আমি মরা কণ্ঠে এডেনকে জিজ্ঞেস করি, তুমি কি ঘরে ছবি তুলবে, না কি বাইরে? সুন্দরী এডেন মধুর হেসে বলল, বাইরে।
বাইরে?
ইতস্তত করি।
এডেন আবারও হেসে বলল, দূরে নয়। কাছেই। কাছেই পেলে দ্য রয়াল। ওখানকার বাগানে।
খুব তাড়াতাড়ি করতে হবে কিন্তু। বেশি সময় নেই আমার। কারণ.. ক্রিশ্চানের দিকে যতটা সম্ভব না তাকিয়ে বলি, কারণ মিশেল এসেছে আমাকে নিতে, সেমিনারে যেতে হবে।
ক্রিশ্চান হা হা করে উঠল, কিসের সেমিনার? কোন সেমিনার? তুমি না অপেরায় যাচ্ছ! জ্যঁ শার্ল তোমাকে নিতে আসবে। ও টিকিট করে রেখেছে।
এবার আমাকে একটি পক্ষ নিতে হবে। ক্রিশ্চান বিদেয় হলে এখন আমি বাঁচি। এ সময় মিশেলকে ফিরিয়ে দেওয়া আমার উচিত নয়। এত বড় অমানবিক কাজটি করা আমার পক্ষে সম্ভব নয়। কিছুক্ষণের জন্য হলেও আমি সেমিনারে যাবো, কথা যখন দিয়েছি, যাবই।
ক্রিশ্চানকে এড়িয়ে আমি বলি, চল একটা ট্যাক্সি ডাকি, এডেন মিশেল আর আমি একসঙ্গেই চল বাগানটিতে যাই। ওখান থেকে মিশেল আর আমি চলে যাব।
ক্রিশ্চান গাড়ির দিকে যাচ্ছে, যেন আমার কথা শোনেনি, বলল, চল চল বাগানে চল, আমি তোমাদের দুজনকে নিয়ে যেতে পারব। এডেন এসো, তসলিমা এসো।
আরে বাবা মিশেল কোথায় যাবে! মিশেলের কি হবে? মিশেল হতভম্ব দাঁড়িয়ে ছিলেন। আমি তাঁর হাত ধরে বললাম, আপনিও চলুন।
মিশেল গাড়িতে উঠতে যাচ্ছেন, ক্রিশ্চান বলেন, আমার গাড়িতে তো দুজনের বেশি জায়গা হবে না।
হবে হবে। আমি বলি, সামনে আমি বসছি। পেছনে ওরা দুজন বসবে, জায়গা হবে না কেন! ঠিকই হবে।
ক্রিশ্চান ভেতরে গজগজ করছেন তা ঠিকই বুঝি। বাগানে ফটাফট কটি ছবি তুলে আর সময় দিতে পারব না বলে কেটে পড়ি। মিশেল একটি ট্যাক্সি ডেকে দাঁড় করিয়ে রেখেছিলেন, ওতে উঠে পড়ি। দুজনে কথা বলতে থাকি বিরতিহীন, যেন অনেককালের সম্পর্ক আমাদের। আমাকে মিশেল নিয়ে গেলেন অনুষ্ঠানে, বিশাল সেমিনার কক্ষটির মঞ্চের দিকে, যে মঞ্চে বসে আছেন কয়েকজনের সঙ্গে হুইল চেয়ারে একজন, সেই একজনের দিকে, আন্তোয়ানেত ফুকের দিকে। ষাট দশকের নারী আন্দোলনের নেষনী এই ফুক। এখন ইউরোপীয় পার্লামেণ্টে সোশাল ডেমোক্রেটিক পার্টির সদস্য। এডিশন দ্য ফাম নামের প্রকাশনীর মালিক প্রকাশক তিনিই। তাঁকেই মিশেল ইডেল গুরু মানেন। ফুকের সঙ্গে করমর্দন হল। হাসি বিনিময় হল। চুমোচুমি হল। মঞ্চ থেকে ঘোষণা করে দেওয়া হল আমার আগমন বার্তা, তসলিমা শব্দটি শুধু চিনতে পারলাম একগাদা ফরাসি শব্দের ভিড়ে। সঙ্গে সঙ্গে বিশাল ঘর ভর্তি নারী পুরুষ প্রচণ্ড হাততালি দিতে শুরু করলেন, হাততালি দিতে দিতে দাঁড়িয়ে গেলেন সকলে। এমন দৃশ্য আগে কখনও দেখিনি। এত মানুষ আমাকে অভিবাদন জানাচ্ছেন। আমি অভিভূত। বিস্মিত। শিহরিত। কিছুটা বিব্রতও। চোখে আমার জল চলে এল। আজ কি সত্যিই এখানে এসে পৌঁছেছি আমি! এ কি আমার জন্য অতিরিক্ত নয়! এত আমার প্রাপ্য ছিল না। আমাকে কিছু বলতে বলা হল মঞ্চে দাঁড়িয়ে। কী বলব! কী কথা বলা যায় এখানে। সকলের চেয়ারের সামনে লেখার জন্য টেবিল। নারীবাদের ওপর দামি দামি কথাবার্তা হচ্ছিল এখানে, সকলে লিখে নিচ্ছিলেন আলোচনার গুরুত্বপূর্ণ অংশগুলো। সব থামিয়ে দেওয়া হল আমি বক্তৃতা দেব বলে! কোনও কিছু কি আমি বলতে পারবো যা এঁদের কাছে নতুন! মিশেল আর আন্তোয়ানেতকে মিনমিন করে বললাম, দেখ আমাকে তো আগে বলা হয়নি যে আমাকে বক্তৃতা করতে হবে! আমার তো কোনও প্রস্তুতি নেই, তাছাড়া আমি ক্লান্ত, আমাকে যেতেও হবে এক্ষুনি। এত অপ্রতিভ বোধ করছিলাম যে বেরিয়েই এলাম। বেরিয়ে এসে মনে হল আহা ওই অভিবাদনের উত্তরে অন্তত ধন্যবাদ জানানো উচিত ছিল।
আমার আর মিশেলের পেছন পেছন কয়েকজন তরুণী বেরিয়ে এল। মিশেলকে বললাম, আমার কিছু বলা উচিত ছিল ওখানে। সবাই নিশ্চয়ই মন্দ বলবে।মিশেল হেসে আমার কাঁধে হাত রেখে বলল, ‘কী যে বলছ তসলিমা। সবাই ভীষণ খুশি তোমাকে দেখে। তোমার উপস্থিতিটাই বড়। বলতেই যে হবে এমন কোনও কথা নেই।’ সবাই আমরা কাছের একটি ক্যাফেতে গিয়ে বসলাম। এক ফরাসি তরুণী কাঁপা কাঁপা হাতে আমার হাত ছুঁয়ে কাঁপা কাঁপা গলায় বলল, তোমার সঙ্গে পরিচিত হয়ে আমি ধন্য হলাম। ক্যাফেতে আমাকে ঘিরে বসে সবাই আমি কেমন আছি, কি করছি, কি ভাবছি, সবই জানতে চাইছে। বাংলাদেশ সম্পর্কে কিছুই জানে না তারা, জানে কেবল আমাকে। আমার জন্য সবাই দুশ্চিন্তা করছে। ফতোয়ার খবর পাওয়ার পর প্যারিসের রাস্তায় নেমেছিল নারীবাদীরা, বাংলাদেশ দূতাবাসের সামনে দাঁড়িয়ে থেকেছে আমরা তসলিমার সমর্থক লেখা বড় বড় প্ল্যাকার্ড নিয়ে। তারা আমার লেখা পড়তে চায়। কবে বেরোবে বই জানতে অস্থির হয়ে ওঠে। হবেই তো। পৃথিবীর অপর প্রান্তে কোনও এক বন্যা আর ঘূর্ণিঝড়ের দেশের এক মেয়ে নারী স্বাধীনতার কথা লিখতে গিয়ে ফতোয়ার শিকার হয়েছে, কী লিখেছে সে যে এত লোক ক্ষেপে গেল, তা জানার আগ্রহ তো এদের থাকবেই। মনে মনে ভাবি, এই যে লজ্জা বইটির জন্য এমন অপেক্ষা করে বসে আছে পড়বে বলে, লজ্জায় তো নারীবাদের কথা নেই। কেউ যদি ভেবে থাকে ইসলামের বিরুদ্ধে কিছু বলেছি বলে লজ্জা বাজেয়াপ্ত করেছে বাংলাদেশ সরকার অথবা ইসলামি মৌলবাদীরা আমার মাথার মূল্য ধার্য করেছে তবে তা যে সম্পূর্ণ ভুল তা আমি কী করে কাকে বোঝাবো! ক্যারোল টাং ও অপেক্ষা করছেন আমার বই পড়ার জন্য। ক্যারোল টাং ইওরোপীয় পার্লামেণ্টের মন্ত্রী। তিনিই উদ্যোগ নিয়েছিলেন কুড়ি দফা দাবি পেশ করার, আমার পাসপোর্ট যদি ফেরত না দেওয়া হয়, নিরাপত্তা যদি না দেওয়া হয় আমাকে তবে ইউরোপ থেকে বাংলাদেশের কোনও অর্থ-সাহায্য পাওয়ার বারোটা বাজবে ইত্যাদি। রেসোলুশনটি পাশ হয়েছে এপ্রিলের একুশ তারিখে।