ফ্রান্স থেকে কদিন পরই দেশে ফিরে যাচ্ছি শুনে সকলে অবাক হয়। বিস্ফারিত চোখ একেকজনের।
–ওখানে তো আপনাকে মেরে ফেলবে। দেশে ফেরা আপনার উচিত হবে না।
–দেশে কি আর আমি একা লড়াই করছি। আমার পাশে অনেকে আছেন।
–আপনার জীবন মূল্যবান। আপনাকে লিখতে হবে। দেশে যদি আপনাকে মেরে ফেলে তাহলে লিখবেন কি করে? আপনি ফ্রান্সে থাকুন। লিখতে হলে বেঁচে থাকতে হবে তসলিমা।
–লেখালেখি দেশে বসেই করব। দেশ ছাড়ব না।
–এ কোনও কথা হল? আপনার ভয় করে না?
জীবনের ঝুঁকি নিয়ে অনেকদিন থেকে আছি, এভাবে থাকাটাই এখন অভ্যেসে দাঁড়িয়ে গেছে। লড়াই করে বাঁচতে চাই। পালিয়ে নয়। যদি মরতে হয়, মরে যাবো। এ আর এমন কী! কত লোকে মরছে।
সকলের বিস্মিত চোখের সামনে সাতটা বেজে গেলে আমি উঠে পড়ি। মিশেল আমাকে হোটেলে পৌঁছে দেবার সময় বার বার করে বললেন যেন আন্তোয়ানেতের জন্য কোনও একদিন সময় রাখি। আমাকে নিয়ে তাঁরা প্যারিসের বাইরে কোথাও যেতে চান। আরও অনেক কিছুর ইচ্ছে আছে। সেজেগুজে পাটবাবুটি হয়ে যথারীতি হোটেলে অপেক্ষা করছিলেন জ্যঁ শার্ল। আমার যে অপেরায় যাওয়ার খুব ইচ্ছে ছিল তা নয়, অনেকটা জ্যঁ শার্লকে আহত না করার জন্য, যেহেতু যথেষ্টই করা হয়েছে ইতিমধ্যে, আর কিছুটা জিলকে এড়াবার জন্য আমার এই অপেরায় যাওয়া। জিল বারবারই বলেছে, আমি যেন একটু ফাঁক পেলেই তাকে ফোন করি, ফোন করলেই চলে আসবে সে। আমি চাইছিলাম না জিলকে ফোন করতে। থাকে সে মপঁলিওতে। ফ্রান্সের দক্ষিণ প্রান্তের এক শহরে। আর তার প্রেমিকা বাস করে প্যারিসে। নাতালির সঙ্গে তার সময় কাটানো নিশ্চয়ই আনন্দের, অন্তত আমাকে নিয়ে ঘুরে বেড়ানোর চাইতে। তাছাড়া জিলকে আমার এত ভাল লাগে যে, তার জন্য মন কেমন করা থেকে নিজেকেও একরকম বাঁচাতে চাই। নাহ, জিল নাতালির সঙ্গে সময় কাটাক, আমার জন্য তার সারাদিনটি নষ্ট করার প্রয়োজন নেই। জিল নাতালিকে ভালবাসে, বাসুক। আমার মন যেন এত জিলে পড়ে না থাকে। আসলে, এত চমৎকার না হলেও সে পারত। আমার চেয়ে বয়সে সে চার বছরের ছোট। আশ্চর্য, কখনও কোনওদিন আমার চেয়ে অল্প বয়সের কারও জন্য আমার মন কেমন করেনি। জিলের জন্য কেন করে বুঝিনা।
প্যারিসের নতুন অপেরাটি আধুনিক স্থাপত্যের একটি উদাহরণ বটে। ফরাসি লেখক জর্জ পেরেক এটিকে অবশ্য বড় মাপের পাবলিক টয়লেটের সঙ্গে তুলনা করেছিলেন। ফরাসিরা শহর ভর্তি চমৎকার পুরোনো স্থাপত্যের মধ্যে হুট করে একটি বেঢপ দালান তুলতে মোটেও রাজি ছিল না। রাস্তায় নেমে রীতিমত আন্দোলন করেছে নতুন অপেরাটির নির্মাণের বিপক্ষে। আন্দোলনে কাজ হয়নি, শেষ অবদি ফরাসি নন্দনতাত্ত্বিকদের বিচারে যে বস্তুটি একটি কুৎসিত স্থাপত্য, সেটিই আধুনিক অপেরা হিসেবে ঠিক ঠিক দাঁড়িয়ে গেল। অপেরায় আমাদের জন্য অপেক্ষা করছিল জ্যঁ শার্লের স্ত্রী নাতাশা। আমাকে মাঝখানে বসিয়ে দু পাশে বসে গেল দুজন। নাতাশা নাদুস নাদুস মেয়ে। তার হাঙ্গেরিয়ান মা ওয়ার এণ্ড পিস পড়ে এত মুগ্ধ হয়েছিলেন যে কন্যা জন্মালে নাম রাখলেন নাতাশা। নাতাশা আর জ্যঁ শার্ল তাদের ছেলের নাম রেখেছে সত্যজিৎ। শুনে এত ভাল লাগে। প্যারিসের রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে সেদিন দেখেছি সত্যজিৎ রায়ের ছবি চলছে, সাতদিনের সত্যজিৎ উৎসব। আনন্দে এমনই ভেসেছিলাম যে চোখে জল চলে এসেছিল। হয় এমন।
এখানকার নাটক থিয়েটারের শেষে যে জিনিসটি হয়, তা আমাদের দেশের নাট্যমঞ্চে দেখিনি। নাটকের শেষে শিল্পীরা যখন সবাই মঞ্চে এসে দাঁড়ায় বিদায় জানাতে, দর্শকরা তাদের করতালি দিয়ে অভিনন্দন জানায়। কিন্তু দর্শকের যদি কোনও নাটক খুব ভাল লাগে, সেই করতালি আর সহজে থামে না। যতক্ষণ না থামে ততক্ষণ বার বারই শিল্পীদের মঞ্চে এসে এসে অভিনন্দন গ্রহণ করতে হয়। অপেরা থেকে রেস্তোরাঁয় রাতের খাবার খেতে গিয়ে রেস্তোরাঁয় একটি টেবিল পেতেই আমাদের অপেক্ষা করতে হয় এক ঘন্টা। অনেক রাত অবদি রেস্তোরাঁয় বসে তরুণ তরুণীর পরস্পরকে যথারীতি জড়িয়ে ধরা, একশ লোকের সামনে চুমু খাওয়ার দৃশ্য দেখতে দেখতে গল্প করতে থাকি। গল্পে গল্পে এইডসের প্রসঙ্গ ওঠে। নাতাশা আর জ্যঁ শার্ল দুজনেই বলল, প্রায় প্রতিদিনই এই রোগে কেউ না কেউ মারা যাচ্ছে ফ্রান্সে। তিরিশ হাজার ফরাসি এইডস রোগে ভুগছে। ইউরোপের মধ্যে ফ্রান্সেই সবচেয়ে বেশি এইডস রোগী। ফরাসিদের মধ্যে এখন সচেতনতা বেড়েছে। এইডসের ভয়ে অনেকে আগ্রহ হারাচ্ছে যৌনসম্পর্কে, এমনকী প্রেমেও। এইডসের রোগীরা ক্রমে ক্রমে নিঃসঙ্গ হয়ে যাচ্ছে, কেউ মিশতে চাইছে না, কাজ করতে চাইছে না তাদের সঙ্গে। এসব মন খারাপ করা ঘটনা শুনে হোটেলে যখন ফিরে আসি আমি, বড় ক্লান্ত। শরীরটিকে বিছানায় এলিয়ে দিয়ে চোখ বুজে আসার আগে চোখ পড়ে জিলের দেওয়া লিস ফুলে। কি সুন্দর ফুটে আছে ফুলগুলো। জিল কেমন আছে। কী করছে! নিশ্চয়ই ঘরে নেই। শনিবার রাতে কেন সে ঘরে থাকবে! নাতালিকে নিয়ে নিশ্চয়ই রাতের প্যারিস জুড়ে আনন্দ করছে। যারা যারা ফোন করেছিল, হোটেলের লোক কাগজে লিখে রাখে। নামগুলোর ওপর দ্রুত চোখ বুলিয়ে জিলের নাম খুঁজি। নেই।
১. প্যারিসের ডায়রি – ০৪
পরদিন পয়লা মে। ঘুম ভাঙে ফোনের কর্কশ শব্দে। জিল হলে শব্দটি হয়ত এত কর্কশ মনে হত না, ক্যামেরুনের সাংবাদিক পিয়েস বলেই হয়। আজও তার একসঙ্গে নাস্তা খাওয়ার আবদার। এক হোটেলে পাশের ঘরে থাকছে, অথচ দেখা হচ্ছে না, কথা হচ্ছে না। কাল চারটের সময় চা খাওয়ার কথা ছিল, ফিরতে পারিনি চারটেয়। নটায় নিচতলায় নেমে পিয়েসএর সঙ্গে নাস্তা করলাম। আমার পরনে ছিল সার্ট প্যান্ট, খাচ্ছিল!ম শখের সিগারেট। পিয়েস বলল, তুমি কি মুসলিম দেশে এরকম পোশাক পরতে পারো, সিগারেট খেতে পারো? আমি বললাম, সার্ট প্যান্ট পরা যায়, তবে রাস্তাঘাটে খুব য়চ্ছন্দে চলাফেরা করা যায় না। আর মেয়ে হয়ে সিগারেট খেলে লোকে ছি ছি করে। পিয়েস হেসে বলল, ক্যামেরুনে এসবে কোনও অসুবিধে নেই। পিয়েসের আরেকটি আবদার, আমার একটি সাক্ষাৎকার তার চাইই চাই। জ্ঞচলুন আমার ঘরে যাই, ওখানে আমার রেকর্ডার আছে। বাড়তি শব্দ কম হবে ঘরে।’ আমি সঙ্গে সঙ্গে পিয়েসের আবদার নাকচ করে দিই। যদিও তাকে রজার মিল্লারের মত দেখতে লাগে, তবু দানবের মত বিশাল দেখতে লোকটির ঘরে গিয়ে সাক্ষাৎকার দিতে আমার মোটেও ইচ্ছে হয় না। কী জানি, ভয় ভয়ও হয়ত করে। এটি কি, আমি জানি না, মস্তিষ্কের গোপন কোনও কোষে, বিশ্বাসের মত আছে, কালো কুচকুচে কিছু মানেই ভূত বা ওই জাতীয় ভয়ংকর কিছু। জ্যঁ শার্ল আসার আগে, জিলকে করব না করব না করেও ফোন করি।