সামনে নির্বাচন ফ্রান্সে। আমি জ্যঁ শার্লকে জিজ্ঞেস করি, এরা যদি জিতে যায়!
জ্যঁ ঠোঁট উল্টে বলল, আরে না! এরা খুবই ছোট দল।
যেখানে দাঁড়িয়েছিলাম, সেখান থেকে সরে ল্যুভরের বারান্দায় ধরে হাঁটতে গিয়ে লক্ষ করি, কিছু লোক তীক্ষ্ণ চোখে আমাকে দেখছে। হঠাৎ জ্যঁ আমাকে টেনে উল্টো দিকে ফিরিয়ে দিয়ে বলল, ওদিকে যেও না।
–কেন যাবো না?
–বিদেশিদের ওপর ওদের খুব রাগ। গালাগাল করতে পারে।
–গালাগাল করবে? আমি তো বুঝবও না গালি।
–তুমি না বুঝলেও আমি তো বুঝব।
–কী বলে গালি দেবে?
–বলবে নিজের দেশে ফিরে যা। এখানে এসেছিস আমাদের দেশের সুযোগ সুবিধে ভোগ করতে। আমাদের চাকরি খেতে!
–আমি তো সে কারণে আসিনি। আমাকে তো আমন্ত্রণ জানিয়ে আনা হয়েছে, আমি তো অতিথি।
–তোমার গায়ে তো লেখা নেই যে তুমি অতিথি।
–গালাগাল করলে আমার কী! চল হাঁটি ওদিকে, লোকেরা জট পাকিয়ে কি করছে, দেখে আসি।
–দরকার নেই বাবা। চল এ জায়গা থেকে সরে যাই।
জ্যঁ বড় বড় পা ফেলে উল্টোদিকে হাঁটতে থাকে। জ্যঁকে থামিয়ে বলি, আমার খুব দেখতে ইচ্ছে করছে কি হচ্ছে এখানে। জ্যঁ আমার হাত ধরে টেনে বলছে, চল সরে যাই! হাত ছাড়িয়ে নিয়ে আমি ধমকে উঠি, — গালাগালকে তোমার এত ভয়!
–গালাগাল তো তেমন কিছু না। এরা মেরেও ফেলতে পারে তোমাকে।
–বল কি!
–ঠিকই বলছি। এদের সম্পর্কে তোমার স্পষ্ট ধারণা নেই। এরা খুব ভয়ংকর।
জ্যঁ জোরে হেঁটে হেঁটে বামপন্থীদের মিছিলে আমাকে নিয়ে যেতে চাইছিল। কিন্তু মিছিল ততক্ষণে শেষ হয়ে গেছে। মিছিল আর সভা ছাড়া রাস্তায় খুব লোক নেই। এসময় নাকি প্রতিবছরই ডামে আর বামে কিছু মারপিট হয় রাস্তায়। মারপিট হয়? মারপিট দেখব। গোঁ ধরলে জ্যঁ বলল, ‘ও আশা ছেড়ে দাও। বামের সভা শেষ হয়ে গেছে।’ অগত্যা কাছেই এক ক্যাফেতে দুজন বসে চা কফি খেতে খেতে দেখতে থাকি রাস্তার কিনারের দৃশ্যগুলো। এক লোক মূর্তি সেজে দাঁড়িয়ে আছে, নড়ন চড়ন নেই, সামনে মাথার টুপি উল্টো করে রাখা, কেউ যদি পয়সা দেয়। তিনটে ছেলে মূকাভিনয় করছে। তাদেরও সামনে টুপি। জ্যঁ বলল, ‘এরা সম্ভবত পোলান্ডের ছেলে। ছাত্র। ফ্রান্সে বেড়াতে এসেছে। এভাবেই পয়সা তুলে চলছে।’ বাহ। বেশ তো। বসন্তের প্রথম থেকে একবারে গ্রীষ্মের শেষ অবদি ছাত্র ছাত্রীরা বেড়াতে যায় বিভিন্ন দেশে। যাদের টাকা পয়সা নেই ঘুরে বেড়াবার, তারা রাস্তায় গান গেয়ে, অভিনয় দেখিয়ে, মূর্তি সেজে টাকা উপার্জন করে সেই টাকায় রেলের টিকিট কাটে, থাকা খাওয়ার খরচা মেটায়। আমি ওদের দেখতে দেখতে ভাবি আমাদের দেশের তরুণ তরুণীরা এভাবে বিদেশ ঘুরে বেড়ানোর জন্য মোটেও আগ্রহী নয় কেন! পকেটে টাকা পয়সা না নিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে পড়ার ঝুঁকি কেউ নিতে চায় না কেন! অনেকে এখানে স্কুল কলেজ ছুটি হলেও রেস্তোরাঁয় বাসন মাজার কাজ নিয়ে নেয়, তা থেকে যা উপার্জন করে, তা দিয়ে অন্য দেশে বেড়াতে যায়। মধ্যবিত্ত কোনও ছেলে কি আমাদের দেশে বাসন মাজার কাজ করবে? আমি নিশ্চিত তা করবে না। এতে তাদের মান যাবে। কিন্তু ইউরোপ আমেরিকায় এসে আমাদের শিক্ষিত আদরের দুলালেরা কিন্তু তাই করছে, এতে মান যায় বলে মনে করছে না। আবার এও ঠিক, দেশের রেস্তোরাঁয় বাসন মাজলে কত টাকা আর পাবে! রাস্তায় সং সেজে দাঁড়ালেই বা তাদের কে দেবে টাকা! এখানে ছোট ছোট কাজেও ম্যালা টাকা মেলে। ছোট কাজ বলে ঠকানোর তেমন কোনও রাস্তা নেই। খুব কম করে হলেও ঘন্টায় পঞ্চাশ ফ্রাঁ। বাংলাদেশি টাকায় চারশ টাকা। ঘন্টায় কোন বাসনমাজনেওয়ালাকে চারশ টাকা দেবে আমাদের লোকেরা! তা ই বা দেবে কোত্থেকে! কজনের হাতে টাকা আছে দেশে! চাকরি করে ডাক্তার ইঞ্জিনিয়াররাই যে টাকা রোজগার করে, তা দিয়ে বাড়িভাড়া তো দূরের কথা, প্রতিদিন দুবেলা খাবারও জুটবে না। তাইতো দুর্নীতির আশ্রয় নিতে হয় সবাইকে। পুলিশের দুর্নীতির কথা লোকে হামেশাই বলে! ঘুষ কেন খাবে না একজন পুলিশ! মাসে বেতন কত পায় সে! যে টাকা বেতন পায়, সেই টাকায় তার বউ বাচ্চা নিয়ে তার কি বেঁচে থাকা সম্ভব! দুর্নীতি দমন নিয়ে কত বড় বড় কথা লোকে বলে, কিন্তু দুর্নীতি কোনওদিন ঘুচবে না যতদিন না সকলের উপার্জন এমন হয়, যে উপার্জন দিয়ে থাকা খাওয়া পরার ব্যবস্থা করা যায়। আবার এও ভাবি, বড় দুর্নীতিগুলো বড় বড় লোকেরাই করে। যাদের অনেক আছে। গুটিকয়েকের হাতে অঢেল টাকা। বেশির ভাগ কায়ক্লেশে জীবন চালায়। কোনওমতে মাথা গোঁজার ঠাঁই আর দিনে দুবেলা ভাতের জোগান হলেই আমাদের দেশের বেশির ভাগ মানুষ খুশি। ধনী দেশেই অন্ন বস্ত্র বাসস্থানের পর আরেকটি জিনিসের প্রয়োজন অনুভব করে সবাই, তা হল আনন্দ, স্ফূর্তি। আনন্দ স্ফূর্তিকে আমাদের দেশে মোটেও প্রয়োজনীয় বলে ভাবা হয় না, ভাবা হয় বিলাসিতা। এটি কেন! দর্শনের এই তফাৎ কি দারিদ্র্যের কারণে! নাকি অন্য কোনও কারণ আছে। একবার ভাবি জ্যঁ র সঙ্গে এ নিয়ে আলোচনা করি। পরেই আবার উৎসাহ দেখাই না। ভাবনাগুলো আমার মাথায় যায় আসে। আসে যায়। ভাবনাগুলো কোথাও স্থির হয়ে থাকে না। বাতাসে ধুলোর মত ওড়ে, তুলোর মত ওড়ে। খেই হারিয়ে যায়, আবার ফিরে ফিরে আসে। মানুষ নামের জাতি একটিই। অথচ কী বিভেদ এই মানুষের মধ্যে। কেউ পাবে, কেউ পাবে না। কেউ খাবে, কেউ খাবে না। কেউ সুখে থাকবে, কেউ থাকবে না। কারও সব হবে, কারও কিছুই হবে না। কারও কাছে জীবন মানে আনন্দ, কারও কাছে জীবন দুর্বিসহ। যে শিশুটি জন্মাচ্ছে আজ ফ্রান্সে, আর যে শিশুটি জন্মাচ্ছে বাংলাদেশে, কী তাদের মধ্যে পার্থক্য! মানুষ হিসেবে কোনও পার্থক্য নেই, অথচ কী ভীষণ রকম ভিন্ন অবস্থায় পরিবেশে দুটো শিশু দু দেশে বড় হচ্ছে। আবারও ভাবি খুব কি পার্থক্য? আমি যে প্যারিসের ধনী ক্রিশ্চান বেসের বাড়ি গেলাম, আর ঢাকার গুলশানে এনায়েতুল্লাহ খানের বাড়ি গিয়েছিলাম, কী এমন পার্থক্য দুবাড়ির মধ্যে? কি এমন তফাৎ দু জনের জীবন যাপনে? না, খুব একটা নেই। ধনীরা, সে যে দেশেই হোক, একই রকম আরামে থাকে। তবে গরিবের অবস্থা হয়ত ভিন্ন। বাংলাদেশের গরিব আর ফ্রান্সের গরিব তো একরকম অবস্থায় থাকে না! গরিবের যে চেহারা দেখেছি বেলভিলে, এই যদি গরিব হয়, তবে তেজগাঁর বস্তিকে কি বলা যাবে! দুর্গন্ধ পাগারের ওপর বাঁশ পুঁতে ওর ওপর একখানা তক্তা বিছিয়ে ঘর বানিয়ে গু মুতের মধ্যে জীবন কাটাচ্ছে। তেজগাঁ বস্তির দুর্গন্ধটি প্যারিসের ক্যাফেতে বসেও হঠাৎ আমার নাকে এসে লাগে। চারদিকে বিশ্বায়ন নিয়ে কথা হচ্ছে। কার জন্য বিশ্বায়ন! পৃথিবী ছোট হয়ে আসছে বলা হয়। কিন্তু কাদের কাছে ছোট? বাংলাদেশের একজন সাধারণ লোকের কাছে বিশ্বায়নের অর্থ কি! তাকে তো কেবল শ্রম দিতে হবে ধনীর ধন বাড়াতে। বিশ্বায়নে কেবল তো পণ্যদ্রব্যই এক দেশ থেকে আরেক দেশে অবাধে যাবে। গরিব দেশ থেকে কটা জিনিস বিদেশের বাজারে পৌঁছবে! গরিব দেশের কটা লোক ইচ্ছে করলেই দেশের সীমানা পেরোতে পারবে! গরিব হলে হাত পা কেমন বাঁধা পড়ে যায়। সীমানা কত মাপা হয়ে যায়! স্বাধীনতা কত সীমিত হয়ে যায়! সবাই পৃথিবীরই সন্তান, কিন্তু কারও কারও জন্য এক নিয়ম, কারও কারও জন্য অন্য। কারও জন্য বেঁচে থাকা, কারও জন্য মৃত্যু। কারও জন্য সুখ, কারও জন্য দুঃখ। হঠাৎ সুখ শব্দটি আমাকে দোলাতে থাকে। সুখ কি ধন দৌলত হলেই হয়! তেজগাঁর বস্তির এক মেয়েকে দেখেছি গায়ে ছেড়াঁ কাপড় পায়ে জুতো নেই, মায়ের চুলে বিলি কেটে কেটে উকুন আনছে আর খিলখিল করে হাসছে, রেললাইনের ধারে একটি মাটির চুলোয় শুকনো ডাল পাতা জ্বালিয়ে মেয়ের মা’টি ভাত ফুটোচ্ছে, মাও হাসছে। ওই সময়টিতে মা আর মেয়ে দুজনেই খুব সুখী ছিল। আর এখানে এই প্যারিসে ক্রিশ্চানের বাড়িতে তার অঢেল সম্পদের মালিক স্বামী টনিকে দেখেছি একটি একলা ঘরে বিষণ্ন বসে থাকতে, মোটেও মনে হয়নি তিনি খুব সুখে আছেন।