ফোন পেয়ে জিল বলল, কি খবর তোমার! তোমার ফোনের জন্য অপেক্ষা করতে করতে আমি এখন ক্লান্ত হয়ে গেছি।
–আমার ফোনের জন্য অপেক্ষা করছিলে! কেন তুমি নিজে একবার ফোন করোনি।
–তুমি কখন হোটেলে থাকো না থাকো তার ঠিক নেই। তার চেয়ে, আগেই তো বলেছি, তুমি যখন ব্যস্ত থাকবে না, আমাকে ফোন করো। আমি চলে যাবো তোমার কাছে। এখন বল, কি প্রোগ্রাম তোমার আজকে? আমি চাইছি তুমি আমার সঙ্গে প্যারিসটা ঘুরে দেখ!
–না হবে না। জ্যঁ শার্ল আসবে এখন। বেরোবো। তারপর বিকেলে মিশেল আসবে নিতে।
–এত ব্যস্ততা!
আমি হেসে ফোন রেখে জ্যঁ শার্ল এলে বেরিয়ে পড়ি। জ্যঁ শার্ল গাড়ি আনেনি আজ। রাস্তায় মিছিল মিটিং হচ্ছে, পুলিশ সব জায়গায় গাড়ি চলতে দিচ্ছে না, তাই। মে দিবস আজ। দোকান পাট বন্ধ। অন্যরকম প্যারিসের চেহারা। আমরা হেঁটে হেঁটে জোন অব আর্কের মূর্তির পাশে গেলাম। মূর্তির সামনে প্রচুর ফুল পড়ে আছে। খুব অবাক হলাম শুনে যে চরম ডানপন্থী দল মে দিবসে জোন অব আর্কের পাদদেশে ফুল দেয়, এবং জোন অব আর্ককে ডানপন্থীরাই নিজেদের প্রতীক হিসেবে নিয়ে নিয়েছে। জোন অব আর্কের মূর্তিতে ফুল দিতে চাইলে জ্যঁ শার্ল না না করে উঠল, বলল এতে ফুল দেওয়া মানে তুমিও ফ্যাসিস্ট দলের মত আচরণ করলে।
–বল কি!
–ফ্যাসিস্ট ছাড়া আর কেউ ফুল দেয় না জোন অব আর্কের মূর্তিতে?
–না।
–জোন অব আর্ক তো ফ্রান্সের গৌরব। কেন নয়?
–কারণ চরম ডানপন্থী জাতীয়তাবাদী লিপেনের দলের রানী সে।
–কেন এরকম হল?
–হল কারণ জোন অব আর্ক ফ্রান্সের জন্য ইংরেজদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছে। লিপেনও ভাবছে, তারাও তাই করছে। এই চরমপন্থীরা সব বিদেশি ইমিগ্রেন্টদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করছে। এ হচ্ছে জঘন্য জাতীয়তাবাদ।
–জাতীয়তাবাদ তো আমাদের উপমহাদেশে পজেটিভ একটি শব্দ।
–হিটলার জাতীয়তাবাদী ছিল। ইউরোপে জাতীয়তাবাদ শব্দটি খুব নিগেটিভ। ঔপনিবেশিক শাসন থেকে নিজের দেশকে মুক্ত করার জন্য শোষিতদের জাতীয়তাবাদী হওয়া আর স্বদেশে বসে ইউরোপীয় ঔপনিবেশবাদী শাসককুলের ভিন্ন জাতের প্রতি ঘৃণা পোষা, তাদের দূর দূর করে তাড়ানো আর নিজের জাতের অহংকারে জাতীয়বাদী হওয়া দুটো সম্পূর্ণ ভিন্ন জিনিস।
জ্যঁ শার্ল পেশায় সায়কোএনালিস্ট। তাকে বাইরে থেকে দেখলে মানসিক রোগী মনে হলেও ভেতরে মানুষটি বুদ্ধিমান। আমি ফরাসি ভাষা জানলে অথবা জ্যঁ শার্ল ভাল বাংলা জানলে আমাদের আড্ডা চমৎকার জমতে পারতো, পরস্পরকে আমরা আরও বুঝতে পারতাম নিশ্চয়ই। হাঁটতে হাঁটতে অচিরে আমরা দেখতে পেলাম ল্যুভর মিউজিয়ামের পেছনে একটি খোলা জায়গায় লিপেনের দলের বিশাল সভা। লাল নীল সবুজ হলুদ বেলুন উড়ছে, মঞ্চে বসে আছে কিছু লোক, মঞ্চের সামনে হাজার হাজার মানুষ দাঁড়িয়ে শুনছে বক্তৃতা। বক্তা ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট সোশ্যালিস্ট দলের নেতা ফ্রাঁসোয়া মিতেরোঁর কথা কিছু বলছে, আর শুনে খুশিতে লাফাচ্ছে শ্রোতা। জ্যঁ শার্লকে জিজ্ঞেস করি, মিতেরোঁকে কি বলছে?
–গালি দিচ্ছে।
–কী বলে গালি দিচ্ছে?
জ্যঁ বলল, শুয়োর।
মঞ্চে কেবল পুরুষ নেতাই নন, নারী নেষনীও বসে আছেন। আশ্চর্য, তাঁরা কি গণতন্ত্রের চর্চা করছে মঞ্চের ওপর! এই ডানপন্থী দলটিই তো মেয়েদের চাকরি বাকরি ছেড়ে দিয়ে ঘরে ফিরে যাওয়ার কথা বলছে, বলছে ঘরে ফিরে যেন মেয়েরা শাদা শাদা সন্তানের জন্ম দেয়, কারণ কালো আর বাদামীরা জন্মে জন্মে পৃথিবী দখল করে নিচ্ছে। সুতরাং এই চরম ডানপন্থী বর্ণবাদী ফ্যাসিস্ট দলের উপদেশ হল, মেয়েরা এতকাল ধরে সংগ্রাম করে যে স্বাধীনতা অর্জন করেছে, তা যেন দেশের স্বার্থে শাদা বর্ণের স্বার্থে বিসর্জন দেয়! মিশেল ইডেল বলেছেন সেদিন, লিপেনের দল এরকম একটি আইন তৈরি করতে চাইছে, যে বাচ্চা বিয়োলে মেয়েরা কাজ করে যে টাকা উপার্জন করত, সেই পরিমাণ অথবা তারও চেয়ে বেশি টাকা কাজ না করেই ঘরে বসে পেয়ে যাবে। চাকরি বাকরি করার জন্য মেয়েরা সন্তান জন্ম দিতে আগ্রহী হচ্ছে না, এটি নিয়ে লিপেনের খুব মাথা ব্যথা। তাহলে তো সর্বনাশ গো। মিশেলকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, মেয়েরা কি এখন সন্তান উৎপাদনের যন্ত্র হওয়ার আদিম ব্যবস্থায় ফিরে যাবে বসে বসে টাকা পাওয়ার লোভে? মিশেল বলেছেন, জ্ঞনাহ! ফ্রান্সের অর্থনৈতিক অবস্থা এখন এমন কিছু ভাল নয়। এটি আরও খারাপের দিকে যেতে পারে। মেয়েরা বেকার হওয়ার ঝুঁকি নেবে না। ভাল যে লিপেন ক্ষমতায় নেই।’ আমার আশঙ্কা কবে না জানি আবার লিপেনের দল ভোটে জিতে যায়! ফ্রান্সে ভোট দিতে যাওয়ার লোক খুব কম। ভোটের দিন তারা হয় দূরে কোথাও বেড়াতে চলে যায়, নয়ত ঘরে বসে আরাম করে। ভোটের প্রতি সাধারণ মানুষের এই অনীহার এই সুযোগে আবার লিপেনের দল কোনও দিন না জিতে যায়! তখন কালো বাদামী মানুষের জন্য তো সমস্যাই, শাদা মেয়েদের জন্যও সমস্যা।
বয়স্ক কিছু লোক তাদের এককালের বুকে ব্যাজ লাগানো মেডেল লাগানো সেনা- পোশাক পরে এসেছে লিপেনের সভায়। আমরা যেখানে দাঁড়িয়েছি, তার বাঁ পাশেই এক ইয়া মোচঅলা লোক সেনা পোশাকে দাঁিড়য়ে ছিল, জ্যঁ বলল, লোকটি আলজেরিয়ায় যুদ্ধ করেছে। লোকের সঙ্গে একটি বুড়ো কুকুর। দেখে জ্যঁ চোখ বড় বড় করে বলে, কুকুরটিরও ট্রেনিং আছে আলজেরিয়ানদের কামড়ানো। বলে কি! তাই নাকি? জ্যঁ নিশ্চিত স্বরে বলল, নিশ্চয়ই। লোকটির হাতে একটি বড় পোস্টার, ফরাসি ভাষায় কি লেখা আছে জানতে চাইলে জ্যঁ বলল, ইওরোপ এক হওয়ার বিরোধী। জাতীয়তাবাদ যাকে বলে। আমরা ফরাসি, আমাদের জাত অন্য জাতের চেয়ে ভাল। আমরা অন্য কোনও জাতের সঙ্গে এক হব না।