।
–এটিই শেষ। জিল মিনতি করে।
একপ্রশ্ন, এক উত্তর। আর ভাল লাগে না। লজ্জা কেন সরকার বাজেয়াপ্ত করল, ফতোয়া দিল কেন, আমার কেমন লেগেছে ফতোয়ার পর, কোনও সমর্থন আছে কি না দেশে, এসবই তো। ফরাসিরা তো শুনেছেই এসব, আর কত শুনবে! আমার ভাল লাগে না।
জিল বলে, বুঝি আমি। আমি যদি তুমি হতাম, আমারও এমন লাগত, যেমন লাগছে তোমার। কিন্তু ওরা এমন করে ধরেছে, এবারটিই শেষ, তোমাকে আর কষ্ট দেব না। আমি শান্ত গলায় বলি, জিল, আমি সাধারণ একজন মানুষ। খুব সরল ভাষায় খুব সাধারণ জিনিস লিখি। আমাকে নিয়ে এত হৈ চৈ কেন! আমি তো ভেবেছিলাম স্ট্রাসবুর্গে অনুষ্ঠানটি করে ফিরে যাবো দেশে। মাঝখান থেকে প্যারিসটা দেখব। প্যারিস দেখারইচ্ছে আমার বহুদিনের। এইসব রেডিও টেলিভিশন এত না করে প্যারিসটা ঘুরে বেড়ালে ভাল লাগত। অথবা তোমাদের সঙ্গে আড্ডা দিয়ে।
জিল দীর্ঘশ্বাস ফেলে। জিলও সম্ভবত বাঁধা তার এই সংগঠনের চাকরিতে। তারও কিছু করার নেই। আমাকে এখানে নিয়ে এসেছে রিপোর্টার্স সাঁ ফ্রন্টিয়ার্স আর আর্তে টেলিভিশন, এত খরচ করছে এরা আমার পেছনে, না হয়, যা অনুরোধ করছে, মেনেই নিলাম কিছু। কালই তো চলে যাবো। হোটেলে পৌঁছে জিল বলল, তোমাকে তিন মিনিট সময় দিলাম। এর মধ্যে তৈরি হয়ে নাও।
জিলের কাছে আবদার করে দশ মিনিট সময় নিয়ে স্নান করে একটি বালুচরি শাড়ি পরলাম। গাঢ় খয়েরি রঙের। জিলের এই রংটি খুব পছন্দ। আগেই এই শাড়িটি দেখে বলেছিল, এটি তোমাকে একদিন পরতে হবে,অন্তত আমার জন্য। শাড়িটির আঁচলে একটি মেয়ে কলসি হাতে, একটি ছেলে ঘোড়া চালাচ্ছে এসব দেখে বলেছিল, প্রেমের গল্প বুঝি!