বৈঠকঘরের কার্পেটে বিছানার চাদর বিছিয়ে ঘুমোয় সবাই। বালিশ বেশি নেই বলে সোফার গদিগুলোকেই মাথার বালিশ হিসেবে ব্যবহার করে। এতে কারও কোনও অতৃপ্তি নেই। মনে সুখ থাকলে লোকে বলে গাছের তলাতেও আরামে ঘুমোনো যায়। আমার জন্য আমার শোবার ঘরটির পুরু গদির বিছানা, কিন্তু রাতে আমি আমার বিছানা ছেড়ে ভাই বোনদের মধ্যিখানে এসে শুই, এই আনন্দ ওই আরামের বিছানায় একা শোয়ার আনন্দের চেয়ে অনেক বেশি। লেখালেখিতে মগ্ন থেকে আমি কোনওদিন ফিরে তাকাইনি কারও দিকে। আজ ফিরে তাকাচ্ছি। দেখতে পাচ্ছি সবাই আমাকে ভীষণ ভালবাসে। কোনওদিন বুঝিনি কেউ যে ভালবাসে। না, এই ভালবাসাকে কোনওদিন জানতে চাইনি, অবজ্ঞা করেছি, আমার জীবন আমার বলে সরে থেকেছি।
বাড়ির সকালটা কাটে পত্রিকার ওপর ঝুঁকে থাকায়। দাদা, ছোটদা, বাবা, ইয়াসমিন আর মিলন, গীতা, হাসিনা বৃত্ত হয়ে বসে যায়। একজন পড়ে, সকলে শোনে। হাইকোর্টে জামিন পেলেন তসলিমা নাসরিন, হাইকোর্টে যেভাবে এলেন, যেভাবে গেলেন-এর পুঙ্খানুপুঙ্খ বর্ণনা, আদালত প্রাঙ্গনে যে অভূতপূর্ব নিরাপত্তার আয়োজন ছিল সকাল থেকে তার আদ্যোপান্ত, এখন যে আমার শান্তিনগরের বাড়িতে কেউ নেই, দরজায় তালা ঝুলছে, আদালত থেকে বাড়ি ফিরে বিকেলের মধ্যে আবার আত্মগোপন করতে চলে গেছি এসব খবর; এই খবরটিই সাংবাদিকদের কাছে বিশ্বাসযোগ্য মনে হচ্ছে কারণ তাঁরা মনে করছেন জীবনের ঝুঁকি নিয়ে নিজের বাড়িতে এ সময় কোনও বোকাও থাকবে না। বাড়ির ঠিকানাটি তো বড় বড় করে সব পত্রিকায় ছাপা হয়েছে, মোল্লাদের যে কোনও একজনই যথেষ্ট বাড়িতে এসে নির্বিবাদে আমার গলাটি কেটে নেওয়া। সম্পাদকীয়, উপসম্পাদকীয় কিছুই নজর থেকে বাদ পড়ছে না কারওরই। আমি সামনে দাঁড়াতেই পত্রিকা থেকে মুখ তুলে দাদা বলেন, কালকে জামিন হওয়ার পর বিবিসি থেকে সাক্ষাৎকার নিছে অনেকের, ডঃ কামাল হোসেন বলছেন, আজকের ঘটনায় আমরা ভরসা পাচ্ছি যে দেশে আইনের শাসন আছে। সুপ্রিম কোর্ট যেভাবে জামিন দিয়েছে, তাতে একজন ব্যক্তি যে আইনের নিরাপত্তা পেতে পারে তা প্রমাণিত হয়েছে। উগ্রপন্থীরা এমন একটা অবস্থার সৃষ্টি করেছিল যাতে মানুষ কোর্টে এসে আইনের আশ্রয় নিতে পারে। তুই হাইকোর্টে গিয়া জামিন পাইছস, হাইকোর্ট থেইকা অনুমতি দিছে সিএমএম কোর্টে তর অনুপস্থিতিতে তর উকিলরা হাজিরা দিতে পারবে। সুপ্রিম কোর্টের যে স্বাধীনতা আছে তা প্রমানিত হইছে। তারপর ভয়েস অব আমেরিকাতেও সারা হোসেন সাক্ষাৎকার দিছে, বলছে তর বিরুদ্ধে মামলা করার পর পরিস্থিতি এমন ছিল বলছে যে তর পক্ষে কথা কওয়াও যেন অন্যায় ছিল, তর পক্ষে ওকালতি করাটাও যেন অপরাধ ছিল। কিন্তু হাইকোর্টের রায়টারে বলছে যে এত সহজে বিচার ব্যবস্থাকে মৌলবাদীরা প্রভাবিত করতে পারে নাই।
বাবা বললেন, শামসুর রাহমান তোমার প্রশংসা কইরা বলছে তুমি মেয়েদের কথা লিইখা সমাজকে আলোড়িত করছ। বলছেন, আমি মনে করি তসলিমা সফল, কেউ চাক বা না চাক তিনি আন্তর্জাতিক ব্যক্তিত্বে পরিণত হয়েছেন। ডঃ আনিসুজ্জামানও ভাল বলছেন।
ছোটদা বললেন, জামাত কি কইছে ওইডা কন। জামাত হেভি চেতা সরকারের উপর। কইতাছে সরকার সব জানত তুই কই ছিলি, সব নাকি সরকারের নাটক। এহন তর জামিন হওয়ার বিরুদ্ধে আন্দোলনে নামতাছে তারা। মিছিল হইব প্রত্যেকদিন।
মিলন বলে, ভোরের কাগজ লিখছে পশ্চিমা সংবাদমাধ্যম নাকি পাগল হইয়া গেছে। দিন রাত নাকি ফোন কইরা জানতে চাইছে এখন আপনি কই আছেন, নিরাপত্তার কি হইতাছে, বিনা বাধায় বিদেশ যাইতে পারবেন কি না।
আজকের খবরের উত্তেজনা স্তিমিত হলে গত দুমাস কি কি ঘটেছে, কে কেমন ছিল এ বাড়িতে তার দুঃসহ বর্ণনা শুনি সবার কাছে। আমি চলে যাওয়ার পরই পুলিশ এসে বাড়ি তছনছ করেছে। বেচারা মোতালেবকে ধরে নিয়ে গেছে। ঘন্টার পর ঘন্টা জেরা। কোথায় তসলিমা, বলতেই হবে। মোতালেবকে পিটিয়েছে পুলিশ। মিলনকে খোঁজা হচ্ছিল, কারণ পুলিশ খবর পেয়েছে মিলন আমার সঙ্গে ছিল যখন আমি বেরিয়ে গেছি। মিলন নিখোঁজ হয়ে ছিল অনেকদিন। প্রথম দিকে, উকিলরা যখন বলেছিলেন যে এসময় আমার কিছু জনসমর্থন থাকলে ভাল হয়, পত্রিকায় কিছু বিবৃতি যাওয়া দরকার তখন ছোটদা আর দাদা আমার কবি লেখক বন্ধুদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে বিবৃতি ভিক্ষে চেয়েছেন। পাননি। কেউই আমার পক্ষে কিছু বলার কোনও উৎসাহ প্রকাশ করেননি, সবার মুখে ছিল আতঙ্ক। দাদাদের ফিরিয়ে দেওয়া হয়েছে। আমার কোনও আত্মীয়র ছায়াও কোনও বাড়ির কাছাকাছি পড়লে ক্ষতি। যে কেউ বাড়ির বাইরে গেছে, এসবির লোকেরা পিছু নিয়েছে। ছোটদা নুন কিনতে গেলেও টিকটিকি পেছনে যায়। মিলন ভালমানুষের মত আদমজিতে চাকরি করতে গেলেও পেছনে টিকটিকি। সবচেয়ে নিষ্ঠুর ঘটনাটি ঘটেছে ইয়াসমিনের ওপর, তার চাকরি চলে গেছে। সে আমার বোন, এই অপরাধে তার চাকরিটি গেছে। আমার বিরুদ্ধে সরকার মামলা দায়ের করার কিছুদিন পরই ইয়াসমিনকে তার আপিসের মালিক এসে বলে দিয়েছে, তার আর কাল থেকে আপিসে আসতে হবে না।
এক এক করে বন্ধুদের নাম বলি, কেউ এসেছিল কি না এখানে খোঁজ নিতে আমার আত্মীয়রা কেমন আছে অথবা খোঁজ নিতে কেউ জানে কি না আমি কেমন আছি, কোথায় আছি, ভাল আছি কি না, বেঁচে আছি কি না। প্রতিটি নাম উচ্চারণের পর উত্তর শুনি, না। কোনও কবি সাহিত্যিকই আসেনি? যারা আমার ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিল? না, কেউই আসেনি। নাকি এসেছে, তোমরা দরজা খোলোনি! না কেউই আসেনি। নিশ্চয়ই ফোন করেছে। ফোনে নিশ্চয়ই খবর জানতে চেয়েছে! না, কেউ ফোনও করেনি। গার্মেণ্টেসএর সাজু জাহেদারা ছাড়া আর কেউ আসেনি। কেউ ফোন করেনি। কায়সারও আসেনি? না। ফোনও করেনি? না। বরং কায়সারকেই ফোন করা হয়েছে, একবার অন্তত বাড়িতে আসার অনুরোধ করা হয়েছে। কথা দিয়েছে আসবে, কিন্তু আসেনি। একবার জানতেও চায়নি আমার কথা।