জ্যঁ শার্ল আমাকে হোটেলে পৌঁছে দিয়ে চলে যায় টেলিভিশনে। ওখানে আমার দেওয়া বাংলা সাক্ষাৎকারের ফরাসি অনুবাদ করার দায়িত্ব পেয়েছে সে। জিল হোটেলে খবর দিয়ে রেখেছে আমি যেন ফিরেই একবার তাকে ফোন করি। ফোন হাতে নিয়ে বসে থাকি। ইচ্ছে করেই জিলের ফোন নম্বরটি আমি ভুলে যাই। ক্রিশ্চান ফোন করে, ‘উফ তোমাকে তো পাওয়াই যায় না সুন্দরী, করছ কি সারাদিন! বল, সেদিনের সেমিনার কেমন হল? নিশ্চয়ই খুব হাস্যকর! নিশ্চয়ই তোমার ভাল লাগেনি।’
আমি শান্ত গলায় বলেছি, আমার ভাল লেগেছে।
–বল কি?
–হ্যাঁ ভাল লেগেছে। আমি বেশিক্ষণ ছিলাম না ওখানে। তবে যাদের সঙ্গে কথা হয়েছে, খুব ভাল মানুষ তারা।
ক্রিশ্চান হো হো করে হেসে উঠলেন। বললেন, ‘তুমি এখনও ভাল করে চেনোনি ওদের।’
আমি আর কথা বাড়াইনি। ক্রিশ্চানের আন্তরিক কণ্ঠ বার বার ধ্বনিত হচ্ছে, বল, তোমার –কিছু লাগবে কি না বল।
–না, আমার কিছু লাগবে না।
–কেন লাগবে না! যা কিছুই লাগে, আমাকে বলবে। আমি তোমার সেবায় নিয়োজিত। ভুলো না কিন্তু।
মিশেল ইডেল এলে মিশেলকে আমার হোটেলের ঘরে চলে আসতে বলি। ঘরে বসে দুজন খানিকক্ষণ গল্প করে ক্যাফে দ্য ফ্লোরএ যাই, ওখানে বসে দুদেশের মেয়েদের অবস্থা নিয়ে কথা বলি। কথা হয় ভোট নিয়ে। পঞ্চাশ বছর আগে ফ্রান্সের মেয়েরা ভোটের অধিকার পেয়েছে। মিশেল জানতে চান কবে আমাদের ওদিককার মেয়েরা পেয়েছে এই অধিকার। খুব সোজা, সাতচল্লিশ সালে ব্রিটিশ দূর হল ভারতবর্ষ থেকে, গণতন্ত্রের প্রতিষ্ঠা হল, পুরুষ এবং নারী উভয়েই ভোটের অধিকার পেল। মিশেলের একটি কথায় আমি বিস্ময়ে দুমিনিট কথা বলতে পারি না। সুইৎজারল্যাণ্ডের মেয়েরা নাকি ভোটের অধিকার পেয়েছে উনিশশ একাত্তর সালে।
সে রাত আমার কাটে আন্তোয়ানেত ফুকের বাড়িতে। বিশাল বাড়ি। আন্তোয়ানেতের এক অনুসারী, তাঁরও মিশেল বলে নাম, আমার সাক্ষাৎকার নিলেন ভিডিওতে। আমার বড় অস্বস্তি হচ্ছিল। এত প্রশ্ন এত উত্তর আমার আর সইছিল না। বার বারই শেষ করতে চাইছিলাম, কিন্তু আন্তোয়ানেত ফুকের ইচ্ছে আমার যাবতীয় কথাবার্তা তিনি রেকর্ড করে রাখবেন। কিন্তু কেন? কাজে লাগবে। কি কাজে? তোমার ওপরই একটি তথ্যচিত্র করছি আমরা! আমার অস্বস্তি উত্তরোত্তর বাড়ে।
পরদিন। সকাল নটায় জিল এল হোটেলে। খবর পেয়ে গোসল করে শাদা একটি সার্ট আর বাদামী রঙের একটি প্যান্ট পরে ফুরফুরে মেজাজে নিচে যাই। চা নাস্তা নিয়ে দুজন বসি মুখোমুখি। জিল দাড়ি কামায়নি। আগের সেই কালো জিনস পরনে তার। অমল হাসি ঝলমল করে জিলের মুখে।
–কেমন আছ তসলিমা।
–ভাল। তুমি?
–ভাল। জিল হেসে ওঠে বলে।
কাল রাতে জিল বলেছিল আজ সে কাঁটায় কাঁটায় নটায় আসবে। নটার এক মিনিট দেরি হলে আমি নাকি বেরিয়ে যেতে পারি। মনে মনে বলেছিলাম, যাবোই তো। তোমার জন্য আমি কেন অপেক্ষা করব জিল?
–তোমাকে দুদিন সময় দিলাম জিল। যেন নাতালির সঙ্গে সময় কাটাতে পারো। যেন আমার চাকরি করতে না হয়।
–ওহ না। তসলিমা কি বলছ তুমি! আমি সবসময় অপেক্ষা করেছিলাম তোমার ফোনের।
–তুমি তো ফোন করনি!
–হ্যাঁ করেছি। তুমি নেই।
–সে তো আমি ইচ্ছে করেই নেই। যেন তুমি নাতালির সঙ্গে..
–কি বলছ তুমি!
–হ্যাঁ, সত্যি।
–নাতালির সঙ্গে, তুমি জানো, আমার কোনও গভীর সম্পর্ক নেই। ওর সঙ্গে দীর্ঘ সময় কাটাতে, বিশ্বাস কর, আমার ভাল লাগে না। সময়ই কাটতে চায় না।
তবে কি আমার সঙ্গে ভাল লাগে? মনে মনে বলি তাহলে চলে এলে না কেন!
জিলের নীল দুটি চোখে চোখ রেখে বলি, তিনবার ফোন করেছো। এ কোনও ফোন করা হল? জিল হেসে বলে, ‘ঠিক আছে যাও, প্রতি দশ মিনিট পর পর এখন থেকে ফোন করব। ঠিক আছে?’
আমি বুঝিনা জিলকে দেখলে কেন মনে হয় আমি খুব ভাল আছি। যেন সব ক্লান্তি কেটে গেছে, সব দুর্ভাবনা দূর হয়েছে। আমরা বসে থাকতে থাকতেই নাতালি এল। কাল সে ফোন করেছিল, আজ আমার সঙ্গে দেখা করতে আসবে বলেছে। এই নাতালি জিলের প্রেমিকা নাতালি নয়। নাতালি বনফুরা প্যারিসের সরবন বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা শেখে। আমার খবর পেয়েছে শিশির ভট্টাচার্যের কাছে। শিশির বাংলাদেশের ছেলে, প্যারিসে কয়েক বছরের জন্য বাংলা পড়াতে এসেছেন। নাতালির কাছে খবর পেয়ে তার প্রায় লেজে লেজেই এসেছে নীলরতন, ভোলার ছেলে, প্যারিসে লেখাপড়া করছে। নাতালি মেয়েটি চমৎকার। আমার খুব ভাল লাগে ওকে। যেন ওর অনেকদিনের বন্ধু আমি। নাতালি সুন্দর বাংলা বলে, সুন্দর বাংলা লেখেও। জিল আমার বাংলা লেখা দেখে বলে, এ তো কোনও ভাষা নয়, এ হচ্ছে আর্ট। নাতালি হঠাৎ বলে আমাকে সে ফরাসি ভাষা শেখাবে।
–বাহ বেশ তো শেখাও।
–কি শিখতে চাও প্রথম?
–আমি তোমাকে ভালবাসি।
–জ তেম।
এক এক করে সে লিখল, কেমন আছ, ভাল আছি। কামা সাবা? সাবা। ধন্যবাদ। ম্যারসি। জিলকে বললাম, জিল, জ তেম।
জিলের চোখ মুখ খুশিতে উজ্জ্বল হয়ে উঠল। উত্তরে সে ফরাসি ভাষায় কি বলল বুঝিনি। নাতালি লিখে যাচ্ছে আরও কিছু ফরাসি শব্দ। জিল বলল, ‘আজ সারাদিন কিন্তু তোমার সঙ্গে থাকব। আমাকে ছেড়ে অন্য কোথাও যাওয়া আজ তোমার চলবে না। চলবে না।’ এর মধ্যেই জ্যঁ শার্ল এসে উপস্থিত। গতকাল তিনি ন ঘন্টা টেলিভিশনে কাটিয়েছেন আমার বাংলা অনুবাদ করতে। জিলকে বিগলিত হেসে কেলিয়ে বলে দি আমাকে নিয়ে তিনি অপেরায় গিয়েছিলেন।