গম্ভীর মুখে মোচঅলা জিজ্ঞেস করলেন— এক জায়গায় ছিলেন নাকি বিভিন্ন জায়গায়?
—বিভিন্ন।
—কোনও বাড়িতে ছিলেন নাকি অন্য কোথাও?
—অন্য কোথাও মানে?
—অন্য কোথাও তো অনেক কিছু হতে পারে। দোকানে, আপিসে, গুদামঘরে।
—না ওসব কোনও জায়গায় ছিলাম না।
—দূতাবাসে ছিলেন?
—না।
—দূতাবাসের কারও বাড়িতে?
—না।
—বিদেশিদের বাড়িতে তো ছিলেন!
—না।
—তবে কি বাঙালিদের বাড়িতে?
—হ্যাঁ।
—কাদের?
—কাদের মানে?
—কাদের মানে কাদের বাড়িতে ছিলেন?
প্রশ্নটি শুনে বড় একটি শ্বাস নিই আমি। মোচহীন বলেন, আসলে আমরা তো জানিই আপনি কাদের বাড়িতে ছিলেন। পুলিশ কী না জানে বলেন!
এই প্রশ্নে নিরুত্তর থাকা আমি মোচহীনের মন্তব্যের বিপরীতে প্রশ্ন করি, জানেনই যখন তখন আর জিজ্ঞেস করছেন কেন?
মোচঅলা বললেন, আপনার মুখ থেকে শুনতে চাই।
কেন শুনতে চান? কী দরকার?
দরকার আছে।
দুজোড়া চোখ আমার মুখে পলকহীন তাকিয়ে আছে। দুটো নাক ঘ্রাণ নিচ্ছে আমার অপ্রস্তুত অবস্থার, দুজোড়া কান খরগোসের কানের মত সজাগ দাঁিড়য়ে আছে। আমি টের পাই জিভ শুকোচ্ছে আমার, জিভের পেছনও শুকোতে শুকোতে নিচে নামছে, গলা, বুক শুকোচ্ছে।
টাইপরা ফর্সা মত মোচঅলা বললেন, আপনি জামিন পাওয়ার পর থেকে যে বিমান বন্দর ঘেরাও করে আছে মৌলবাদীরা, তা তো জানেন।
জানি।
আপনাকে যদি আজকে প্রোটেকশান না দেই, তাহলে কি করে যাবেন বিমানবন্দরে বলেন। একা যাবেন? পুলিশ ছাড়া?
চোখের সামনে আবছা আলোটুকু হঠাৎ মুছে যায়। যেন ঘুরঘুট্টি অন্ধকারের মধ্যে একা বসে আছি। কোনও নামের একটি অক্ষরও তুই উচ্চারণ করিস না, ভেতরের আমিটি বাইরের আমিকে বলছে।
লাল শার্ট এবার শক্ত কণ্ঠে বলেন, নামগুলা বলেন, যাদের বাড়িতে ছিলেন।
কিছুক্ষণ চুপ থেকে বললেন, না বললে তো আপনার ক্ষতি। আপনি কি চান আপনার ক্ষতি হোক?
অন্ধকারর ভেতর থেকে একটি শান্ত কন্ঠ ভেসে আসে, নিজেই চমকে উঠি কন্ঠটি শুনে। না।
না?
আমার এই স্পর্ধা দেখে চারটে ছানাবড়া চোখ পরষ্পরকে দেখে।
অন্ধকার সরিয়ে আমি তখন একটু আলোর জন্য মরিয়া হয়ে জানালা দরজা খুঁজছি। আমার চোখ অন্ধ হয়ে আসছে, খোলা চোখ, যেন বুজে আছি এমন একটি বোধ। −বাঁ বোঁ করে ঘুরছে কেবল মাথা নয়, জগত। মোচহীন, মোচঅলা পর পর বলে চলছেন, তাহলে আপনি আপনার ক্ষতিই চাইছেন। তাহলে আপনি চাইছেন না বিমান বন্দরে আপনার কোনও নিরাপত্তা? তাহলে আপনি ভেবেই নিয়েছেন যে আপনি নিরস্ত্র হয়ে সশস্ত্র লোকগুলোর হাত থেকে বাঁচবেন? আমরা সময় দিচ্ছি আপনাকে, আপনি ভেবে দেখেন কি হবে আপনার, যখন আপনি বিমান বন্দরে পৌছবেন, আর আপনাকে ঘিরে ধরবে মোল্লারা!
লাল শার্টের চোখে পাথুরে দুটো চোখ রেখে বললাম, আপনাকে যদি জীবনের ঝুঁকি নিয়ে কিছু মানুষ আশ্রয় দিত আপনার খুব বিপদের দিনে, মৃত্যুর হাত থেকে বাঁচাতে প্রাণপণ চেষ্টা করেছে যারা, তাদের কি বিপদে ফেলবেন আপনি? ঠিক আমার অবস্থা যদি হত আপনার, আপনি কি ওদের কারও নাম বলতে পারতেন?
লালশার্টের ঠোঁটে বাঁকা একটি হাসি। টাইপরা লোকটি নড়ে চড়ে বসে বললেন, গম্ভীর গলায়, আপনার জীবন কি এখন বিপদমুক্ত আপনি ভাবছেন?
লাল শার্ট বাঁকা হাসিটি মিলিয়ে ফেলে বললেন, এখনও কিন্তু আপনি দেশের ভেতর।
সে আমি জানি। কিন্তু আমি কারও নাম বলব না।
নাম না বললে আপনাকে বিমানবন্দরে একা যেতে হবে। পুলিশ যাচ্ছে না আপনার সঙ্গে।
এ কথার পর তিনটি প্রাণী অতল এক নৈঃশ−ব্দ্যর মধ্যে বসে থাকি। একসময় সেই নৈঃশব্দ্য থেকে উঠে এক গেলাস জল খেতে হয় আমাকে। লক্ষ্য করি গেলাসে ধরা হাতটি আমার কাঁপছে। ভেতরের ঘরে বাবা বসে আছেন, চোখদুটোয় ঔৎসুক্য লাফাচ্ছে পুলিশের সঙ্গে আমার কি কথা হচ্ছে জানতে। আমি ইঙ্গিতে তাঁর চোখদুটোকে শান্ত হতে বললাম, তাঁকেও।
জল লালশার্টও চাইলেন। বাবা আর ঘরে বসে থাকতে পারেননি, উঠে এসে পুলিশদের ভাঙা গলায় জিজ্ঞেস করলেন চা খাবেন? বলে তিনি আর অপেক্ষা করলেন না জানতে চা এঁরা খাবেন কি না, মিনুকে পাঠালেন রান্নাঘরে চা করার জন্য। মিনু চা নিয়ে আসার আগ পর্যন্ত তিনটি প্রাণী আবারও নৈশ−ব্দ্যর ভেতরে সাঁতার কাটছিলাম। চায়ে চুমুক দিয়ে টাই পরা প্রথম বললেন, তাহলে কি আপনি কি নাম বলবেন না? কিছু নামের জন্য নিজের এত বড় ক্ষতি করবেন আপনি?
কেবল নাম হলে তো কথাই ছিল। নামের আড়ালে তো মানুষ আছে।
তাতে আপনার কি? আপনি তো নিজের দিকটা দেখবেন। যে শর্তে আপনার সুবিধা হয় তা নিয়ে ভাববেন।
নামগুলো জানা আপনাদের দরকার কেন?
এমনি। জাস্ট কিউরিওসিটি। আমরা তো তাদের আর কোনও ক্ষতি করতে যাবো না। প্রশ্নই ওঠে না।
তাহলে আর জানতে চাওয়া কেন?
বললাম তো কৌতূহল।
আপনারা তো বলেছেন তাদের নাম আপনারা জানেন।
জানি কিছু। বাকিটা আপনি বললে ভাল হয়।
না। আমি বলব না।
তাদের কোনওরকম ক্ষতি হবে না, কথা দিচ্ছি। কেবল আমরা দুজন জানব, আর কেউ না।
আমার পক্ষে সম্ভব না কারও নাম বলা।
আপনার ক্ষতি হলেও না?
আমি চায়ে চুমুক দিয়ে স্পষ্ট স্বরে বললাম, না।
ভেবে বলছেন?
ভেবেই বলেছি।
ভাবার জন্য আরও সময় নেবেন?
না।
বলে আমি লক্ষ্য করি আমার হাত আর কাঁপছে না যখন চায়ের কাপটি আমার হাতে। লোকদুটো চা শেষ করেননি। দুটো কি তিনটি চুমুকের পর উঠে পড়লেন। আমি বসে থাকি, পুলিশ কি আমাকে বিমান বন্দরে তাহলে নিয়ে যাবেন না! এরকম কি হতে পারে না যে আমি যাবো না! পুলিশ আসেনি, তাই আমার যাওয়া হয়নি। এই ফাঁকিটি কি আমি এখন দিতে পারি না! নিশ্চয়ই পারি। জামিন আমাকে যদি এই শর্তেই দেওয়া হয়ে থাকে যে আমাকে দেশ ছাড়তে হবে, না হয় হয়েছে দেওয়া। কিন্তু আমি যদি বেঁকে বসি, যদি বলি যে যাবো না দেশ ছেড়ে, তবে কি আমার জামিন ফেরত নেওয়া হবে! ক বলেছিলেন, আমাকে সরকার যা খুশি করতে পারে, জেলে ভরতে পারে। আমি দেশে থাকলে মৌলবাদীদের আন্দোলন এমন তীব্র হবে যে আমাকে বাঁচাতে তখন আর কেউ পারবে না। না এ দেশ, না অন্য কোনও দেশ। অন্তত আন্দোলনের তীব্রতা কমাতে এ দেশের স্বার্থে আমাকে পাড়ি দিতে হবে আপাতত অন্য দেশে। তারপর ঘরের মেয়ে তো ঘরে ফিরে আসবই। একদিন না হয় একদিন। মাথাটি ছিঁড়ে যেতে থাকে। কোনও ভাবনা আর ধরে না। শরীরে শক্তি নেই যে উঠে দাঁড়াবো। আমাকে তাড়িয়ে দেওয়া যদি সরকারি সিদ্ধান্ত হয়ে থাকে, এটি তো জানি সরকারি সিদ্ধান্তই, তবে তো পুলিশ আমাকে নিরাপত্তা দেবেই আজ রাতে। নিয়ে আমাকে যাবেই বিমান বন্দরে। আর তা যদি না হয়, তবে পুলিশ ছাড়াই যাবো বন্দরে, যা হয় হবে।