এতদিন আত্মসমর্পন করিনি কেন, আমি উত্তর দেওয়ার আগে আমীরুল ইসলাম বলেন, আসামী নিরাপত্তার অভাব বোধ করেছে।
আসামী নিজের মুখে বলে না কেন সে কথা?
আসামী মৃদুকণ্ঠে বলে সে কথা। কিন্তু কণ্ঠ এমনই মৃদু এমনই মৃত যে আসামীর স্বর কেবল আসামীই শুনতে পায়।
এরপর এক তাড়া কাগজ দেওয়া হল বিচারকের সামনে। ব্যারিস্টার আমীরুল ইসলাম বলে যাচ্ছেন আমার পক্ষ থেকে, যা বলার, যা বলতে হয়। আমার চোখ বারবার বাইরের ভিড়ে, কান চিৎকারে। মনে হতে থাকে বন্ধ দরজা ভেঙে মানুষের ঢল আমার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়বে এক্ষুনি। আমাকে ছিঁড়ে টুকরো করবে এরা। এ ঘরে জামিনের শুনানি অনেকক্ষণ থেকে চলছে, কেবল আমার সশরীর উপস্থিতির প্রয়োজন ছিল, তাও সারা। তারপরও আরও দেরি হচ্ছে, জামিনের দশ হাজার টাকার নথিপত্র নিয়েই নাকি দেরি। জানালায় ততক্ষণে যেন পুরো ঢাকা শহর হুমড়ি খেয়ে পড়েছে। এবার মহামান্য আদালতের কাছে আবদার, আসামীকে আদালত কক্ষ থেকে তার গন্তব্য অবধি নিরাপত্তা দেওয়া হোক, এবং তার বাড়িতেও পুলিশের ব্যবস্থা করা হোক। মহামান্য আদালত নিরাপত্তার সমস্ত ব্যবস্থা করার ব্যাপারে রাজি হলেন। পেছনে গুঞ্জন, সামনে গুঞ্জন। গুঞ্জন বিচারকের বিচার নিয়ে নয়। গুঞ্জন বাইরের ভিড় নিয়ে। যা করার তাড়াতাড়ি কর। ভিড় বাড়ছে। ভয়ঙ্কর ভিড়। আততায়ীর ভিড়।
কী করে এখন আমাকে বের করা হবে আদালত কক্ষ থেকে! কেউ জানে না কি করে। সকলের কপাল ধীরে ধীরে কুঁচকে যাচ্ছে, কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমে আছে। আমি কাঠ হয়ে দাঁড়িয়ে আছি। আমাকে হঠাৎ কেউ হাত ধরে কেউ সামনের দিকে টান দিল। হাত ছাড়িয়ে নিয়ে বললাম, ভিড় কমুক। সমস্বরে অনেকে বলে উঠল, ভিড় কমবে না, ভিড় আরও বাড়বে। জলদি বেরোতে হবে। একটুও দেরি নয়। এক্ষুনি। ভিড় বাড়ছে। বাইরে অবস্থা ভাল নয়। আমাকে টেনে দরজার বাইরে বের করা হল। এক সুতো জায়গা নেই সামনে। কোথায় এগোবো! পুলিশেরা জায়গা করতে চাইছেন, পারছেন না। অনেকগুলো খাকি পোশাকের পুলিশ আমার সামনে, আমার পেছনেও। আমার বাঁদিকে আমীরুল ইসলাম, ডান দিকে নীল পোশাকের পুলিশ অফিসার, দুজনেই শক্ত করে ধরে আছেন আমার দুটো বাহু। আমার দুহাত আঁকড়ে আছে দুজনকে। পেছনে দাদা, ছোটদা, গীতা, মিলন, ক। সবাই আমাকে শক্ত করে ধরে আছে। কোনও ধাককায় যেন আমি পিছলে না যাই কারও হাত থেকে। সামনে আইন সালিশ কেন্দ্রের কজন উকিল। মাঝখানে আমি। আমাকে ঘিরে বৃত্তটি ক্রমশ বড় হচ্ছে। কিন্তু আমরা কেউ সামান্যও নড়তে পারছি না। এক পা নড়তে পারছি না, এক সুতো না। হাজার মানুষের ভিড়। করিডোর উপচে পড়ছে মানুষে। মানুষের ঘাড়ের ওপর মানুষ। এই ভিড়ের মধ্যে যে কোনও মুহূর্তে যে কোনও দুর্ঘটনা ঘটে যেতে পারে। পুলিশ চিৎকার করছে লোক সরাতে। কোনও লোক সরছে না। জোরে ধাককা দিয়ে ভিড়ের মধ্যে অনেকে আমার চারপাশের আগল ভাঙতে চাইছে। একবার ভেঙে গেলেই হল, আমাকে নাগালের মধ্যে পেয়ে যাবে আততায়ীর দল। আমাকে দুহাতে সাঁড়াশির মত করে ধরে আছেন আমীরুল ইসলাম। পুলিশ অফিসার ঘামছেন। করিডোরে চিড়েচ্যাপ্টা হয়েও দাঁড়াবার জায়গা নেই বলে রেলিংএ লাফিয়ে লাফিয়ে উঠছে মানুষ। আমার সামনের লোকগুলো সামনে জোরে ধাককা দিয়েও লোক সরাতে পারছে না এক তিলও। বিস্ফোরণের ঠিক আগের মুহূর্ত প্রতিটি মুহূর্তই। পেছনে চলে যাবো কি না চেঁচিয়ে জিজ্ঞেস করি। পুলিশ অফিসার চেঁচিয়ে উত্তর দেন, না। কোত্থেকে যেন বিকট সব চিৎকার ভেসে আসছে। আমরা আটকা পড়ে গেছি করিডোরে। আমাদের সামনে যাওয়ার উপায় নেই, পেছনে হঠারও কোনও উপায় নেই। যে কোনও কিছুই এখন ঘটতে পারে, যে কোনও ভয়াবহ দুর্ঘটনা এখনই ঘটবে। যে কেউ আমার মাথা লক্ষ্য করে গুলি ছুঁড়তে পারে। অন্যরকম গন্ধ পাই বাতাসে, কিছু একটা ঘটতে যাচ্ছে। ভিড় আরও বাড়ছে, ভিড়ের মধ্যে ভিড় বাড়ছে। মানুষের মাথার ওপর মানুষ উঠছে। পুলিশ দিশেহারা। আমরা বিশ্রি রকম বন্দী।
চারদিকে বিকট বিকট শব্দ। সব শব্দ ছাপিয়ে বুকের ধুকপুক শব্দ শুধু। মৃত্যুর রং দেখছি। গাঢ নীল রং টি ধীরে ধীরে কালো হয়ে উঠছে। বিবিসির ইংরেজ সাংবাদিক রেলিংএর ওপর থেকে তাঁর লম্বা মাইক্রোফোনটি আমার মাথার ওপর ঝুলিয়ে রেখেছেন। রেলিং এ দাঁড়ানো সাংবাদিকরা চেঁচিয়ে প্রশ্ন করছেন, জামিন হয়েছে কি না, আমি কেমন বোধ করছি, এখন কী ভাবছি, আমার ভবিষ্যতের পরিকল্পনা কি। কাণ্ডজ্ঞানহীন সাংবাদিকরা সামান্য বুঝতে চেষ্টা করেন না যে কারও কোনও প্রশ্নের উত্তর দেবার মত শারীরিক মানসিক কোনও অবস্থাই আমার নেই। সাংবাদিকদের জন্য অবশ্য সবই মজার বিষয়, এই যে আমি মৃত্যুর দুহাত দূরে দাঁড়িয়ে আছি, এ নিয়ে তাঁরা কেউ কোনও দুশ্চিন্তা করছেন না, এখন যদি আমার পেটে কেউ ছুরি বসায়, তা দেখে তাঁরা অখুশি হবেন না, বরং মহা আনন্দে বর্ণনা করবেন আমার খুন হওয়ার আদি থেকে অন্ত, এর নিউজ ভ্যালু নিয়ে মেতে উঠবেন। হঠাৎ পলকের মধ্যে দৃশ্য পাল্টে যায়। সামনের পুলিশগুলো শক্ত শক্ত লাঠি দিয়ে পেটাচ্ছে সামনে যাকে পাচ্ছে তাকে। পিটিয়ে সরাচ্ছে লোক। ধাওয়া খেয়ে কেউ না কেউ সামান্য হলেও সরে যায়। এই করে আমার যাওয়ার জায়গা জোটে। নীল পুলিশটি আমাকে বললেন সামনে যেতে। আমি সঙ্গে সঙ্গে বলি, ভিড় কমুক। পুলিশ ধমকে উঠলেন, ভিড় কমবে না, বাড়বে আরও। আচমকা পুলিশ অফিসারটি আমাকে দৌড় দিতে বলে নিজে দৌড়োতে লাগলেন, আমাকে টেনে নিতে লাগলেন সামনের দিকে। সামনের পুলিশগুলোর কাছে ইঙ্গিতে তাই হয়ত বলা হয়েছে। পুলিশগুলো বেধড়ক লাঠি চালিয়ে সবাই মিলে ধাককা দেবে সামনের দিকে, এই করেই যদি এগোনো যায়। তাই হল। সবাই দৌড়োচ্ছে, বৃত্তের সবাই। আমীরুল ইসলাম, দাদা, ছোটদা, মিলন, ক। আইন ও সালিশ কেন্দ্র, পুলিশ। দৌড় আমাকে দিতে হয়নি। সকলের দৌড় ফুঁসে ওঠা সাগরের উত্তাল জোয়ারের মত আমাকে ভাসিয়ে নিয়ে গেল। সামনে করিডোর শেষ হতেই সিঁড়ি, সেই সিঁড়ি পেরিয়ে নিচে। যখন দাঁড়িয়েছি নিচে, খালি পা আমার, চটিজোড়া কখন ভিড়ে খসে গেছে জানি না, শাড়ি খুলে খসে পড়ছে। চিৎকার বাড়ছে চারদিকে। পুলিশের, অচেনা মানুষের, চেনা মানুষেরও। টুপিমাথার লোকগুলো পুলিশের ব্যারিকেড ভেঙে ছুটে আসতে চাইছে এদিকে, পুলিশের চেয়ে টুপিমাথার সংখ্যা অনেক বেশি। চিৎকার চারদিকে, বিষম বিকট চিৎকার। অস্থিরতা আমার সারা শরীরে, এই বুঝি খুলি উড়ে যাবে, আর বুঝি একটি মুহূর্ত। শুকিয়ে কাঠ হয়ে আছে কন্ঠদেশ। আমি কথা বলতে চাইছি, পারছি না। ফ্যাসফ্যাস একটি শব্দ বেরোচ্ছে গলা থেকে। গলার ভেতর যন্ত্রণা হচ্ছে। ছোটদা দৌড়ে গেলেন গাড়ি আনতে, কয়েক মিনিটের মধ্যেই গাড়ি এল, কিন্তু কয়েক মিনিটকে কেবল আমার নয়, আমাকে ঘিরে যাঁরাই ছিলেন, সবারই মনে হল যেন ঘন্টা পার করে গাড়ি এনেছেন। দ্রুত আমাকে ঠেলে দেওয়া হল গাড়ির ভেতরে, আমার ডানে বামে দাদা, মিলন আর ক। গাড়ি দ্রুত আদালত প্রাঙ্গণ পেরোচ্ছে যখন, পেছনে পাথর ছুঁড়ছে চিৎকার করা লোকেরা। গাড়ির লেজে ঠোককর খাচ্ছে পাথরে বাঁধা ঘৃণাগুলো। সামনে পুলিশের গাড়ি, পেছনে পুলিশের ট্রাক। কেবল বাড়িতেই নয়, একেবারে ঘর অবদি পৌঁছে দিয়ে গেল নীল পোশাকের লোক। ঘর! সেই ঘর!