আমাকে জড়িয়ে ধরে চিৎকার করে কাঁদছেন মা। সে যে কি বিষম কান্না! কে এত কাঁদতে পারে মা ছাড়া! মার এলো চুল, এলো শাড়ি, শরীর শুকিয়ে অর্ধেক, আমার আর কত, মার চোখের নিচে অনেক বেশি কালি, ফুলে ঢোল হয়ে আছে কান্না -চোখ। চোখের জল নাকের জল গড়াচ্ছে মার গাল বেয়ে চিবুক বেয়ে বুকে। মাকে বলছি, কাঁদো কেন, আমি তো ফিইরা আসছি। মা তবু কাঁদেন। আমার ঘরে ফিরে আসার আনন্দে কাঁদেন মা, দীর্ঘকাল আমার না থাকার জন্য কাঁদেন, আমার শুকিয়ে যাওয়া শরীরটির জন্য কাঁদেন, আমার মলিন মুখটির জন্য কাঁদেন, দুমাস আমি কষ্টে থেকেছি ভয়ে থেকেছি বলে কাঁদেন। মা আমার জন্য ভয়ে নির্ভয়ে কাঁদেন। আমার সারা গায়ে হাত বুলিয়ে দিতে দিতে কাঁদেন। যেন হাজার বছর পর হারিয়ে যাওয়া কন্যাকে ফিরে পেয়েছেন মা, যেন হারিয়ে যাওয়া বড় আপন কেউ হঠাৎ ফিরেছে বাড়িতে। মার কান্না শেষ হয় না, আমার সারা শরীরে হাত বুলোনো শেষ হয় না মার। আমি আমার লেখার ঘরে ধপাস করে বসে পড়েছি। বড় বড় করে নিঃশ্বাস নিচ্ছি। মা কেঁদেই চলেছেন। কান্নার দমকে তিনি কোনও কথা বলতে পারছেন না। এতদিন পর ঘর ভরা আত্মীয় স্বজনের মধ্যিখানে আমি। যে পরিবেশে কোনওদিন ফিরতে পারবো আমার বিশ্বাস হয় নি। মৃত্যুর গুহা থেকে এভাবে বেঁচে ফিরব ভাবিনি, কেবল আমি কেন আমার আশেপাশে যারা ছিল, কেউ ভাবেনি, বড় করুণায় আমার শুকনো মুখটি দেখেছে। যেন স্বপ্নের মত ঘটে গেল পুরো ব্যাপারটি। আমার এখনও বিশ্বাস হয় না আমি সত্যিই আমার বাড়িতে বসে আছি। যতই নিরাপদে আমি এখন থাকি না কেন, আমি কিন্তু হাঁপাচ্ছি। আদালতের করিডোরের ভয় এত তীব্র ছিল যে সেটি দূর হতে অনেক সময় নেয়। ঘন ঘন পানি খাই কাঠ হয়ে থাকা গলাটি ভেজাতে। ক আমার পাশে এসে নিঃশব্দে বসেন। বলেন, আপনার পাসপোর্টটা দিন। পাসপোর্ট খুঁজে বের করে দিই। ক বলেন, কোনও সাংবাদিককে সাক্ষাৎকার দেবেন না। যে সাংবাদিকই আসবে, যেন বাড়ি থেকে বলে দেওয়া হয় আপনি এ বাড়িতে নেই।
মাথা নেড়ে আচ্ছা বলি। ক চলে গেলেন।
নিচে বাড়ির নিরাপত্তা প্রহরী, তার ওপর বাড়ি ঘিরে পুলিশ পাহারা, ঘরের দরজায় লম্বা লম্বা বন্দুক হাতে নিয়ে পুলিশ বসে গেছে। একইসঙ্গে ফোন বাজছে, ইন্টারকম বাজছে। নিচে সাংবাদিকরা ভিড় করে আছে। পাইকারি ভাবে সবাইকে বলে দেওয়া হয়েছে যে আদালত থেকে তসলিমা এ বাড়িতে সামান্য কিছুক্ষণের জন্য এসেছিল বটে, কিন্তু চলে গেছে আবার, কোথায় গেছে তা এ বাড়ির কেউ জানে না। এটাই বিশ্বাসযোগ্য কথা। তারপরও সাংবাদিকরা নিচে অপেক্ষা করছেন, কোনও রকম ফাঁক ফোকর দিয়ে ঢোকা যায় কি না দেখছেন অথবা কোনও রকম সংবাদ যোগাড় করা যায় কি না বাড়ির মানুষের কাছ থেকে অথবা পুলিশের কাছ থেকে। পাইকারির মধ্যে ফরিদ হোসেনও পড়েছেন। ফরিদ হোসেন অবশ্য বুদ্ধি করে বাড়ির দরজা অবদি আসতে পেরেছেন। তিনি আমার বাড়ির নাম করে ভেতরে ঢোকেননি, ঢুকেছেন ইস্টার্নপয়েণ্টের দু নম্বর বাড়ির পাঁচতলায় তাঁর বন্ধুর বাড়ি যাচ্ছেন বলে, তারপর দুনম্বর বাড়িতে তিনি গেছেন বটে, তবে নিজেকে আড়াল করে এক নম্বর বাড়ির নতলায় এসে চার নম্বর দরজায় টোকা দিয়েছেন। ফরিদকে দরজা থেকে বলে দেওয়া হল আমি বাড়ি নেই। দরজা খোলার জন্য তিনি হেন কথার আবদার নেই যে করেননি। না, দরজা খোলা হয়নি। শেষমেষ দরজার তল দিয়ে দিয়ে গেলেন একটি প্রশ্নপত্র। মাত্র কটি প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার অনুরোধ করেছে টাইম ম্যাগাজিন। টাইমের বিদেশী সাংবাদিক নিজে এসেছেন, আমার কাছে তাঁর আকুল প্রার্থনা যেন জবাব গুলো দিই। ফরিদকে অবিশ্বাস করার কোনও কারণ নেই আমার, সাংবাদিকদের মধ্যে ফরিদই আমার সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ। অনেকটা তিনি ঘরের লোকের মত। ফরিদ হোসেন এ বাড়িতে অনেক এসেছেন, তিনি জানেন এ বাড়ির পরিবেশ, নিশ্চয় তিনি অনুমান করেছেন যে যদি কোথাও থাকি আমি, এ বাড়িতেই আছি। আরেক দফা সুযোগ নিয়ে তিনি বিকেলে আবার যখন এলেন পাভেলকে নিয়ে, ভেতরে ঢোকার ছাড়পত্র তাঁকে দেওয়া হয়। ছাড়পত্র দেওয়া হয় ফরিদ সাংবাদিক বলে নয়। ফরিদ ফরিদ বলে, বন্ধু বলে। পাভেল কিছু ছবি তুলে নিলেন দ্রুত, আমি লক্ষ্য করার আগেই। প্রতিশ্রুতি দিলেন দুজনই, কোনও প্রাণীকে তাঁরা জানাবেন না আমি যে এ বাড়িতে আছি। ফরিদকে বললাম যে আমি কোনও সাক্ষাৎকার দেব না। কোথাও কোনও সাক্ষাৎকার দিচ্ছি না, কেবল বিবিসি সিএনএনকেই নয়, বিদেশি দেশি যত সাংবাদিক আছেন, সবাইকেই ফিরিয়ে দেওয়া হয়েছে। টাইম ম্যাগাজিন হোক আর যে ম্যাগাজিনই হোক, আমি মুখ খুলব না বলে দিই কিন্তু ফরিদের মুহূর্মহূ অনুরোধে ঢেঁিক গিলতে হয় আমাকে, ঢেঁকি গেলা মানে রাজি হওয়া যে তাঁর প্রশ্নের উত্তর গুলো অন্তত লিখে হলেও আমি দেব। আজ তো নয়ই। কাল? দেখা যাক। ঢেকি গেলার পুরস্কার দেয় ফরিদ ফেরার পথে অপেক্ষমান সাংবাদিকদের বলে যে আর যেখানেই থাকি আমি অন্তত এ বাড়িতে নেই। পরদিন সব পত্রিকায় আদালতের ঘটনার বিস্তারিত বিবরণ শেষে লেখা হয়, আমি আদালত থেকে বাড়ি ফিরে মার সঙ্গে দেখা করেই আবার চলে গেছি কোনও গোপন ঠিকানায় আত্মগোপন করতে।
মা আমাকে খাবার টেবিলে বসিয়ে মাথার ওপর পাখা ছেড়ে দিয়ে মুখে তুলে ভাত খাইয়ে দেন। এক হাতে ভাত খাওয়ান, আরেক হাতে আঁচল টেনে চোখের পানি মোছেন। বেশি খাবার আমার পেটে ঢোকে না। মুখ সরিয়ে নিই। বাড়ির সবার সঙ্গে কথা বলতে চাই। কিন্তু পারি না। শরীর দুর্বল। শরীর নেতিয়ে পড়ে। হাঁটতে পারি না এ ঘর থেকে ও ঘর। শুয়ে পড়ি বিছানায়। শরীর ভরা ক্লান্তি, ক্লান্তি মানুষকে ঘুম পাড়িয়ে দেয়, আমাকে পাড়ায় না।