প্যারিস কেমন লাগছে?
এত সৌন্দর্য প্যারিসের, তা আমি আগে কল্পনাও করিনি।
জ্যঁ শার্ল বারথেয়ারকে অনুবাদক হিসেবে নিয়েছে টিভির লোকেরা। একসময় আমি মনিক আতলাঁকে, সাংবাদিক পরিচালক দুটোই তিনি, বলি যে বাংলা থেকে ফরাসিতে অনুবাদ হলে, আমি ইংরেজিতে একই প্রশ্নের উত্তরে যা বলেছি, সেটির সঙ্গে যেন মিলিয়ে দেখে নেন বক্তব্য ঠিক আছে কি না। লক্ষ করিনি জ্যঁ শার্ল আমার পেছনেই দাঁড়িয়ে ছিল। বলল, আপনি বিসওয়াস খরেন না? চমকে উঠি। তাকিয়ে বারথেয়ারের মুখ দেখি বিষণ্ন মুখ। বড় অপ্রস্তুত হই! বলি, ‘না না আপনাকে আমি বিশ্বাস করি। তবু এই আর কী! আপনার তো কিছু ভুল হতে পারে। যেমন ধরুন অনেক কঠিন কঠিন বাংলা শব্দ যদি না বুঝতে পারেন, তাই।’ আমার এই সান্ত্বনায় বারথেয়ারের বিষণ্নতা দূর হয় না। মায়া হয় মানুষটির জন্য। এমন ভাবে বলাটা বোধহয় উচিত হয়নি। ক্রিশ্চান বেস আর মনিক আতলাঁ হাঁটছি কথা বলতে বলতে, ফাঁকে ফাঁকে আমার ব্যাগ আর চশমা হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা বারথেয়ারের বিষণ্ন মলিন মুখটি দেখছি। নীল চোখ তার, ঘাড় অবদি সোনালী চুল, পরনে জিনসের জ্যাকেট — খানিকটা গবেট গবেট মনে হয় তাকে, বারথেয়ারকে, এত স্পর্শকাতর হবে ভাবিনি। কোনও ফরাসি পুরুষ এমন অভিমান করে মলিনতার চাদরে নিজেকে ঢেকে ফেলতে পারে, এই প্রথম দেখলাম। ক্রিশ্চানের গাড়ির কাছে যেতে যেতে সবার থেকে নিজেকে আলগোছে সরিয়ে দু কদম পিছিয়ে নিয়ে বারথেয়ারের সঙ্গে কথা বলতে থাকি আমি। এমনি কথা। ছোটোখাটো কথা। এতদিন আসলে বারথেয়ারকে বিষম এড়িয়ে চলেছি। ক্রিশ্চান যখন আমাকে নিয়ে গাড়িতে উঠবে, বারথেয়ারকে বললাম, আপনিও চলুন আমাদের সঙ্গে, আমরা দুপুরের খাবার খেতে যাচ্ছি, চলুন। বারথেয়ারের মুখটি মুহূর্তের জন্য উজ্জ্বল হয়ে উঠল। কিন্তু ক্রিশ্চান তাকে ফরাসিতে কিছু বলল, কি বলল জানি না। সঙ্গে সঙ্গে বারথেয়ার আমাকে থতমত ঠাণ্ডা গলায় বলে দিল যে সে যেতে পারছে না, জরুরি কিছু কাজ আছে তার। তবে তিনি বারথেয়ার অপেরায় নিয়ে যাবেন আমাকে, অপেরার টিকিট কেটে এনেছিলেন। তিনি বললেন, সাতটায় হোটেলে যাবেন আমাকে অপেরায় নিয়ে যেতে। ক্রিশ্চান আমাকে লেবানিজ একটি রেস্তোরাঁয় নিয়ে গেলেন। মুরগির কাবাবমত, আর কাঁচা বাধাকপি, নানা রকম কাঁচা পাতা, যা কখনও কাঁচা খাওয়া যায় বলে আমার ধারণা ছিল না। খেতে খেতে ক্রিশ্চানের সঙ্গে কথা বলি ফরাসি সাহিত্য নিয়ে। ফরাসি সাহিত্যিকরা কেমন লিখছেন, কী লিখছেন! ক্রিশ্চান সঙ্গে সঙ্গে ঠোঁট উল্টে বললেন, বাজে বাজে বাজে। নতুন প্রজন্মের সবাই আমবিলিকাসের দিকে তাকিয়ে থাকে। ভাবে সবই তো আছে তাদের। তারাই তো জনক শিল্পের সাহিত্যের। সুতরাং নতুন কিছুর আর কী দরকার! ক্রিশ্চান খুবই হতাশ ফরাসি লেখকদের নিয়ে। বললেন, জ্ঞআমি অনেক পাণ্ডুলিপি পাই ফরাসি লেখকদের। সবই অখাদ্য। কেবল বর্ণনা। কিছুই নতুন নয়। নতুন ভাষা নেই। নতুন বক্তব্য নেই।’
১. প্যারিসের ডায়রি – ০৩
ক্রিশ্চান জ্যঁ শার্লকে দিয়ে লজ্জা অনুবাদ করাচ্ছেন। এখন লজ্জা নিয়ে তিনি আর ভাবছেন না। ভাবছেন আমার অন্য বই নিয়ে। জ্যঁ শার্ল লন্ডন থেকে আমার বাংলা বই কিনে এনেছে। শোধ, নিমন্ত্রণ, ভ্রমর কইও গিয়া সবই তাঁর পড়া হয়ে গেছে। শোধের গল্পটি সে ক্রিশ্চানকে শুনিয়েছেন। খাতা কলম বের করে ক্রিশ্চান লিখে নিলেন কি কি বই এ পর্যন্ত লিখেছি আমি। কি কি তাঁকে আমি এখন দিতে পারব ছাপতে। এ পর্যন্ত আমি যা লিখেছি সবই তিনি চান এবং এখন যেটি লিখছি, কোরানের নারী, সেটিও তাঁর চাই। সব তাঁর চাই, যা আছে। কবে পাঠাতে পারব সব। কখন। সব তাঁর জানা চাই। বাংলায় পাঠাই, ইংরেজিতে পাঠাই তাঁর কোনও অসুবিধে নেই। ইংরেজিতে পাঠালে তিনি নিজে অনুবাদ করে নেবেন। বাংলায় হলে বাংলা জানে এমন কাউকে দিয়ে প্রাথমিক অনুবাদ করিয়ে নিয়ে নিজে তিনি সংশোধন করবেন। আমি প্যারিসে থাকাকালীনই তিনি আমাকে দিয়ে কনট্রাক্ট ফর্ম সই করাতে চান। বারবারই বললেন, ‘তসলিমা, তোমার নামকে নয়, আমরা তোমার লেখাকে ছাপতে চাই।’
টেলিভিশনের জন্য ক্রিশ্চানের সাক্ষাৎকার নেওয়া হয়েছে। জিজ্ঞেস করিনি, নিজেই বললেন যে আমার সম্পর্কে জরুরি যে কথাটি বলেছেন তা হল, ‘তসলিমার হাতে একটি অস্ত্র আছে, অস্ত্রটির নাম কলম।’
আমার ঘড়িটি প্যারিসে আসার পথেই বন্ধ হয়ে আছে। ক্রিশ্চানও ঘড়ি পরতে পছন্দ করেন না। এদিকে দিন দেখে বোঝার উপায় নেই কটা বাজে। যে দেশে রাত দশটা অবদি আলো থাকে, কি করে অনুমান করব কখন সে দেশে দুপুর হয়, কখন বিকেল আর কখন সন্ধে। হোটেলে ফিরতে হবে, এডিশন স্টক থেকে ফটোগ্রাফার আসবে ছবি তোলার জন্য। দ্য ফাম প্রকাশনীর মিশেল ইডেল আসবেন। মিশেলএর সঙ্গে আমার দেখা করার ইচ্ছে কারণ মিশেলই প্রথম ফরাসি প্রকাশক আমার সঙ্গে ঢাকায় যোগাযোগ করেছিলেন। দ্য ফাম থেকেই আমার বই চাওয়া হয়েছিল সবার আগে। ওদেরই প্রথম আমি কথা দিয়েছিলাম লজ্জা বইটি ওদেরই দেব। শেষ পর্যন্ত লজ্জা আমি এডিশন স্টককে, ক্রিশ্চানের প্রকাশনীকেই দিই। মিশেল ওদিকে বইয়ের জন্য ফোন করছেন রাত দিন। জ্ঞদেখ তসলিমা আমরাই প্রথম তোমার সঙ্গে যোগাযোগ করেছি, আর তুমি কেন চুপ করে আছ, কেন বার বার ফোন করেও তোমাকে পেতে পারি না। কেন তুমি আমার সঙ্গে কথা বলতে চাইছ না। টাকার প্রয়োজন তোমার? কত টাকা চাও? এডিশন স্টক কত টাকা দিতে চাইছে তোমায়, তার চেয়ে অনেক বেশি টাকা আমরা দেব। তবু লজ্জা ছাপার অনুমতি আমাদের দাও।’ লজ্জা ছাপবেন বলে কনট্রাক্ট ফর্ম পাঠিয়েছেন, নিজেদের ছাপানো বই পত্র পাঠিয়েছেন যেন দেখে সিদ্ধান্ত নিই। বলেছেন, ‘দেখ তসলিমা দয়া করে আমাদের অনুমতি দাও লজ্জা ছাপার। আমরা আং সাং সুচির বই ছেপেছি, সুচি ইউনেস্কো পুরস্কার পেয়েছে। আন্তোনেত ফুক তোমার জন্যও ইউনেস্কো পুরস্কারের ব্যবস্থা করবেন।’ শুনে ভীষণ বিব্রত আমি। আমাকে কি লোভ দেখানো হচ্ছে! আমি তো লোভে পড়ছি না, টোপমাখা বাক্য শুনে বরং লজ্জায় পড়ছি। লজ্জার জন্য দুটো প্রকাশনী এমনই উন্মাদ হয়ে উঠেছে যে মাঝখানে পড়ে আমি লজ্জায় মুখ লুকোই। দুজনকেই আমি বোঝাতে চেষ্টা করেছি, দেখ লজ্জা এমন একটা বই নয় যেটা তোমাদের পাঠকের আদৌ ভাল লাগবে,বইটি বাংলাদেশের সাম্প্রদায়িক সমস্যা নিয়ে লেখা, তার ওপর বইটি তথ্যভিত্তিক বই। ফরাসি পাঠকের এই বই মোটেও ভাল লাগবে না, ওরা বুঝবেও না। না, আমার কথা কেউ মানবেন না। তাঁদের বই চাই, চাইই, যে করেই হোক চাই। ক্রিশ্চানের চাপে আর তাপে বইটি তাঁকে ছাপার অনুমতি দেওয়ার পর মিশেলের জন্য সত্যিই আমার কষ্ট হতে থাকে। লজ্জার মত অসাধারণ একটি বই তিনি পেলেন না বলে নয়, তাঁর ইচ্ছের আমি মূল্য দিইনি বলে তিনি যে কষ্ট পেয়েছেন, সে কারণে। হোটেলে সাড়ে পাঁচটায় পৌঁছে দেখি চারটা থেকে অপেক্ষা করছে এডেন, ছবি তোলার মেয়ে। অপেক্ষা করছে মিশেল ইডেল। মিশেলের বয়স চল্লিশের ওপর। আমাকে আমার দেশে লম্বা মেয়ে বলা হয়, আমার চেয়েও দেড় হাত লম্বা মিশেল, নিখুঁত সুন্দরী। মুখে হাসি লেগেই আছে। ডানে ক্রিশ্চান বামে মিশেলকে নিয়ে আমি তখন কী করি, কোথায় যাই বুঝতে পারছি না। সত্যি, এমন অস্বস্তিকর অবস্থায় আমি আর পড়িনি। সারাপথ ক্রিশ্চান বলে বলে এসেছেন, ‘প্রকাশক একজন থাকা উচিত তোমার এ দেশে। দুজন প্রকাশক থাকবে কেন! কারণ কি বল! এখানে কোনও লেখকই একাধিক প্রকাশককে বই দেন না। তুমি দেখ আমাদের প্রকাশনীটিকে! দেখ আমরা কী ধরনের বই প্রকাশ করছি। কী মানের বই তুমি নিজে এসে দেখে যাও। আজে বাজে ছোট প্রকাশকের সঙ্গে তোমার দেখা করাই উচিত নয়। আমি অবাক হয়ে যাই তোমার রুচি দেখে। দ্য ফাম!! তারা? তাদের তুমি পছন্দ করলে কি করে? তারা সব বাজে। জঘন্য। নারী নারী নারী বলে মুখে ফেনা তুলে ফেলল! যত্তসব। এইসব বাজে জিনিস দেখেই আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি প্রকাশনায় যাওয়ার। তসলিমা, কোনও কিছুর জন্য আমি তোমাকে চাপ দিতে চাই না। দেব না। তোমার অধিকার আছে যা কিছু করার, যাকে খুশি বই দেবার। কিন্তু তোমার তো রুচি থাকা উচিত। অন্তত সামান্য রুচি তো তোমার কাছে আশা করি। তুমি কি করে ওদের প্রস্তাবে রাজি হয়েছিলে? উফ, ভাবতেই পারি না। ভাল যে আমি এসে বাঁচিয়েছিলাম তোমাকে ওদের হাত থেকে। এখন আবার বলছ যে তুমি ওদের সেমিনারে যাবে? তোমার কি মাথা টাথা খারাপ হয়েছে? থার্ড ক্লাস। থার্ড ক্লাস। গেলেই বুঝবে। শোনো, মাথায় যদি তোমার সামান্য ঘিলু থেকে থাকে, তবে আমার কথা তুমি রাখবে, আমি তোমাকে অনুরোধ করছি, যেও না। যেও না ওদের সেমিনারে। নিজের মানটা নষ্ট কেরো না। হাস্যকর পরিবেশে গিয়ে নিজেকে হাস্যকর কোরো না।’ একটি প্রার্থনাই আমি মনে মনে করেছি হোটেলে ফেরার পথে, মিশেল ইডেল আমার জন্য হোটেলে অপেক্ষা করতে করতে আমি ফিরছি না বলে যেন তিনি বিরক্ত হয়ে ফিরে যান। আমার প্রার্থনা কোনও খোদা বা ভগবানের কাছে নয়, এই জগতের রহস্যময় জটিল প্রকৃতির কাছে। প্রকৃতি আমার ডাকে সাড়া দেয় না। মিশেল ইডেল তাঁর হাস্যোজ্জ্বল মুখখানা নিয়ে হোটেলের দরজায় দণ্ডায়মান। আমি আর ক্রিশ্চান মুখোমুখি মিশেলের। আমি এখন কাকে সামলাবো। ক্রিশ্চান মোটেও মিশেলের দিকে ফিরে না তাকিয়ে একদমে বলে যান, ‘তসলিমা, তোমাকে এখন ছবি তুলতে হবে, এডেন বসে আছে অনেকক্ষণ। তাড়াতাড়ি চল। ছবি তুলে তারপর তো তোমাকে অপেরায় যেতে হবে, জানো তো! জ্যঁ শার্ল আসবে ঠিক সাতটায়। মনে আছে তো! তাড়াতাড়ি কর।’