ভেতর ঘর থেকে মার কান্নার শব্দ ভেসে আসছে। কান্নার শব্দ অনুসরণ করে আলুথালু মাকে দেখি দেয়ালে মাথা ঠুকে ঠুকে কাঁদছেন। চাপা স্বরে বলি, কাইন্দা কোনও লাভ হইব? বাইচা থাকতে চাইলে আমার তো যাইতেই হইব।
মা আমাকে জড়িয়ে ধরে ফুঁপিয়ে বলতে থাকেন, তুমারে আমি লুকাইয়া রাখবাম, কেউ জানব না। তুমি যাইও না মা। উপরে আল্লাহ আছেন। কেউ কিছু করতে পারব না। সব ঠিক হইয়া যাইব। তুমি শুধু বইলা দিবা ধর্মের বিরুদ্ধে আর কিছু লিখবা না। মেয়েদের নির্যাতনের বিরুদ্ধে, মেয়েদের স্বাধীনতার জন্য যা লিখতাছিলা,তেমন লিখবা, শুধু ধর্মের বিরুদ্ধে না লিখলেই তো হইল।
বাবা দীর্ঘ একটি শ্বাস ছেড়ে বললেন, বললেও ওরা মানবে না কিছু। ও তো বলছেই কোরানের কথা বলে নাই, তারপরও কি ওরা থামছে?
গ্রীবা শক্ত করে মা বললেন, ও তাইলে ক্ষমা চাক। যা লেখছে তার জন্য ক্ষমা চাইয়া ফেললে আর কোনও মিছিল হবে না।
আমি দৃঢ় কণ্ঠে বললাম, আমি মইরা যাবো, তবু ক্ষমা চাইব না।
কেন চাইবা না? মানুষ ভুল করলে ক্ষমা চায় না? মার হাতদুটো চেপে ধরেছে আমার হাত।
আমি কোনও ভুল করি নাই।
এত অহংকার ভাল না নাসরিন। তুমি ক্ষমা চাইয়া ফালাও, তাইলে দেখবা আর কেউ কোনও অসুবিধা করব না। মা আমার গায়ে হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলেন।
মার সামনে থেকে সরে আসি। আমার পেছনে উঠে আসতে আসতে তিনি বলতে থাকেন, আমি সাংবাদিকদের ডাকব, ডাইকা আমি আমার মেয়ের হইয়া ক্ষমা চাইব। না মা। এইগুলা কইর না। আমার যাইতে হইবই। আর কোনও উপায় নাই। আমি কঠিন কণ্ঠে বলি।
ইয়াসমিন সুটকেসে জামা কাপড় ঠেলে ভরছিল। মা ওর হাত থেকে আমার জামা পাজামা কেড়ে নিয়ে বললেন, এত জামা কাপড় দিতাছস কেন? ও কয়দিনের লাইগা যাইতাছে?
বাবা দেয়ালে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে ছিলেন, বললেন, মাস দুইমাস তো বাইরে থাকতেই হইব।
ছোটদা লম্বা হয়ে শুয়েছিলেন। বললেন, ওর আর জীবনেও আসা হয় কি না দেখেন।
এক মুহূর্তে পরিবেশটাকে কেমন ভূতুড়ে করে ফেলেন ছোটদা।
এইসব কি কয় কামাল? বলে মা জোরে কেঁদে ওঠেন। মাকে সরিয়ে দিয়ে চাপা গলায় বলি, ধুত বোকার মত কান্দো কেন!
নাসরিন এই বাড়ি কিনছে, গাড়ি কিনছে। বাড়িডা মাত্র সাজাইছে বাড়ি ছাইড়া চইলা যাওয়ার লাইগা?
মা, তুমি বুঝতাছো না কেন? আমি কি সারাজীবনের লাইগ্যা যাইতাছি গা নাকি? কয়দিন পরই তো আইয়া পড়াম।
কামাল কইল তোমারে নাকি আর আইতে দিব না। এইসব কী কয় কামাল?
ছোটদা কী জানে? ছোটদা কি আমার চেয়ে বেশি জানে? কয়, আন্দাজি কয়। নরওয়ে আর সুইডেনে আমার অনুষ্ঠান আছে। তাই আমারে বিদেশের সরকাররা সাহায্য করছে বিদেশে যাওয়ার লাইগ্যা। দেশের অবস্থা খারাপ বইলা করছে। দেখতাছো না কি ঘটতাছে! এখন তো হাতের কাছে পাইলে আমারে টুকরা টুকরা কইরা ফেলব। বিদেশের অনুষ্ঠান শেষ হইলে তো চইলা আমার আসতেই হইব।
মা ফুঁপিয়ে ফুপিয়ে বলেন, তহন কি আইতে দিব খালেদা জিয়া?
দিব না কেন? এইটা আমার দেশ না?
তাইলে যে কামাল কয় আইতে নাকি দিব না।
এমনি কয়।
এমনি কয় কেন? কামাল এমনি কইব কেন এইসব কথা। কয় কেন যে জীবনেও আসা হইব না!
আশ্চর্য। এইসব যে কি বোকার মত কর। তোমার মত বোকা আমি আর দেখি নাই।খালেদা জিয়া ত আমারে দেশের বাইরে যাইতে দিতে চায় নাই। দেখ না পাসপোর্ট নিয়া নিছিল? দেখ নাই দেশের সব রাস্তা বন্ধ কইরা দিছিল যেন বাইরে যাইতে না পারি। সরকার তো কখনও চায় নাই আমি বাইরে যাই। এখন বাইরের দেশগুলা বলছে বইলা রাজি হইছে।
কবে আইবা তাইলে?
অনুষ্ঠান শেষ হইলেই আইসা পড়বাম। এরমধ্যে পরিস্থিতি শান্ত হইয়া যাইব। মোল্লারা আর কতদিন চিল্লাইব! সরকার বুইঝা গেছে মোল্লাদেরে উস্কাইলে নিজেদেরই বিপদ হয়। এহন আর উস্কাইব না।
মা শান্ত হন মাত্র কিছৃুক্ষণের জন্য। ছোটদা যখন আবার বলতে শুরু করেন, তরে আর আইতে দিব না। কারণ তুই আইলেই মোল্লারা তর ফাঁসি চাইব, সরকার পতনের আন্দোলন করব। শুনে চিৎকার করে কাঁদতে শুরু করেন মা।
দাদা মেঝেয় পা ছড়িয়ে বসা, বললেন, খালেদা জিয়ার ত আর কোনও উপায় ছিল না নাসরিনরে দেশের বাইরে পাডাইয়া দেওয়া ছাড়া। মোল্লাদেরে একটু কন্ট্রোল কইরা সরকারই অরে নিয়া আইব।
ছোটদা সোজা হয়ে বসে বললেন, তোমারে কইছে নিয়া আইব! আপদ বিদায় করতে পারলে বাঁচে খালেদা। নেক্সট ইলেকশানে আওয়ামী লীগ জিতলে আসার একটা সম্ভাবনা আছে।
আমার মেয়েরে তরা কই পাঠাইতাছস। মেয়ে কই থাকব? কার কাছে থাকব? কি খাইব! কেমনে বাঁচব! বলতে বলতে কাঁদেন মা। মার দিকে কেউ ফিরে তাকায় না। এরা ষড়যন্ত্র কইরা তোমারে দূরে সরাইয়া দিতাছে। তুমি যাইও না। আমার মেয়েরে আমি কোথাও যাইতে দিব না। সুটকেস থেইকা কাপড় বাইর কর।
ছোটদা জোরে ধমকে ওঠেন, কি পাগলামি করতাছেন মা। এইবার থামেন তো!
বাবা আমাকে ফিসফিস করে জিজ্ঞেস করেন, পুলিশ কী কইতে আইছিল?
জিগাইতে আইছিল কার কার বাড়িতে ছিলাম।
কইয়া দিছ?
না।
ভাল করছ।
ছোটদাকে বলি তিনি যেন পুলিশের কোনও চাপেই বলে না দেন যে ঝর বাড়িতে ছিলাম আমি। বাড়ির লোকেরা এক ঝর বাড়ির কথাই জানেন কেবল যে ওখানে ছিলাম। বাড়ির কাউকেই বলিনি আর কোনও নাম, আর কোনও বাড়ির কথা।
সুটকেসের দিকে চোখ পড়তে সুটকেসের কাপড় কিছু আলমারিতে তুলে রাখতে রাখতে বলি, এত কাপড় দিছে যেন মনে হয় ছয় মাসের লাইগা যাইতাছি! এইসব এইখানে যেইভাবে সাজানো আছে, তেমনই থাকুক।