জিল বলল, কি ব্যাপার তুমি তো বলনি তুমি যে অপেরায় গিয়েছিলে!
হেসে বলি, মনে ছিল না।
মনে ছিল না?
জিল হেসে ওঠে। শিশুর হাসির মত হাসি।
বারোটা বেজে গেল। সকালেই ক্রিশ্চান হোটেলে ফ্যাক্স পাঠিয়ে জানিয়েছেন যে আমাকে তিনি সাড়ে বারোটায় এসে নিয়ে যাবেন, ফেরত দিয়ে যাবেন তিনটেয়। অষ্ট্রেলিয়ার টেলিভিশন থেকে পিটার নামের এক লোক চার পৃষ্ঠা লম্বা ফ্যাক্স পাঠিয়েছেন, কোত্থেকে যে এই লোক খবর পেলেন আমি কোথায় আছি, জানি না। জিলকে বলি ফ্যাক্সটি পড়ে শোনাতে, আমার পক্ষে অত লম্বা জিনিস পড়া সম্ভব নয়। জিল বাধ্য ছেলের মত শোনায়। ক্রিশ্চান এলে জিলকে সঙ্গে নিই। সোজা এডিশন স্টক, ক্রিশ্চানের প্রকাশনীতে। কি বিশাল প্রকাশনীর বাড়িটি। সকলে আমাকে দেখে বিষম উচ্ছঅজ্ঞসত। দু গাল যে কত বার কতজনের কাছে পেতে দিতে হল চুমু খেতে। অভ্যস্ত নই এসবে। কিন্তু ওদের অভ্যেসের কাছে আমার গালদুখানি বিসর্জন দিতে হয়।
রাতে এলিজাবেথ আসে। তার তথ্যচিষেনর ভিডিও ক্যাসেট দিল আমাকে, যা ও তৈরি করেছিল ঢাকায় গিয়ে। বলল, বাইশটি দেশ এই তথ্যচিত্রটি কিনে নিয়েছে। সুইৎজারল্যাণ্ড, ইতালি, স্পেন, ইংলেণ্ড, সুইডেন, ডেনমার্ক, আমেরিকা..। এলিজাবেথ ঢাকায় যেমন রহস্যে মোড়া ছিল, এবার আর তা নয়। বলল, ঢাকায় তার ঝামেলা হয়েছিল। তিরিশ জন পুলিশ তার পেছনে যখন সে শাখারিপট্টিতে পৌঁচেছে। কি করে তার যাবার খবর পুলিশ জানে, তা এখনও তার কাছে রহস্য। ফৈয়াজ নামে যে ছেলেটি তাকে বাংলা থেকে ফরাসিতে অনুবাদ করে দিয়েছিল, এলিজাবেথ চলে আসার পরই তাকে ধরে নিয়ে গিয়েছিল পুলিশ, থানায় নিয়ে কয়েক হাজার প্রশ্ন করেছে। পুলিশের কারণে এলিজাবেথের আর শাখারিপট্টিতে ছবি তোলা সম্ভব হয়নি। জিজ্ঞেস করলাম, বাইশটি দেশ তোমার এই ছবি কিনে নিল? আশ্চর্য! –হ্যাঁ। ভীষণ পছন্দ করেছে ওরা। প্রচুর চিঠি আসছে আমার কাছে। ওরা তোমাকে সহমর্মিতা জানাতে চায়। তোমার ঠিকানা চাইছে ।
–আর যাবে না ঢাকায়?
এলিজাবেথ হেসে বলল, আমার জন্য ঢাকা যাওয়ার পথ বোধহয় বন্ধ হয়ে গেল। আমাকে আর ঢুকতে দেবে বলে মনে হয় না।
এলিজাবেথ চলে যাবার সঙ্গে নাতালি এল, সঙ্গে নীলরতন আর শ্যামল চক্রবর্তী নামে একটি ছেলে। শ্যামল নীলরতনের বন্ধু। নীলরতন রান্না করে নিয়ে এসেছে। মুরগি, ফুলকপি আর বাসমতি চালের ভাত। নীল চামচ দিয়েছিল থালায়। সরিয়ে দিয়ে হাত ডুবিয়ে দিই ভাতে। কতদিন পর ভাতের স্বাদ পাওয়া! আহা। শ্যামল বার বারই বলছে, দিদি আপনার সঙ্গে পরিচিত হবার ইচ্ছে সেই কতদিনের। কি যে ভাল লাগছে দিদি!
নাতালি এসে কানে ওয়াকম্যান লাগিয়ে বাংলা গান শুনতে বসে গেছে। নাতালি, আপাদমস্তক ফরাসি মেয়ে, কি চমৎকার বাংলা বলে, বাংলা লেখে। বাংলা গানের পাগল। জিজ্ঞেস করি, এই তুমি শাড়ি পরতে পারো?
মাথা নেড়ে বলল, না।
ওকে একটা লাল শাড়ি দিলাম। নীলরতনকে শার্ট।
‘নিয়ে নাও। আমার লাগবে না।’ সে যে খুশি দুজন।
শ্যামল মেট্রোতে বাদাম বিক্রি করে। সে এখানে রাজনৈতিক আশ্রয় চেয়েছে। জানেনা, ফরাসি সরকার তাকে আশ্রয় দেবে কি না। না দিলে তাকে দেশে চলে যেতে হবে। বাদাম বিক্রি করে দিনে একশ ফ্রাঁ জোটে তার।
–এখানে জিনিসের সে যে কি আগুনে দাম, এই টাকায় কি চলতে পারো!
–কষ্ট করে চলি দিদি।
শ্যামল বড় করুণ স্বরে বলতে থাকে, –এক ঘরে সাত আটজন গাদাগাদি করে থাকি। বাঙালিরা মেট্রো স্টেশনে বাদাম বিক্রি করে, কাপড় বিক্রি করে, ফুল ফল বিক্রি করে। এসব বিক্রি করা মেট্রোতে নিষিদ্ধ। পুলিশ প্রায়ই ধরে নিয়ে যায়। মারধোর করে।
খেতে খেতে শ্যামলের গল্প শুনি।
–পনেরো তারিখে আপনার ওপর একটা অনুষ্ঠান হয়েছে টেলিভিশনে। দু ঘন্টা আগে থেকেই বিজ্ঞাপন দিচ্ছিল। বসে ছিলাম আপনাকে দেখব বলে। কী যে ভাল লেগেছে দিদি।
নীলরতন বলল, এখানকার কাগজে সেদিন পড়লাম ফ্রান্সের ইস্কুল কলেজগুলো আপনার ওপর একটি বিশেষ আলোচনা অনুষ্ঠান হচ্ছে। গর্বে বুক ভরে গেছে। খাওয়া শেষ হলে আমরা সবাই মিলে বাইরে যাই। অনেকটা পথ রাতের প্যারিস জুড়ে হাঁটি। বাংলায় কথা বলতে বলতে হাঁটি। রাতে অষ্ট্রেলিয়া টেলিভিশন থেকে ফোন, আমার ওপর একটি তথ্যচিত্র বানাতে ওরা বাংলাদেশে যেতে চায়। আমি রাজি কি না জানতে চাইছে। এসব কাণ্ড যত দেখছি, তত অবাক হই। আমি তো সেই আমিই! সেই অবকাশের আমি।
নাতালি রাতে থেকে যায় আমার ঘরে। অনেকটা রাত গল্প করে কাটায়। সকালে ঘুম ভেঙে যায় টেলিফোনের শব্দে। নিচে ফটোগ্রাফার অপেক্ষা করছে। গামা নয়ত সিগমা ফটোএজেন্সি থেকে এসেছে। বলে দিই যে নিচে যেতে পারব না, চাইলে ওপরে যেন চলে আসে। মেয়েটি আমার ঘরে চলে এসে পাগলের মত ছবি তুলতে থাকে। ছবি তোলা তখনও শেষ হয়নি, তুলুজ থেকে এলেন ক্যারোলিন ম্যাকোনজি। তখন চা খাচ্ছি। ফটোগ্রাফার অপেক্ষা করছে। ক্যারোলিন খুব কাছে মুখোমুখি বসে বললেন, ‘একটা উপন্যাস আমাকে ছাপতে দিন।’
‘উপন্যাস তো কিছু নেই বাকি। এডিশন স্টককে দিয়ে দিয়েছি।’
‘উপন্যাস যদি না দিতে পারেন, অন্তত একটা গল্পের বই দিন।’
‘কিছু তো নেই। গল্প যা আছে, তা স্টককে দেব বলে কথা তো দিয়ে ফেলেছি।’ ‘কিন্তু আমরা যে চাইছি। সেই কতদিন থেকে আমরা ঢাকায় আপনার কাছে ফোন করছি, ফ্যাক্স করছি। কিছু একটা আমাদের দিতেই হবে তসলিমা। দয়া করুন আমাদের। আপনার লজ্জা বেরোবে সেপ্টেম্বরে। এই সেপ্টেম্বরের মধ্যেই আমাকে ছোট গল্পের পাণ্ডুলিপি দিন। দিতেই হবে।’