ছোটদার ঠোঁটে অদ্ভুত একটি হাসি। দাদার ফ্যাকাসে মুখে কোনও হাসি নেই, তিনি চেয়ারে বসে পা নাড়ছেন। পা গুলো খুব দ্রুত নড়ছে। সামনে তাঁর যত্ন করে কাটা গত দুমাসে দেশের পত্রিকাগুলো থেকে আমি জড়িত খবরের কয়েক দিস্তা কাগজ। বিদেশ থেকে আসা চিঠিপত্র, ফ্যাক্স।
এইগুলা নিয়া যা নাসরিন।
না।
কাজে লাগতে পারে।
না।
বিছানায় শুয়ে থাকি। আমার পাশে বাবা শুয়ে আছেন। বিছানার কিনারগুলোয় বসে আছেন ছোটদা, দাদা। ইয়াসমিন আর মিলনও আছে। মা কাঁদছেন আমার পায়ের কাছে বসে।
৪. দেশান্তর – ৪ (শেষ)
যা যা পছন্দ করি খেতে, মা সারাদিনই চোখের জলে ভাসতে ভাসতে সেসব মুখে তুলে দিয়েছেন, খেতে না চাইলেও মুখে ঢুকিয়ে দিয়েছেন। রাত ঘন হচ্ছে আমি ঘন ঘন চা পান করছি। মা আবারও মুখের সামনে খাবার নিয়ে এলেন। ধুত্তুরি বলে ঠেলে সরিয়ে দিলাম মার হাত। এ সময় কার খেতে ইচ্ছে করে! ঘড়ির দিকে বার বার চোখ চলে যাচ্ছে। যত কাঁটা এগোচ্ছে, তত আমার শরীর শিথিল হচ্ছে।
রাত দেড়টার দিকে দেখি দুটো গাড়ি শান্তিনগরের মোড়ের কাছে। ছোটদা দেখে বলেন, ওইগুলা পুলিশের গাড়ি।
আমাকে এখন এমন কাপড়ে ঢাকতে হবে শরীর এবং মুখ, যেন কেউ আমাকে চিনতে না পারে। ওড়নায় আবার মুখ মাথা ঢাকার পালা, বেরিয়ে থাকবে কেবল চোখ, চোখে আবার একটি কালো চশমা, আর চোখের ভুরু ইয়াসমিন এমন করে এঁকে দেয় যেন আমার ভুরু বলে কেউ ধারণা করতে না পারে। আয়নার সামনে এভাবে আমাকে সাজতে হয়, এবং খুঁটিয়ে দেখতে হয় আমি বলে কিছু আমার চেহারায় আছে কি না। নেই বুঝে সরতে হয়, সরে আমাকে দরজার দিকে হাঁটতে হয়। কারণ ছোটদা, দাদা, মিলন তৈরি, সময় হয়ে গেছে। মা এই দৃশ্য দেখতে চান না, তিনি মেঝেয় লুটিয়ে পড়ে কাঁদছেন। মার শাড়ি সরে গেছে মার শরীর থেকে। কপাল ফেটে রক্ত বেরোচ্ছে। বাবা ধমকে থামাতে চাইছেন মাকে, আশে পাশের বাড়ি থেকে লোক জেগে যাবে বলে।
মাকে থামানোর সাধ্য কারও নেই।
মা কেঁদে কেঁদে বলছেন, আমার মেয়েরা তরা ষড়যন্ত্র কইরা দেশ থেইকা বার কইরা দিতাছস। আমার মেয়েরে আমার কাছে ফিরাইয়া দে তরা। আমার মেয়েরে আমি যাইতে দিব না। কোথাও যাইতে দিব না।
বাবা, দাদা আর ছোটদার বিরুদ্ধে অভিযোগ শেষ করে মা আল্লাহ নিয়ে পড়েন, আল্লাহগো, এ কি করলা গো আল্লাহ। তোমার পায়ে পইরা কত কানছি। কত কইছি আমার মেয়েরে কোনও বিপদ দিও না। আমার মেয়েরে কই পাডাইতাছো আল্লাহ গো। আমি কি কইরা বাচবাম! আল্লাহ তুমি কি করলা। আমার মেয়েরে এত কষ্ট কেন দিতাছ। ও তো এত কষ্ট সইতে পারবো না। কষ্ট আমারে দেও আল্লাহ। ওরে আর কষ্ট দিও না। আমার মেয়েরে আমার কাছে থাকতে দাও আল্লাহ। ওরে নিও না। ওরে আমার কাছ থেইকা দূরে সরাইও না।
মাকে মেঝে থেকে উঠিয়ে আমি আমার টিকিটটি দেখাই, এই দেখ মা, টিকিটে লেখা আছে ফেরার তারিখ। ঠিক এক মাস পরে আমার ফেরার তারিখ, দেখ দেখ আটই সেপ্টেম্বর। দেখছ? টিকিট আমার হাতে দেশে ফেরার। তুমি কাইন্দ না।
মা চোখ তবু মোছেন না। তবু মা কাঁদেন। আমি জানি, মাও জানেন যে আমাকে যেতে হচ্ছে, দেশে থাকার উপায় নেই বলে কোথাও যেতে হচ্ছে আমার। আমি জানি যে দেশের অবস্থা খানিকটা ভাল হলে, মৌলবাদীদের আস্ফালন সামান্য কমে এলে আমি দেশে ফিরবো, কিন্তু আমি জানি না যে মৌলবাদীদের আন্দোলন কমে এলেও, দেশের অবস্থা খানিকটা নয়, অনেকটা ভাল হলেও আমার আর ফিরে আসা হবে না। কারণ আমাকে ফিরতে দেওয়া হবে না। আমি জানি না যে আসলে এই আমার শেষ যাওয়া। আমাকে কোনওদিন আর আমার নিজের দেশে ফিরতে দেওয়া হবে না। সরকারের বদল হবে, কোনও সরকারই আমাকে দেশে ঢুকতে দেবে না আর। আমাকে আমার নাগরিক অধিকার থেকে বঞ্চিত করা হবে, সকলে জানবে সব কিন্তু কেউ কোনওদিন এত বড় একটি অন্যায়ের বিরুদ্ধে কোনও টুঁ শব্দ করবে না। একজন লেখককে তাঁর লেখার অপরাধে, তাঁর মত প্রকাশের অপরাধে চরম নির্বাসনদণ্ড পেতে হবে, পুরো একটি দেশ তাকিয়ে তাকিয়ে দেখবে কেবল, কোনও আপত্তি করবে না। আমি যাচ্ছি স্বপ্ন নিয়ে যে দেশের বোধবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষেরা কিছুতেই মেনে নেবেন না যে একজন লেখককে তাঁর লেখার কারণে নির্বাসনে যেতে হবে, তাঁরা আন্দোলন করবেন, আমাকে দেশে ফেরত নিয়ে আসার জন্য সরকারের কাছে দাবি জানাবেন, আমি একদিন ফিরে আসবো নিজের দেশে সসম্মানে, যেভাবে নিজের মুখখানি ঢেকে মাথা নিচু করে চরম অসম্মাননা নিয়ে নাম পরিচয় লুকিয়ে আমাকে দেশ থেকে বেরোতে হল, সেভাবে নয়, শির উঁচু করে ফিরব,নিজের নামটি নিয়ে ফিরব, লেখক হিসেবে ফিরব, লেখকের অধিকার নিয়ে ফিরবো, বাক স্বাধীনতার জয় জয়কার ধ্বনিত হবে চারপাশে, আমি ফিরব। কিন্তু আমি জানি না যে আমার স্বপ্ন পায়ে মাড়িয়ে যাবে লোকে, কেউ কখনও আমার দেশে ফিরে আসার কথা ভুলেও তুলবে না। আমি জানি না যে আমাকে দেশের লোকেরা ভুলে যাবে খুব দ্রুত, আমার কথা আর কোথাও তেমন উচ্চারিত হবে না। না, আমি কিছুতেই জানি না যে দেশ থেকে আমাকে বিতাড়িত করার এই ঘটনাটি সকলে বিস্মৃত হবে অচিরেই। অচিরেই আমাকে একটি ভুলে যাওয়া নামে, লেখকে পরিণত করবে সকলে। কেউ আর আমার কোনওরকম প্রয়োজনীয়তার কথা অনুভব করবে না। কেবল একজনই অনুভব করবেন, তিনি আমার মা। তিনিই শুধু ভাববেন ঘরের মেয়ে ঘরে ফিরে আসুক। তিনিই কেবল আমার জন্য অপেক্ষা করবেন, প্রতিদিন তাকিয়ে থাকবেন আকাশের দিকে, উড়োজাহাজে করে আমি ফিরে আসছি দেশে, এই আশায়। তিনিই শুধু ভাববেন আমাকে, তিনিই শুধু আমার না থাকাকে সইতে পারবেন না। একা একা কাঁদবেন তিনি। কেউ তাঁর ওই কান্নার দিকে ফিরে তাকাবে না।