ঠর বাড়ির দরজার সামনে সাদা গাড়ি এসে থামে বারোটা তেতাল্লিশে। আমাকে দরজার কাছে নিয়ে যান ঠ। দ্রুত গাড়ির দিকে এগোলেন তিনি, আমি পেছনে। মাথা ঢাকা, মুখ ঠাকা, চোখ ঢাকা আমি। তারপরও বাইরের হঠাৎ আলো আমার চোখ ধাঁধিয়ে দেয়। মনে হয় চোখ বুঝি অন্ধ হয়ে গেছে। দীর্ঘ দুমাস পর দিনের আলো চোখে পড়ছে আমার। চোখ পারি না খুলে রাখতে, অনেকটা অন্ধের মত, জন্মান্ধের মত আমাকে শাদা আলোয় দাঁড়িয়ে থাকা শাদা গাড়ির দিকে যেতে হয়। আমাকে আড়াল করে এগোন ঠ, আশেপাশের বাড়ির জানালা থেকে কেউ এদিকে চোখ ফেললে যেন চিনতে না পারে যে এ আমি। ছোটদা চালকের আসনে, পাশে গীতা। পেছনে মিলন। পেছনের আসনে বসার সঙ্গে সঙ্গে ছোটদার কণ্ঠস্বর শুনি, শুয়ে পড়। মুখ মাথা ঢাকা, চোখ বোজা, শুয়ে পড়ি। ব্যস্ত সড়কে গাড়ি চলতে থাকে। গাড়ি কোথায় চলছে তার কিছুই বুঝি না। গাড়ি দ্রুত চলে, গাড়ির পেছন গাড়ি চলে। ভেঁপুর শব্দে কান ফেটে যায়। মনে হয় যেন এক্ষুনি দুর্ঘটনা ঘটবে, মনে হয় এই বুঝি কেউ গাড়িটিকে থামাবে। ছোটদা ট্রাফিকের লাল বাতি মানছেন না টের পাই একটু পর পর গীতার ভয়ার্ত স্বর শুনি, ‘কামাল কি করতাছো! ধাককা লাগবো, গাড়ি আস্তে চালাও।’ গাড়িটি যে কেউ থামিয়ে ফেলতে পারে, পুলিশ পারে, কোনও দাড়িটুপির দল পারে। যদি থামায় গাড়িটিকে? গাড়িটি আমার, এ গাড়ির নম্বর ছাপা হয়েছে পত্রিকায় বহুবার। কেউ নিশ্চয়ই মনে রেখেছে নম্বর! গাড়ির গা ঘেঁসে যে রিক্সাগুলো যাচ্ছে সেসবের আরোহীরা গাড়ির জানালায় চোখ ফেললেই দেখবে কুখ্যাত তসলিমা শুয়ে আছে গাড়ির পেটে। বাস থেকে, ট্রাক থেকে, জিপ থেকে অনায়াসে দেখা যায়, দেখে অনুমান করে নেওয়া যায় পেটের মানুষটিকে। মৃত্যুর নীল রংটি ধীরে ধীরে গাঢ় হচ্ছে, আমি স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি! মৃত্যু কোথায় চাও, পথে না আদালতে! মনে মনে বলি, আদালতে। অন্তত আদালতে যদি কোনও সুযোগ থাকে নিজেকে নির্দোষ প্রমাণ করার।
আদালতের ভেতরে গাড়ি ঢুকতে দেওয়া হচ্ছে না। অথচ কথা ছিল পেছন দিক থেকে দোতলায় আদালত কক্ষে ওঠার যে দরজা, ঠিক সেটির সামনে ছোটদা গাড়ি থামাবেন। কিন্তু পুলিশ এই গাড়িটি থামিয়ে দেওয়ায় কোনও উপায় না দেখে গাড়ি ঘুরিয়ে যেখান থেকে আদালত অবদি কম হাঁটা পথ সেখানে থামানো হল। এর চেয়ে সামনে গাড়ি যাবে না আর। ছোটদা বিড়বিড় করে বলছেন, ‘কোর্টরুমে ঢোকার আগ পর্যন্ত কেউ যেন চিনতে না পারে।’ এখন আমাকে বেরোতে হবে। মুখ তুলতে হবে। আমাকে হাঁটতে হবে। ছোটদা, মিলন আর গীতা দ্রুত আমাকে আড়াল করে আদালত কক্ষের দিকে যেতে থাকেন। খুব দ্রুত। এত দ্রুত আমি কখনও হাঁটিনি আগে। ওড়নার ফাঁক দিয়ে যেটুকু দেখা যায়, দেখি আদালত প্রাঙ্গণ ভরে আছে পুলিশে, ট্রাক ট্রাক পুলিশ আর হাজার হাজার মানুষ। টঙ্গীর বিশ্ব ইজতেমায় যেমন গিজগিজে ভিড় হয়, তেমন ভিড়। পুলিশ দেখে আমার ভয় হয় না, ভয় হয় মানুষ দেখে। শুনেছিলাম আজ আমার জামিনের আবেদন খুব গোপনে সারা হবে কিন্তু স্পষ্টতই সে লক্ষণ নেই। হাজার মানুষের ভিড় আদালতের মাঠেই। দোতলায় নির্দিষ্ট কক্ষের দিকে যাওয়ার করিডোরে এত ভিড় যে হাঁটার কোনও উপায় নেই। পর্দানশীন মহিলা যাচ্ছে কোনও কক্ষে, সম্ভবত করিডোরের লোকেরা ভেবেছে যখন আমাকে নেওয়া হচ্ছিল কক্ষের দিকে। খানিকটা সরে জায়গা করে দেয়। কক্ষটিতে এক সুতো পরিমাণ জায়গা নেই। ঠেলে ধাকিকয়ে আমাকে ঢোকানো হল। কালো গাউন পরা ব্যারিস্টাররা বসে আছেন বেঞ্চে। জামিনের আবেদনে এত লোক থাকে না কোনও কক্ষে। মনে হয় এই কক্ষটি জামিনের জন্য নয়, কোনও জটিল মামলার ফাঁসির রায়ের জন্য। সারা হোসেন আমাকে হাত ধরে টেনে নিয়ে বসালেন তাঁর পাশে। কানে কানে বললেন যে তাঁর বাবা দীর্ঘক্ষণ জামিনের পক্ষে বক্তব্য দিয়ে এইমাত্র চলে গেলেন, বড় বোনের বাড়িতে গেলেন, বোন তাঁর মারা গেছেন আজ। কক্ষে আমীরুল ইসলাম আমার উকিল হয়ে কথা বলছেন। সারা হোসেনকে দেখে, ডঃ কামাল হোসেনের বাকি সব সহকারীদের মুখে চেয়ে বুকের ধুকপুক খানিকটা থামে আমার। কক্ষের বেঞ্চগুলো সব ভরে গেছে, বেঞ্চগুলোর পেছনে দাঁড়িয়ে আছে কয়েকশ কালো গাউন। ক আছেন বসে বেঞ্চে। কর পরনেও কালো গাউন। চোখাচোখি হলে একটু হাসলেন। আমার পেছনের বেঞ্চটি থেকে একজন ব্যারিস্টার বললেন আমরা আইন ও সালিশ কেন্দ্র থেকে এসেছি, আপনার পক্ষের লোক, ভয় নেই। এই ভয় নেই বাক্যটি আমার বুকের ধুকপুক আরও খানিক কমালো। নাসরিন, নাসরিন, পেছন থেকে দাদার কণ্ঠস্বর, মাথার কাপড় ফালা, মাথার কাপড় ফালা। পেছন ফিরে দাদাকে ভিড়ের মধ্যে এক পলক দেখি। ওই এক পলক দেখেই স্বস্তি হয় আমার, কিন্তু মাথার কাপড় আমি ফেলে দিই না। হঠাৎ জানালায় চোখ পড়তেই দেখি জানালার ওপারে শত শত অচেনা মানুষের মুখ, মুখগুলো সব আমার দিকে, চোখগুলো, নাকগুলো, ঠোঁটগুলো, সব ভীষণ-ভাবে বিকট-ভাবে আমার দিকে। লোকগুলো আদলতের কোনও বিচারক নয়, উকিল নয়। লোকগুলো বাইরের। কারা এরা, কি উদ্দেশ্যে এসেছে। এদের মধ্যে কি নেই ইসলামী ঐক্যজোটের লোক! সম্মিলিত সংগ্রাম পরিষদের লোক! নিশ্চয়ই আছে। কদিন থেকে প্রতিদিন এইসব খুনীগুলো আদালতে ভিড় করছে আমি আসবো এই আশায়। এদের কারও পকেটে নিশ্চয় আছে কোনও পিস্তল, কারও হাতে নিশ্চয়ই কক্ষটি ধ্বংস করে দেওয়ার বোমা, যে কোনও সময় আমাকে লক্ষ্য করে ছুঁড়বে। আমীরুল ইসলাম আমাকে তাঁর পাশে দাঁড় করিয়ে বললেন, মহামান্য আদালত, আসামী হাজির। আসামিকে মাথা নত করে আদালতকে সম্মান দেখাতে বলা হয়। আসামী সম্মান দেখাতে ভুলে যায়, আসামীর চোখ বার বার চলে যায় জানালায়, জানালার ওপাশের জটলায়, ভীষণ ভিড়ে, চিৎকারে। আগে আত্মসমর্পন করেননি কেন? প্রশ্নটি আসামির দিকে ছুঁড়ে দেন বিচারক।