না বলতে আমি পারি না। জানি না, না বলতে আমার কষ্ট হয় কেন। বড় করে একটি না বলে দেব, পারি না। কণ্ঠে স্বর ওঠে না। লজ্জা হয় না বলতে। কেমন যেন মায়া হয় মানুষটির জন্য। আমি খুব ভাল করেই জানি যে আমি এমন কিছু লিখিনি যা কি না ফরাসি ভাষায় প্রকাশ পেতে পারে। লজ্জা তো নয়ই। ক্রিশ্চান যখন আমার কাছে যা কিছুই এ পর্যন্ত লিখেছি সবই চেয়েছে, আমি সত্যিই লজ্জায় পড়েছি। আন্তোয়ানেত ফুক আর মিশেল ইডেল যখন চেয়ে মরেছে, লজ্জা আমার কম হয়নি। তবু বড় দ্বিধায় নির্বাচিত কলামটি দিয়েছি। যে স্বাধীনতার কথা বলেছি নির্বাচিত কলামে, সে স্বাধীনতা এখানকার মেয়েরা বহু আগেই পেয়ে গেছে। আমার নারীবাদ এদের কাছে নিতান্তই পুরোনো জিনিস। আর যে কটি লেখাই লিখেছি, সবই তো আমাদের দেশ আর সমাজ সম্পর্কিত, কতটুকুই বা ফরাসিরা অত দূর দেশের নিত্যদিনের সমস্যার সঙ্গে জড়িত! ক্যারোলিন কনট্রাক্ট ফরম নিয়ে এসেছেন। বলেছি, এখন সই করব না, আগে দেশে ফিরে দেখি আদৌ কোনও গল্প আমার কাছে আছে কি না। থাকলে কোন কোনটি আপনাকে পাঠানো যায়। ক্যারোলিন একটি প্যাকেট আমার হাতে দিয়ে বললেন, এটা তোমার জন্য। খুলে দেখি একটি ঘড়ি। বললেন, জ্যঁ শার্ল বলেছে, তোমার একটি ঘড়ি দরকার।
জ্যঁ শার্লকে আমি বলিনি, আমার ঘড়ি দরকার। নিশ্চয়ই সে লক্ষ করেছে যে আমার হাতে ঘড়ি নেই। প্যারিসের অনেক মেয়েই দেখেছি রঙিন ঘড়ি পরে। রঙিন ঘড়ি আমার পক্ষে পরা সম্ভব নয়, মনে মনে বলি, কেমন যেন বাচ্চা বাচ্চা লাগে। তখনও আমি জানি না সোয়াচ ঘড়ি, সে রঙিন হলেই কি, না হলেই কি, এর মূল্য অনেক। এদিকে ফটোগ্রাফারের মেশিনগান চলছে। ক্যাটক্যাটক্যাটক্যাটক্যাট। থামাথামি নেই। এত ছবি তুলে কি হবে গো? কি করবে এত ছবি!
নাতালি পরে বলেছে, বোঝো না কি করবে এসব ছবি? বিক্রি করবে।
বিক্রি? কোথায়?
ফ্রান্সের কাগজে। কেবল কি ফ্রান্সের! বিভিন্ন দেশের পত্রিকায়। কেবল কি পত্রিকায়! বইয়ের প্রকাশনী আছে, পোস্টার কোম্পানী আছে. টেলিভিশন আছে..।
এই ক্যাটক্যাট যেতে না যেতেই লা হিউমানিতের সাংবাদিক এলেন। লা হিউমানিতে বামপন্থীদের পত্রিকা। সাংবাদিকের সঙ্গে সমাজতন্ত্র বিষয়ে বিস্তর কথা হল। সমাজতন্ত্রে কেন আমি বিশ্বাস করি। সোভিয়েত ইউনিয়ন পতনের পর আমি কি আশাবাদী, যদি আশাবাদী, কেন আশাবাদী। সাক্ষাৎকার যখন চলছিল, তখনই জিল এল। যেতে হবে রেডিওতে। নাতালিকেও সঙ্গে নিলাম। জ্যঁ শার্ল আগেই গিয়ে বসে আছে ওখানে। আমি আর সাংবাদিক মেয়েটি, যে আমার সাক্ষাৎকার নেবে, গিয়ে বসলাম একটি গোল টেবিলের ঘরে, টেবিল ঘিরে মাইক্রোফোন, কাচের দেয়ালের ওপাশে একটি ঘর। ইংরেজিতে প্রশ্ন করা হবে, আমি বাংলায় উত্তর দেব, জ্যঁ শার্ল সঙ্গে সঙ্গে আমার বাংলা ফরাসিতে অনুবাদ করে দেবে। নাতালিও বসেছে একটি চেয়ারে। কাচের দেয়ালের ওপাশে ঘরটিতে রেকর্ডিং কন্ট্রোল হচ্ছে, ও ঘরটিতেই দাঁড়িয়ে আছে জিল। এক একটি প্রশ্নের উত্তর দিই আর জিলের দিকে তাকাই। জিল মিষ্টি করে হাসে। চোখ টিপে বাহবা জানায়। জিলকে আমার এত আপন মনে হয় যে ভুল করে তার সঙ্গে আমি প্রায়ই বাংলায় কথা বলে ফেলি। রেডিও থেকে বেরিয়ে ট্যাক্সি নিয়ে পিকাসো মিউজিয়ামে যাই। পিকাসো মিউজিয়াম দেখব এরকম একটি ইচ্ছে প্যারিসে নামার পর থেকেই ছিল। জিল বলল, বোধহয় বন্ধ, তবু চল। গিয়ে ঠিক ঠিকই দেখা গেল বন্ধ। প্যারিসের মিউজিয়ামগুলো কোনওটি সোমবার, কোনওটি মঙ্গলবার বন্ধ থাকে, এরকম নয় যে সপ্তাহের দুটোদিন শনি রবিবার মিউজিয়ামগুলোও বন্ধ থাকবে। হাঁটতে হাঁটতে কোথাও খাবো বলে একটি রেস্তোরাঁয় ঢুকি। জিল বলল, এটা ইহুদিদের রেস্তোরাঁ, এদের খাবার খুব ভাল হয়। রেস্তোরাঁর চেহারাটি অন্যরকম। যেন ধ্বংসস্তূপ। অথবা কোনও গুহা। এরকম করেই বানানো হয়েছে। আমাদের দেশে যেমন বাড়িঘর রং করলে ভাবা হয় সুন্দর, এখানে কিন্তু সব সময় তা নয়। যত পুরোনো বাড়ি, যত প্রাচীন, মলিন, তত তার মর্যাদা বেশি। প্যারিসের বড় বাড়িগুলো সব পাথরে বানানো, কোনও রঙের প্রয়োজন হয় না, সেগুলোই প্যারিসের সৌন্দর্য। ইট সিমেণ্টের বাড়িগুলোকে, উঁচু হোক, ঝকঝকে হোক, মোটেও সুন্দর বলে মনে করা হয় না। আমি আমাদের কথাই ভাবি, পুরোনো বাড়ি ভেঙে নতুন বাড়ি বানানোর ধুম চলে। আমাদের অবকাশ খুব পুরোনো বাড়ি। বিশাল বিশাল দরজা জানালা, উঁচু সিলিং, দেয়ালের কারুকাজকে মোটেও ভাবা হয় না সুন্দর কিছু। অবকাশ ভেঙে নতুন ডিজাইনের বাড়ি করার ইচ্ছে বাড়ির প্রায় সবারই। তার ওপর সেই পুরোনো কাঠের কারুকাজ করা আসবাবপত্রগুলোকে পারলে ভেঙে খড়ি বানানোর ইচ্ছে সবার। সিংহের মুখ অলা খাটের পায়াগুলোকে পুরোনো পচা ভাবা হয়, তার চেয়ে কোনও পায়াহীন বাক্সের মত খাটগুলোকে মনে করা হয় সুন্দর, আধুনিক। আধুনিক আসবাবপত্র, বাড়িঘরের প্রতি ওখানে আকর্ষণ প্রচণ্ড। প্যারিসে ঠিক তার উল্টো। বিশাল ঝকঝকে তকতকে অত্যাধুনিক দোকানের জানালায় দেখেছি সাজানো আছে চটের বস্তা, পোড়া খড়ি, ভাঙা ইট, মরা ডাল। ওগুলোই এখানে সৌন্দর্য। এসব দেখে আমার একটি জিনিস মনে হয়, আধুনিকতার শীর্ষে উঠে এদের আর আধুনিকে আকর্ষণ নেই, আর প্রাচীনতম দেশগুলোয় পা পা করে যেখানে আধুনিকতা উঁকি দিচ্ছে, সেখানে মানুষ হুড়মুড় করে গিয়ে আঁকড়ে ধরছে সেটি। আধুনিকতা মানে কি? নিজের কাছেই প্রশ্ন করি। স্থাপত্যে, আসবাবে, পোশাকে নতুন ঢংএর নামই কি আধুনিকতা! মনের আধুনিকতাকে যদি সত্যিকার আধুনিকতা বলি, তবে ধনী দরিদ্র নতুন প্রাচীন সব দেশেই আছে সেই আধুনিকতা। দেশ বা সমাজ ভিন্ন হতে পারে, কিন্তু আমরা যারা পুরোনো মূল্যবোধ পেছনে ফেলে নতুন দিকে নতুন করে নতুন ভাবে নতুন সময়ের কথা ভাবছি, তাদের ভাবনাগুলো এক। আর যারা ধর্মান্ধতা, অজ্ঞতা, হিংস্রতা ইত্যাদি নিয়ে আছে, তাদের আচরণগুলোও এক।