ভাঙা গলা আবার, এই যে মৌলবাদ বিরোধী আন্দোলন হচ্ছে, এতে কি কোনও লাভ হবে না! এই আন্দোলনে হয়ত মৌলবাদী দল হেরে যাবে। হয়ত তারা আর..
ক চাপা গলায় ধমক দেন, আপনার এইসব রোমান্টিকতা ছাড়ুন তো। মৌলবাদ বিরোধী আন্দোলন কিছুই করতে পারছে না। সব দল মিলে রাস্তায় নামলেও মৌলবাদীদের ঠেকানো এখন সম্ভব নয়।
তাহলে কি কোনও আশা নেই?
জানি না আদৌ কোনও আশা আছে কি না।
দেশের কী হবে?
দেশের কি হবে, আপাতত সে কথা নিরাপদ দূরত্বে গিয়ে ভাবুন।
ক চলে যান আমাকে বিদায়ের আলিঙ্গন করে। পাথরের গালে দুটো শুষ্ক চুম্বন পড়ে।
বাবা এগিয়ে এলেন পাথরের কাছে। টোকা দিলেন। টোকায় পাথরে কোনও শব্দ হয় না। অনেকক্ষণ পর পাথুরে কণ্ঠ থেকে বেরোয়, কালকেই চইলা যাইতে হইব।
কালকেই! বাবা থ হয়ে গেলেন। বাড়ির সবাই খবরটি শুনে চুপ হয়ে গেলেন। কোলাহলে মুখর বাড়িটি মুহূর্তের মধ্যে স্তব্ধ হয়ে যায়। যেন কেউ মারা গেছে আজ। খুব আপন কেউ হঠাৎ মারা গেছে।
ফরিদ হোসেন দুদিন ধরে চেষ্টা করছেন বাড়িতে ঢুকতে। পারেননি। আজ ঢুকে আমার লিখে রাখা উত্তরপত্রটি নিয়ে যান। তাঁর অনেকগুলো প্রশ্নের মধ্যে একটি প্রশ্ন ছিল, এখন কি দেশ ছাড়ার কথা ভাবছেন নাকি দেশেই থাকবেন? আমার উত্তর ছিল, দেশে থাকব। যা কিছুই ঘটুক, কখনও দেশ ছাড়ব না। এ দেশ আমার। আমার দেশটিকে আমি খুব ভালবাসি। ফরিদ হোসেন উত্তরপত্রটি হাতে নিয়ে খুব খুশি হয়ে যখন বেরিয়ে যাচ্ছেন, জানেন না ভেতরের ঘরে তখন একটি সবুজ সুটকেসে আমার কাপড় চোপড় ভরা হচ্ছে। সুটকেসটি বাড়ির প্রায় সবাই গুছিয়ে দিচ্ছে। আমার কোনও আগ্রহ নেই সুটকেসে, মারও নেই। সুটকেসের দিকে তাকিয়ে মা থেকে থেকে বিনিয়ে বিনিয়ে নয়, হাউমাউ করে কাঁদেন। কোথায় যাচ্ছে তাঁর মেয়ে, কবে ফিরবে মেয়ে, মা তার কিছুই জানেন না। আশঙ্কায় কাঁদেন তিনি।
পাথর হয়ে বসে থাকলে চলবে না। দ্রুত কিছু কাজ সারতে হবে। আমার অনুপস্থিতিতে মামলা চলতে হলে কিছু কাগজে আমার সইএর দরকার আছে। সারা হোসেন নিজে এসে পাওয়ার অব এটর্নির অনেকগুলো কাগজে আমার সই নিয়ে গেছেন। নিয়মিত সারার সঙ্গে যোগাযোগ রাখতে দাদাদের বলি। টাকা পয়সা যা দরকার হয়, সব যেন দেওয়া হয়। ছোটদা আমার ব্যাংক থেকে তুলতে পারবেন আমার টাকা পয়সা।
ছোটদা হেসে বলেন, কামাল হোসেন তো তর কেইসের জন্য কোনও টাকা নেয় নাই। দলিলপত্র টাইপ করা আর ফটোকপি করার জন্য যা লাগছে খালি। এমনিতে কামাল হোসেনের সাথে শুধু কথা কওয়ার ফিই হইল এক লাখ টাকা।
ছোটদা বউ বাচ্চা নিয়ে আমেরিকা পাড়ি দেবার স্বপ্ন দেখছেন। তাঁকে অনুরোধ করি যেন তিনি না যান, যেন দেশে থাকেন। আমি ফিরে আসব। সবাই আমরা একসঙ্গে থাকব। যেন আমাদের সংসারটিকে তিনি চলে গিয়ে ভেঙে না দেন। ইয়াসমিনের কোনও চাকরি নেই। বলি ব্যাংকে যে টাকা রেখে গিয়েছি, তা দিয়ে যেন চালাতে থাকে। আমি ফিরে এসে তার জন্য ভাল একটি চাকরি যোগাড় করে দেব। মিলনের আদমজির কাজটি পোষাচ্ছে না, তাকেও বলি অপেক্ষা করতে আমার জন্য। কিছু একটা নিশ্চয়ই করব আমি। রাতে ভাই বোনের সঙ্গে গায়ে গা লাগিয়ে শুয়ে থাকি। ইচ্ছে করে হাজার বছর এভাবেই কেটে যাক, এভাবেই পরস্পরের প্রতি পরম মমতায়, এভাবেই গভীর ভালবাসায় পাশাপাশি,এভাবেই আনন্দে, এভাবেই মায়া মমতায়। কতদিন আমরা এরকম এক বাড়িতে সবাই এক হইনি। ঈদের দিনের মত লাগে। ইচ্ছে করে ঈদ লেগে থাকুক জীবনে প্রতিদিনই। হা ঈদ। সারারাত মা কাঁদেন। সারারাত জেগে জেগে মার কান্না শুনি।
৪. দেশান্তর – ৩
আগামীকাল এসে যায়। দিন পার হয়ে যায় মুহূর্তের মধ্যে। মা আমাকে পাঁচবেলা মুখে তুলে খাওয়াচ্ছেন। যা যা খেতে ভালবাসি, নিজে হাতে রান্না করেছেন। আমি খানিকটা অবসর পেতে চাই, দাদা আর বাবার রাজনীতির আলাপ থেকে সরে এসে একা হতে চাই। লেখার ঘরটিতে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিই ভেতর থেকে। হাতে টিকিটটি নিয়ে বসি, এখন আমার হাতে সব ক্ষমতা। ইচ্ছে করলে এটি আমি এখন ছিঁড়ে ফেলতে পারি। এখন আমি ইচ্ছে করলেই বলতে পারি আমি কোথাও যাবো না। টিকিটটিকে নাড়াতে থাকি হাতে, দ্রুত, খুব দ্রুত। যেন হাতপাখা এটি। ছিঁড়বো কি ছিঁড়বো না অবস্থায় বার বার বলি নিজেকে, টিকিট হাতে আছে বলেই বুঝি যেতে হবে, ছিঁড়ে ফেললেই তো হয়, ছিঁড়ে ফেল, তুমি যেও না কোথাও, যেও না। কিন্তু অদৃশ্য কে যেন আমার দেশ ছাড়তে না চাওয়ার বাসনার কথা জেনে হেসে ওঠে, হাসতে হাসতে বলে, —তুমি কেন থাকবে এ দেশে? তোমার এই বিপদের সময় কি তোমার বোঝা হয়নি কটি লোক তোমাকে সমর্থন করে! এখনও কি বোধ হয়নি! কী ভরসায় থাকবে এ দেশে!
—কেন আমাকে ভরসা করতেই হবে?
—করতেই হবে কারণ তোমাকে হত্যার জন্য লক্ষ লোকের জমায়েত হয় এই দেশে। ভরসা তো করেছিলে, লুকিয়ে যখন থেকেছিলে! তুমি কি ভেবেছো, জামিন পেয়েছো বলে তোমার সব সমস্যা এখন শেষ হয়ে গেছে! প্রতিদিন নানারকম বিপদের সামনে পড়তেই হবে তোমাকে, তখন কার ওপর ভরসা করবে?
—কেন, আমাকে যারা আশ্রয় দিল! তারা তো আমার পাশে দাঁড়িয়েছে! শামসুর রাহমান, কবীর চৌধুরী.. আমাকে সমর্থন করেন।
—কজন? হাতে গোনো। হাতে গোনো, ক, খ, গ, ঘ, ঙ, করে গোনা। হাতের কড়াগুলো তবুও তোমার বাকি থেকে যাবে, এ দেশে লোক আছে বারো কোটি। বারো কোটির মধ্যে কজন তোমার পক্ষে! কেন এ দেশে থাকবে তুমি! তোমার অভিমান হয় না! এ দেশে তুমি থাকতে চাও কেন?