—আমার আত্মীয়রা আছে। এরা আমাকে ভালবাসে।
—ভালবাসে ঠিক কথা। কিন্তু তাদের ভালবাসাই কি তোমার জন্য যথেষ্ট! তুমি এখন সাধারণ একজন মানুষ নও যে, আত্মীয়দের ভালবাসা আর সমর্থন দিয়েই একশ একটা বিপদ থেকে তুমি রক্ষা পাবে। মৃত্যুর ফাঁদ থেকে বাঁচবে। তোমার আত্মীয়রা খুব নিরীহ মানুষ। তাদের কোনও শক্তি নেই। তারা তোমার চেয়েও নিরীহ। বেঁচে থাকতে চাইলে চলে যাও, বেঁচে থাকলে তুমি লিখতে পারবে, জীবনে যা ইচ্ছে তা করার সুযোগ পাবে।
—নাহয় হাইডিংএ থাকার সময় ডেসপারেটলি ভেবেওছিলাম বিদেশে চলে যাওয়ার কথা। কিন্তু এখন এই যাওয়াটা, বিদেশে গিয়ে পড়ে থাকাটা কি রকম যেন অদ্ভুত লাগছে। কোনও মানে হয় না। কেউ আমাকে ঠিক করে বলছেও না কবে ফিরবো।
—ফেরার কথা ভাবার সময় নেই। পরের কথা পরে ভেবো। আগে বাঁচো তো। মনে রেখো আজ যদি বিদেশিরা তোমাকে সাহায্য না করত, তুমি এ দেশে বেঁচে থাকতে পারতে না। তোমার এত সমর্থক এ দেশে হয়নি যে এ দেশে থাকার সাহস তুমি কর। ওই হাতে গোনা কজন দিয়ে কিছু হবে না। তোমার বন্ধুর চেয়ে শষনুর সংখ্যা অনেক বেশি। এক লক্ষ শষনু যদি থাকে, একজন তবে বন্ধু। এভাবে হিসেব করো। এ দেশে তুমি বাঁচার আশা কি করে করো! তোমার আত্মীয় স্বজনের কোনও ক্ষমতা নেই তোমাকে বাঁচাবার। ওরা তোমার আত্মীয় বলে ওদেরও বিপদ অনেক। তুমি চলে গিয়ে ওদেরও বাঁচাও।
—কিন্তু..
—কিন্তু কি!
—সময় তো জানি সব আবার ঠিক করে দেয়। হয়ত কদিন পর পরিস্থিতি আবার স্বাভাবিক হয়ে উঠবে। প্রাণনাশের হুমকি কি আমার জীবনে এই প্রথম? সেই কবে থেকেই তো!
—না যাও। সরকার তোমাকে ঠেলে বের করবে। আজ না যাও, কাল যেতে হবে। কাল না যাও পরশু যেতেই হবে। এটা তোমার সিদ্ধান্ত নয়। এটা সরকারি সিদ্ধান্ত।
—এই সরকার তো আমার শষনু। এই সরকার কি আমাকে বাঁচাতে চাইছে!
—তোমাকে বাঁচাতে চাইছে না। নিজে বাঁচতে চাইছে। দেশের সরকার বিরোধী মৌলবাদী আন্দোলনে ভাটা পড়ুক চাইছে, বিদেশের দুর্নাম বন্ধ করতে চাইছে।
—আমার কি অন্য কোনও উপায় নেই?
—না।
—কোনও উপায়ই নেই?
—না।
অনেকক্ষণ বসে থাকি একা একা। মাথা ঘোরে, ঘোরে আমার এই প্রিয় ঘরটির সবকিছু। লেখার টেবিল। চারপাশের বইভর্তি বইয়ের তাক। ঘোরে না শেষ করা বিস্তর লেখা, ঘোরে স্তূপ স্তূপ লেখার কাগজ, ঘোরে দেয়ালে টাঙানো আমার প্রিয় তেলচিত্রগুলো, ছবিগুলো, ঘোরে পুরস্কারের পদক, ঘোরে জানালার ভারী সবুজ পর্দা। এই ঘরে দিনের পর দিন কেটেছে আমার লেখায়, পড়ায়। এই ঘরটি ছেড়ে চলে যেতে হবে আমাকে! আমার সব তো এখানে। আমার জীবনটিই এখানে, আমার সব স্বপ্নই এখানে। সমস্ত স্বপ্নই। ঘুরতে থাকে আমার এই জগত। লাটিমের মত ঘোরে। চাই না, তবু রাত নেমে আসে। হু হু করে রাত বেড়ে চলে। রাত তখনও তত গভীর নয়, যতটা গভীর হলে আমার বিমান-বন্দরে যাওয়ার কথা। তখনই বিশেষ পুলিশ বাহিনীর উμচ পদস্থ দুজন কমকর্তা আমার সঙ্গে জরুরি কিছু কথা বলার জন্য বাড়িতে ঢোকেন। বাড়িতে ঢোকেন পরিচয় পত্র দেখিয়ে, কারণ বিশেষ পুলিশ বাহিনীর পরনে কোনও নীল বা খাকি পোশাক থাকে না। একজন লাল শার্ট, মোটামত, আরেকজন টাই পরা, মোচঅলা। যখন কথা বলবেন, বললেন আর কারও সামনে থাকা চলবে না। বৈঠকঘরে আলো আঁধারিতে বসে তাঁরা আমার সঙ্গে দুএকটি অজরুরি কথা বলেন প্রথম। তারপর বলেন আজ রাত দেড়টা থেকেই তাঁরা নিচে পুলিশের গাড়িতে থাকবেন। তারপর যা গরম পড়েছে আজ এমন একটি সহজ কথা বলার মত বললেন একজন, কোথায় ছিলেন দুমাস?
ছিলাম।
ছিলেন তো জানিই, কোথায় ছিলেন?
আমি খানিকটা দম নিয়ে বলি, লুকিয়ে ছিলাম সে তো জানেন।
আরেকজন বললেন, হেসে, পুলিশ বাহিনীকে তো হয়রান করে ছেড়েছেন। সারা দেশ তন্ন তন্ন করে খুঁজেও আপনাকে পাওয়া যায় নাই। লুকিয়ে যে ছিলেন সে তো সবাই জানে, কিন্তু কোথায়?
আমি ম্লান হাসি।
মোচঅলা লোকটি বলেন, ভয় পান নাই লুকিয়ে থাকার সময়?
পাবো না কেন? বেঁচে ফিরব, এমনই তো ভাবিনি কোনওদিন।
মোচহীন লাল শার্ট লোকটি হঠাৎ কাচের দরজা ঠেলে বারান্দায় যান। বারান্দা থেকেই বললেন, ওদিকে কিছু লোক মনে হয় জটলা করছে।
হাতের রেডিওতে রাস্তার পাহারা পুলিশদের জানালেন জটলা কেন খবর নিতে। বারান্দা থেকে ফিরে এসে সোফায় বসে উদ্বিগ্ন মুখ চোখ, বললেন, আপনি ভয় পাবেন না, আমরা সব ব্যবস্থা করছি।
টাইপরা মোচঅলা বললেন, আমাদের লোক বিমানবন্দরের রাস্তায় দাঁড়িয়ে আছে। সন্দেহজনক লোকদের কোথাও জড়ো হতে দিচ্ছে না। যে করেই হোক যে কোনও রকম ঘেরাও ঠেকাবো আমরা।
মোটামত লাল শার্ট বললেন, ঠিক আড়াইটায় আপনার গাড়ি যেন বের হয়। আপনার গাড়ির ঠিক পেছনেই আমাদের গাড়ি থাকবে।
এসব আমার জানা। আমি বসে থাকি জরুরি কথাটি শোনার জন্য।
ফর্সা মত টাইপরা বললেন, দুমাস কি ঢাকায় ছিলেন নাকি ঢাকার বাইরে?
ঢাকাতেই ছিলাম।
ঢাকাতেই? আশ্চর্য।
আশ্চর্য কেন?
আমাদের চোখে ধুলো দিয়ে কি করে এতদিন ঢাকায় ছিলেন, তাই ভাবছি।
আমি আবারও ম্লান হাসি। ভাবি, এই এরাঁই আমাকে সারা দেশ পাতি পাতি করে খুঁজেছেন গ্রেফতার করার জন্য, আর এঁরাই এখন আমাকে নিরাপত্তা দিচ্ছেন। এঁরা কি পাল্টে গেছেন? না। এঁরা এঁরাই আছেন, কেবল সরকারি হুকুম পাল্টেছে। এঁরা মিষ্টি মিষ্টি কথা বলছেন এখন, হুকুম এলে এই এঁরাই বুটের লাথি লাগাতে পারেন পিঠে। হুকুম এলে এঁরাই আমাকে গ্রেফতার করে কালো গাড়িতে তুলে জেলে ভরতে পারেন।