স্তূপ হয়ে থাকা চিঠিগুলো পড়তে ইচ্ছে করে না। চিঠিগুলো হয়ত জরুরি চিঠি। কিন্তু জরুরি চিঠি পড়ার চেয়েও বাড়ির সবার সঙ্গে আড্ডা দিতে গল্প করতে হোক না আজাইরা গল্প, ভাল লাগে বেশি। ইচ্ছে না হলেও কিছু চিঠি খুলি গল্পের অবসরে। হিউম্যান রাইটস ওয়াচ নামে যুক্তরাষ্ট্রের একটি মানবাধিকার সংগঠন আমাকে একটি গ্রান্ট পাঠিয়েছে, হেলমেন হেমেট গ্রান্ট। সরাসরি আমার ব্যাংক একাউণ্টেই পাঠিয়ে দিয়েছে ছ হাজার ডলার। হিউম্যান রাইটস ওয়াচের একটি চিঠিতে এই খবরটিই পেলাম। প্রতিবছর এই সংগঠনটি মানবাধিকারের জন্য যারা লড়াই করছে, তাদের জন্য এরকম একটি গ্র্যাণ্টের ব্যবস্থা করে। এর মধ্যে ব্যাংকে পৌঁছে গেছে ফরাসি প্রকাশক ক্রিশ্চান বেস এর পাঠানো দ্বিতীয় কিস্তির টাকা। অর্থনৈতিক মেরুদণ্ডটি এবার তাহলে জোড়া লাগল।
পুরোনো বন্ধুরা আমার কাছ থেকে দূরে সরলেও আমার নতুন বন্ধুরা আমাকে দূরে সরিয়ে দেন না। ঝ চলে আসেন পিস্তল নিয়ে আমার নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে। পুলিশে তাঁর বিশ্বাস নেই। ঝকে বলি যে আমি খুব নিরাপদ বোধ করছি, এত নিরাপদ আমি আর আগে কখনও বোধ করিনি। আমাকে ঘিরে আমার পরিবারের সদস্যরা আছে, তাদের কারও কাছে পিস্তল নেই, বন্দুক নেই, কিছু নেই। তাদের ভালবাসাই আমাকে নিরাপত্তা দিচ্ছে। ভালবাসা যে কোনও মারণাস্ত্রের চেয়ে বেশি নিরাপত্তা দিতে পারে, তা আমি সমস্ত অন্তর দিয়ে অনুভব করি। যদি মৃত্যু হয় এ বাড়িতে এখন আমার, আমার মার কোলে, মার চোখের জল আমার কপালে টুপ টুপ করে পড়বে, ইয়াসমিন আমার বুকের ওপর মাথা রেখে চিৎকার করে কাঁদবে, বাবা আমার হাত শক্ত করে ধরে রাখবেন, আমার মুখের ওপর ঝুঁকে থাকবেন আমার দাদা আর ছোটদা, সুহৃদ আমার কোলের ওপর পড়ে ফুঁপিয়ে কাঁদবে দোলফুপু দোলফুপু বলে, এমন সময় যদি জানি আমার মৃত্যু হচ্ছে, আমার কি দুঃখ হবে? দুঃখ হবে না। ভালবাসা ঘিরে থাকলে মৃত্যুতে কোনও দুঃখ হয় না। আমার এই ঘরের মানুষদের ভালবাসা লক্ষ লক্ষ মোল্লাদের ঘৃণার চেয়ে তীব্র। আমি অনেক কিছু না পেয়েও কেবল সত্যিকার কিছু ভালবাসা পেয়ে তৃপ্ত।
৪. দেশান্তর – ২
দিন যায়। প্রতিদিন সকাল বিকাল মিছিল যায় সামনের রাস্তা দিয়ে। বিশাল বিশাল ব্যানার হাতে মিছিল, তসলিমার ফাঁসি চাই। স্লোগানে কাঁপছে এলাকা, তসলিমার ফাঁসি চাই, দিতে হবে। পঞ্চাশ হাজার, সত্তর হাজার লোকের মিছিল প্রতিদিন। মিছিলের শব্দ শুনলেই বাড়ির মানুষগুলো, জানালার পর্দা সরিয়ে উঁকি দেয় রাস্তায়। মা বলেন, এরা তো সত্যিকার ধার্মিক না। ধার্মিকরা কাউরে মাইরা ফেলতে চায় না। টুপি পিনলে আর দাড়ি রাখলেই ধার্মিক হওয়া যায় না।
আমি হাসতে হাসতে বলি, এরা তাইলে কি?
এরা খারাপ লোক। খারাপ লোকেরা রাস্তায় নামছে খারাপ উদ্দেশ্য নিয়া। সব ঠিক হইয়া যাইব, তুমি শুধু বইলা দিবা যে ধর্ম নিয়া আর কিছু লিখবা না।
ঘড়ির কাঁটা এগোয়। খুব দ্রুত। সমস্ত শক্তি দিয়ে কাঁটাটিকে আমার থামাতে ইচ্ছে করে। দিন লাফিয়ে লাফিয়ে রাতের দিকে যেতে থাকে। রাতগুলো বিকট দৈত্যের মত অন্ধকারকে ছিঁড়ে টুকরো করে সূর্যের আগুনের দিকে ছুঁড়ে দেয়। আমি থামাতে পারি না কিছুই। ক আসেন হঠাৎ এক রাতে। সোজা আমার লেখার ঘরটিতে ঢুকে দরজা বন্ধ করে আমার মুখোমুখি বসেন। হাতে গুঁজে দেন আমার পাসপোর্টটি আর একটি টিকিট। পাসপোর্টে নরওয়ের আর সুইডেনের ভিসা। টিকিট সুইডেন যাওয়ার। সুইডিশ সরকারের পাঠানো। গভীর রাতের বিমান, ব্যাংকক হয়ে, আমস্টারডাম হয়ে স্টকহোম। ক বললেন এ ছাড়া আর কোনও পথ নেই। এটিই একমাত্র বাঁচার পথ। এটিই সরকারি সিদ্ধান্ত। জামিনের অলিখিত শর্ত। বিদেশের পরামর্শ। সে রাতে, যে রাতে আমাকে যেতে হবে, আমার বাড়িতে গভীর রাতে পুলিশের একটি বিশেষ বাহিনী এসে থামবে, কড়া নিরাপত্তা দিয়ে আমাকে নিয়ে যাবে বন্দরে। বন্দরে সুইডেনের রাষ্ট্রদূত থাকবেন, দেখা হতেও পারে, নাও হতে পারে। বিমান বন্দরে আমি ঙকে দেখতে পাবো, ঙও যাচ্ছেন আমার সঙ্গে পুরো পথ। ব্যাংকক বন্দরে আমার জন্য অপেক্ষা করতে থাকবেন সুইডিশ পররাষ্ট্রমন্ত্রণালয়ের লোক। আমি পৌঁছোতেই সুইডিশ নিরাপত্তা বাহিনীর প্রধান আমাকে তাঁর দায়িত্বে নিয়ে নেবেন। হাতে পাসপোর্ট আর টিকিট নিয়ে বিমূঢ় বসে থাকি। ক বললেন, দেশে এক মুহূর্তের নিরাপত্তা নেই। যত শীঘ্র সম্ভব দেশ ত্যাগ করতে হবে, দিনের বেলায় ত্যাগ করা সম্ভব নয়, বিমান বন্দর ঘেরাও করে রেখেছে মৌলবাদীরা। এক আগামিকালই পাওয়া গেছে গভীর রাতের যাত্রা। সে সুযোগটিই নিতে হবে।
কবে ফিরব? ককে জিজ্ঞেস করি।
ক আমার প্রশ্ন শুনে চুপ হয়ে যান। করুণ চোখে আমার দিকে তাকিয়ে বলেন, আপাতত তো যান। তারপর গিয়ে ভাবুন কবে ফিরবেন। সবই নির্ভর করছে দেশের অবস্থার ওপর। এখন যে অবস্থা এই সময় আপনার অন্য কিছু না চিন্তা করে সোজা দেশ ছাড়া উচিত। আপনার ভাগ্য ভাল যে আপনার এই সুযোগ হয়েছে।
যেতেই হবে? ভাঙা কণ্ঠ আমার।
হ্যাঁ, যেতেই হবে।
না গেলে কী হবে?
সরকার এই শর্তেই জামিন দিয়েছে।
সে জানি, কিন্তু শর্ত যদি না মানি!
শর্ত না মানলে কি হবে একটু আন্দাজ করতে পারছেন না কি? আশ্চর্য। মৌলাবাদীদের হাতে খুন হবেন। সরকার নিরাপত্তা দেবে না। জেলে পাঠাবে। জেলে কোনও নিরাপত্তা নেই আপনার। বাঁচতে চাইলে দেশ ছাড়ুন।