রাত এগারোটার দিকে বাড়িতে জ,ঝ,ঠ আর ঙ আসেন। কোনও এক রেস্তোরাঁয় আজকের জামিন পাওয়ার আনন্দের দিনটি উৎযাপন করে অনেকটা যুদ্ধজয়ের উৎসবে যোগ দিয়ে আমাকে দেখতে এসেছেন। রেস্তোরাঁয় ক ছিলেন। কিন্তু ক এই রাতে আর আসতে পারেননি আমার কাছে, বলেছেন আগামীকাল বা পরশু একবার আসবেন। এঁরা আমার পাশে ছিলেন আমার অন্ধকার সময়গুলোয়। যখন লক্ষ লক্ষ মানুষ উন্মাদ হয়ে উঠেছে একটি মানুষকে হত্যা করতে, যখন বন্ধুরাও মুখ ফিরিয়ে রেখেছে ভয়ে, তখন এঁরা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে আমাকে আশ্রয় দিয়েছেন, গভীর গোপন নিরাপত্তা দিয়েছেন। এঁরা আমার প্রাণ রক্ষা করেছেন। কী হন এঁরা আমার! আমার ভাইও নন, বোনও নন। অথচ এঁরাই আমার পরম আত্মীয়, এঁরাই আমার সত্যিকার বন্ধু। মৌলবাদীর দাবি আর সরকারের অনমনীয় মতের বিরুদ্ধে আজকের এই বিজয় এঁরা নিজেদের বিজয় হিসেবে মনে করছেন। আমার পক্ষে বাইরের রেস্তোরাঁয় কোনও উৎসবে যোগ দেওয়া সম্ভব নয়, সম্ভব হলে আমিও যোগ দিতে পারতাম। আমিও আনন্দ করতে পারতাম! কিন্তু আনন্দ কোথায় আমার মনে! জামিন পেয়েছি, কিন্তু সামনে আমার অনিশ্চিত একটি ভবিষ্যত। এঁরা সবাই জানেন আমার সামনের অনিশ্চয়তার কথা, কিন্তু আপাতত সব ভুলে আমাকে হাসতে বলছেন। অদ্ভুত একটি হাসি ঝুলে থাকে আমার ঠোঁটে। এঁদের মুখোমুখি সোফায় বসেছিলাম, সোফা ছেড়ে দিয়ে এঁদের খুব কাছে, পায়ের কাছে, ফরাসের ওপর বসি এসে। খুব ঘন হয়ে বসার অভ্যেস গত দুমাসে হয়েছে বলেই হয়ত। আমার কণ্ঠস্বর লঘুতে, নিচুতে, মৃদুতে। গত দুমাসে এভাবে কথা বলার অভ্যেস হয়েছে বলেই বোধহয়। আমি ক্লান্ত, যত না শরীরে, তারও চেয়ে বেশি মনে। এই মনের ওপর খুব বড় তুফান বয়ে গেছে, মনের দালানকোঠা ভেঙে গেছে। এই মনের ঘরকে শক্ত করে গড়তে আমি বড় শ্বাস নিই। এঁদের পাশে থাকা আমার শ্বাসে শুদ্ধ হাওয়া বইয়ে দেয়।
৪. দেশান্তর – ১
বাড়িটি অন্ধকার করে রাখা হচ্ছে। জানালাগুলো ঢেকে দেওয়া হয়েছে ভারী পর্দায়, দরজাগুলো বন্ধ। বাইরে থেকে যেন বোঝা না যায় এ বাড়িতে কোনও মানুষ বাস করছে। বাড়ির মানুষেরা বাড়ি থেকে বাইরে যাচ্ছে না। বাইরের কাউকে ঢুকতে দেওয়া হচ্ছে না। তারপরও দেখে মনে হয় উৎসব লেগেছে বাড়িতে। এতজনকে একসঙ্গে আমি বহুদিন পাইনি। বাবা, মা, দাদা, ছোটদা, ইয়াসমিন, সুহৃদ, ভালবাসা, মিলন, গীতা, হাসিনা, পরমা, শুভ, সৌখিন সব এ বাড়িতে। পুরো পরিবার। পুরো পরিবার কখনও কি এক বাড়িতে এভাবে মিলেছে আর! ঈদের সময় অবকাশে মিলেছে, তবু সব ঈদে নয়। আমার মনে হতে থাকে আমি বুঝি সেই শৈশব বা কৈশোরের আমি। আমি বড় হয়ে উঠছি আত্মীয়দের আদরে ভালবাসায়। এভাবেই, এ বাড়িতে বুঝি আমরা সবাই আমাদের বাকি জীবন যাপন করব। কেউ কোনওদিন কারও থেকে দূরে সরব না। সবাই সবাইকে ভালবাসবো, আমরা সহায় হব একে অপরের। পরস্পরের প্রতি গভীর মমতা আমাদের আরও কাছে টানবে, আরও ঘনিষ্ঠ করবে। আমরা পরস্পরের আত্মীয় হব, বন্ধু হব আরও, আমরা সবাই সবার হৃদয় জুড়ে থাকব। আমরা হাসব, খেলব, আনন্দ করব। আমরা নিঃস্বার্থ, নিরুপদ্রব, নির্ঝঞ্ঝাট জীবন কাটাবো। সুখ স্বস্তি আর শান্তি স্বাচ্ছ−ন্দ্যর জোয়ার আমাদের ভাসাবে ডোবাবে নিশিদিন। একটি প্রাণীও আর অনিশ্চয়তায়, দুশ্চিন্তায়, দুর্ভাবনায় নির্ঘুম রাত কাটাবে না। প্রতিটি ভোরকে আমরা চুম্বন করব, প্রতিটি দুপুরকে নূপুর পরিয়ে নাচাবো, প্রতিটি বিকেলের সঙ্গে প্রেম করব, প্রতিটি সন্ধেকে পান করব, প্রতিটি রাতকে আলিঙ্গন করব। আশ্বাসে আশায় ভাষায় ভালবাসায় কলরোল করবে প্রতিটি প্রাণী। আমার মনে হতে থাকে আমার এই বাড়িটি আমার সেই কৈশোরের অবকাশ। বাবা মা ভাই বোন মিলে এক বাড়িতে বাস করছি। আমি ভুলে যাই যে আমরা পরস্পরের কাছ থেকে দূরে সরে গেছি অনেক বছর ধরে, ভুলে যাই দাদা তাঁর বিয়েটি করার পর বড় স্বার্থপর হয়ে গেছেন, ভুলে যাই যে হাসিনা আমাদের দুবোনকে উঠোনে ফেলে মেরেছিল, ভুলে যাই ছোটদা সুহৃদকে আমাদের কোল থেকে ছিনিয়ে নিয়ে গেছেন, ভুলে যাই যে ছোটদাই আমাদের দোষ দিয়ে বলেছেন সুহৃদকে নষ্ট করেছি আমরা, ভুলে যাই যে তিনি আমার গাড়ি কেনার পঞ্চাশ হাজার টাকা এখনও ফেরত দিচ্ছেন না, ভুলে যাই বছরের পর বছর ধরে গীতার দুর্ব্যবহার, ভুলে যাই ইয়াসমিন অবকাশ ছেড়ে চলে গেছে অনেককাল, বিয়ের পর তার কাছে এখন তার স্বামী আর বাচ্চাই বেশি আপন। ভুলে যাই সব, যেন মাঝখানে কিছুই ঘটেনি, আমরা যেমন ছিলাম তেমনই আছি, সময় পাল্টায়নি, বয়স বাড়েনি।
মা রান্না করছেন। কোমরে দুহাত রেখে দাঁড়িয়ে বাবা রান্না দেখছেন। দাদা ছোটদা আর মিলন গল্প করছে বিশ্বকাপ নিয়ে। ইয়াসমিন নতুন একটি হিন্দি ছবি চালিয়ে দিয়েছে। গীতা আর হাসিনা কথা বলছে আর হাসছে। সুহৃদ, শুভ আর পরমা ক্যারম খেলছে। সৌখিন আর ভালবাসা ছবি আঁকছে। দৃশ্যগুলো আমি ঘুরে ঘুরে দেখি। দেখতে দেখতে আমার বিশ্বাস হতে চায় না যে এমন ছিল না দৃশ্য এর আগে এ বাড়িতে। যেন সকলেই আমরা এভাবেই এক বাড়িতে হৈহুল্লোড় করে ছিলামই, যেন কেউ কখনও কারও থেকে আলাদা হইনি। একটি জিনিস লক্ষ্য করে আমার এত ভাল লাগে যে কারও সঙ্গে কারও কোনও বিরোধ নেই এখন, কেউ কোনও অভিযোগ করছে না কারও বিরুদ্ধে, সকলে সকলকে ভালবাসছে। আমার বিপদই সম্ভবত সবাইকে এমন একত্র করেছে, এক বিন্দুতে দাঁড় করিয়েছে। আমার এত ভাল লাগে যে চোখ ভিজে ওঠে। ঘুরে ঘুরে সবার কাছে দাঁড়াই, বসি। মার রান্নায়, দাদাদের গল্পে, ইয়াসমিনের ছবিতে, গীতাদের হাসিতে, সুহৃদদের খেলায়, ভালবাসার আঁকায়। এ সত্যিই এক অন্যরকম সুখ। সবাইকে কাছে পাওয়ার সুখ, চোখের নাগালে, হাত বাড়ালেই পাওয়ার সুখ।