বাবাকে বলা হয়েছে বিমান বন্দরে যাওয়ার তাঁর দরকার নেই, কিন্তু তিনি প্যান্ট শার্ট পরে তৈরি হয়ে রয়েছেন সবার আগে। দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আছেন। বাবাকে অসহায় বালকের মত দেখতে লাগে। তিনি করুণ চোখে তাকাচ্ছেন সবার দিকে, যেন তাঁকে নিয়ে যাওয়া হয়। ছোটদা বাবার হাত টেনে শোবার ঘরে নিয়ে এসে বললেন, কোনও দরকার নাই আপনের যাওয়ার। কিন্তু তিনি নাছোড়বান্দা, যাবেনই। আমি বললাম, বাবা যাবে।
না, দরকার নাই। কি দরকার! ছোটদা বললেন।
কারও তো যাওয়ার তাইলে দরকার নাই। আমি রাগ দেখালাম।
গাড়িতে জায়গা হবে না।
হবে।
দরজার কাছে যেতেই মা আমাকে শরীরের সমস্ত শক্তি দিয়ে ধরে রাখেন। দু বাহুতে শক্ত করে আমাকে বুকে আঁকড়ে রাখেন। আমাকে মার শক্ত আলিঙ্গন থেকে জোর করে টেনে বের করেন দাদা আর ছোটদা। আমি বাবার হাত ধরে দরজার বাইরে বেরোই। দরজার কাছে বন্দুক হাতে দাঁড়িয়ে থাকা ছজন পুলিশ ঠিক বুঝে পেল না এত রাতে কোথায় যাচ্ছে বাড়ির এতগুলো লোক।
মিলন পুলিশদের বলল, আমার খালা আজকে চিটাগাং যাইতাছে, তারে পৌঁছাইয়া দিতে যাইতাছি ।
পাহারা পুলিশও যেন না জানে আমি বেরিয়ে যাচ্ছি, কারণ এদের মধ্যেও মৌলবাদী থাকতে পারে, এদের মধ্যে কেউ খবর দিতে পারে যে আমি এখন বিমানবন্দরে যাচ্ছি। সরকারের ওপরতলা জানে আমি যে যাচ্ছি, নিচতলা জানে না কূটনীতির সবকিছু। এমন সতর্কতার মধ্যে ইতিউতি তাকিয়ে সবাই নীচে গ্যারেজে নেমে এল। চালকের আসনে ছোটদা, ছোটদার পাশে মিলন, পেছনে আমি দাদা আর বাবার মাঝখানে। সাদা গাড়িটি বেরিয়ে এল ইস্টার্ন পয়েন্ট থেকে। সুনসান রাস্তা, শান্তিনগরের মোড় অবদি পৌঁছতেই আমাদের গাড়ির সামনে একটি, পেছনে একটি গাড়ি চলতে শুরু করে। পুলিশের গাড়ি। পেছনে বাড়িটির দিকে তাকানো হয় না আমার। বারান্দার রেলিং ধরে দাঁড়িয়ে আছেন মা, টের পাই। মার কান্নার শব্দ আমার সঙ্গে বিমান বন্দর অবদি যায়।
বিমান বন্দরে গাড়ি থেকে নামতেই দেখি মোচঅলা আর মোচহীন পুলিশ অফিসার দুজন আমার দু পাশে। সাদা পোশাকের এক দল পুলিশ ঢুকে যাচ্ছে বন্দরের ভেতরে। মাঝখানে আমি, আড়াল করে রাখা হচ্ছে আমাকে। যেতে যেতে কখন একসময় লক্ষ্য করি পেছনে আটকে পড়েছে বাবা, দাদা, ছোটদা আর মিলন। থমকে দাঁড়িয়ে পড়ি। পেছনে তাকিয়ে দেখি ওরা আমার নাগাল না পাওয়া দূরত্বে। কিন্তু আমাকে দাঁড়ালে চলবে কেন! পুলিশের তাড়ায় আমাকে হাঁটতে হয় সামনে। দূরত্ব বাড়তে থাকে। হু হু করে ওঠে বুক। সোজা আমাকে বিমানের ভেতরে নিয়ে গেলেন পুলিশ অফিসার দুজন। ভেতরে কিছু লোক বসে আছে। হঠাৎ দেখি ঙ বসে আছেন আমার আসন থেকে দু সারি কিছু পেছনে। মুহূর্তের জন্য চোখাচোখি হয়।
জানালায় তাকিয়ে থাকি। বাইরে একটু একটু করে আলো ফুটছে।
রানওয়ে পার হয়ে যখন বিমানটি আকাশে, জানালায় চোখ রেখে দেখছি আমার ক্ষুদ্র দরিদ্র দেশটি, অভাবে অসুখে থাকা দেশটি, বারো কোটি মানুষের জনাকীর্ণ দেশ, দুর্ভিক্ষে খরায় বন্যায় ভোগা দেশটি, আমার জন্মের দেশ, আমার শৈশব কৈশোর যৌবনের দেশটি। যত ওপরে উঠি দেশটি ধূসর হতে থাকে, দেশটি একটু একটু করে অদৃশ্য হতে থাকে, অদৃশ্য হতে থাকে বিমান বন্দরে নিষ্পন্দ দাঁড়িয়ে থাকা বাবা, শান্তিনগরের বাড়ির বারান্দায় দাঁড়িয়ে আকাশের দিকে চেয়ে থাকা মা, অদৃশ্য হতে থাকে আমার সকল স্বজন, সকল বন্ধু। অদৃশ্য হতে থাকে আমার জন্ম জন্ম চেনা প্রকৃতি, বাড়িঘর, উঠোন, পুকুর, অদৃশ্য হতে থাকে নদী, গাছ গাছালি, মেঠো পথ, বন, ফসলের ক্ষেত। এক ঝাঁক মেঘ এসে হঠাৎ আড়াল করে দেয় সব। মেঘ খানিকটা দূরে সরবে এই আশায় মেঘের দিকে তাকিয়ে থাকি পলকহীন চোখে। মেঘ তুমি সরে যাও, আমাকে আরেকটু দেখতে দাও। মেঘ তবু সরতে চায় না। নিষ্ঠুর বিমানটি আরও মেঘ ফুঁড়ে মেঘের ওপরে উঠে যায়। আচমকা অদৃশ্য হয়ে যায় আমার দেশটি, বড় প্রিয় দেশটি।
নিজের একটি দীর্ঘশ্বাসের শব্দে নিজেই চমকে উঠি।
শ্বাসটি কি নিশ্চিন্তের! স্বস্তির! জীবন ফিরে পাওয়ার!
নাকি বেদনার! অনিশ্চয়তার! জীবন হারানোর!
(সমাপ্ত)