ফজলিখালা কেমন আছে জানি না। ফজলি খালাকে সেই যে বাড়ি থেকে বের করে দিয়েছিলাম, তার পর আর দেখা হয়নি। জীবনে কখনও হয়তো আর ফজলিখালার সঙ্গে দেখা হবে না। রাগ করে তার সঙ্গে চরম দুর্ব্যবহার করেছিলাম, সে কথা ভাবলে আমার, সত্যি বলছি, মন খারাপ হয়ে যায়। ফজলিখালা কি আমাকে ক্ষমা করবে কখনও? কোনওদিন যদি দেখা হয়, তার দুটো হাত ধরে আমি ক্ষমা চাইবো মা। তার ওইহাত স্পর্শ করলে আমার মনে হতেই পারে তোমার হাতই আমি স্পর্শ করেছি। রুনু খালা কেমন আছে, তাও জানি না। সেদিন শুনেছি রাসু খালু মারা গেছে। আজকাল আত্মীয়দের কেউ মারা গেলেও আর জানানো হয় না আমাকে, অনেকদিন পর হয়তো কারও মুখে শুনি। শুনে সারাদিন মন খারাপ থাকে। হাডসন নদীকে হাডসন মনে হয় না, যেন ব্রহ্মপুত্রের পাড়ে বসে আছি রাসু খালা, রুনু খালা, ঝুনু খালা, তুমি, আর আমি, ভাজা মুড়ি আর গরম চা খেতে খেতে গল্প করছি সেইসব দিনের কথা, একাত্তরের যুদ্ধে শহর ছেড়ে যখন রাসুখালুর গ্রামের বাড়িতে উঠেছিলাম, কী যত্ন করেই না রাসুখালুর বাড়ির সবাই আমাদের খাওয়াতো, রঙিন ফুল আঁকা গ্লাসে জল দিতো খেতে, নিজেদের লেপ তোশক বালিশ দিয়ে আমাদের বিছানা করে দিয়ে ওরা শুধু মাদুরে ঘুমোতো।
.
ঝুনু খালা ভিখারুন্নিসা ইস্কুলে পড়াচ্ছে আগের মতোই। অনেকবার বলেছিলাম ছোটদাকে যে আমার বাড়িতে এখন থেকে ঝুনুখালা থাকুক। আমার বাড়ি খালি পড়ে আছে, ঝুনু খালা থাকলে ঢাকা শহরে তার বাড়িভাড়ার খরচটা বাঁচতো। কিন্তু ছোটদা কিছুতেই চায় না ঝুনুখালা থাকুক আমার বাড়িতে। আসলে শান্তিনগরের ওই বাড়িটা, ছোটদা বিশ্বাস করে, ছোটদার। ছোটদাই সিদ্ধান্ত নেয় ও বাড়িতে কে থাকবে না থাকবে। আমি দূরের মানুষ। মৃত। ছোটদা একরকম আমাকে জানিয়ে দিয়েছে, বুঝিয়েও দিয়েছে, যে, বাড়িটা ওর। যেহেতু আমি মেয়েমানুষ, আমার উপস্থিতি যদি না থাকে ও দেশে, আমি একরকম মৃতই, উত্তরাধিকারসূত্রে বাড়িটা এখন ও পেয়ে গেছে। অথবা জোর যার দখল তার তত্ত্বে ও চলছে। এসব যখন শুনি, দেখি, মনে হয় তুমি বোধহয় পৃথিবী থেকে চলে গিয়ে একরকম ভালোই করেছো। তোমাকে হয়তো আরও কাঁদতে হতো। আমাকেও কাঁদতে হয় মা, যতদিন পৃথিবীতে মেয়েদের, শুধু তারা মেয়ে বলে, কষ্ট সইতে হচ্ছে দেখি, আমি না কেঁদে পারি না। ঝুনু খালার জন্য আমার খুব মায়া হয়। তুমি যখন ছিলে, ঢাকা শহরে তার একটা আশ্রয় ছিলো। তুমিও নেই, আমিও নেই। ঝুনু খালার নিশ্চয়ই খুব একা লাগে।
.
মা, আমার জীবন তছনছ হয়েছে আগের চেয়েও অনেক বেশি। হারভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের পাট শেষ হলে, যেহেতু বাংলাদেশের দরজা আমার জন্য বন্ধ, কলকাতায় থাকতে শুরু করেছিলাম। যে ভাষায় আমি লিখি, যে ভাষায় আমি কথা বলি, সে আমার মাতৃভাষা, সে তোমার ভাষা মা। এই ভাষা আমাকে টেনে নিয়ে গিয়েছিলো কলকাতায়। চার বছর থাকার পরপশ্চিমবঙ্গও বাংলাদেশ হয়ে ওঠে। শুধু কলকাতা থেকে নয়, আমাকে ভারত থেকেই তাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। কিছু জঙ্গি মৌলবাদী আমার বিরুদ্ধে চেঁচিয়েছে বলে কোনও সরকারই আমাকে আর ও দেশে থাকতে দিতে চায় না। বাংলার মেয়ের বাংলায় ঠাঁই নেই। এখন উদ্বাস্তুর জীবন আমার, পৃথিবীর পথে পথে অনাথের মতো হাঁটি। তোমার স্বপ্নটাই ঘুরে ফিরে দেখি, ঘরের মেয়ে কি কোনওদিন ঘরে ফিরবে না! মাঝে মাঝে স্বপ্নটাও খুব ধোঁয়ার মতো, কী চাই বুঝি না, মাটি না মানুষ!
.
মা, আমাদেরও তো যাওয়ার সময় হচ্ছে। যে কোনও সময় যে কোনও দিন হুট করে চলে যাবো। কোথায় যাবো, বলোতো! এরকম যদি হত, কোথাও তোমার সঙ্গে আমার দেখা হবে, তোমার সঙ্গে বাকি জীবন আমি কাটাতে পারবো, পৃথিবীর মায়া তুচ্ছ করে চলে যেতাম। আসলে তুমি যখন গেছ, পৃথিবীর জন্য যে মায়া আমার ছিল, সেটি অনেকটা কাটিয়ে দিয়েও গেছ। এখন যেতে আমারও আর আপত্তি নেই। তুমিহীনপৃথিবীটা বড় ফাঁকা, বড় স্নেহহীন, বড় ভালোবাসাহীন, বড় নিষ্ঠুর, বড় কঠিন, বড় স্বার্থপর। কিন্তু আমি তো ভেতরে ভেতরে জানি, কোনও বেহেসতে বা দোযখে তুমি বা আমি কেউ যাবো না। তোমার সঙ্গে কোথাও দেখা হওয়ার, তোমার সঙ্গে একত্ৰ বাসের কোনও সম্ভাবনা নেই। মরে যাওয়ার কথা ভাবলে আজকাল আর অবাক হই না। একে অসম্ভব কোনও ঘটনা বলেও আর মনে হয় না। যার যাওয়ার সে চলে যায়। তবে যেভাবেই যাই, মা, তোমার মতো এত ভুগতে ভুগতে যেতে চাইনা। স্বার্থপরদের ধারে কাছেও মৃত্যুর সময় থাকতে চাইনা। কোনও একদিন হঠাৎ হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে মরে যাবো, কোনওদিন কোনও বিমান আকাশে বিস্ফোরণ ঘটাবে, ছাই হয়ে হয়ে উড়ে যাবো বা কোনও মহাসমুদ্রের অতলে বিলীন হয়ে যাবো। যেন কষ্ট না হয়। যেন তোমার মতো শুয়ে থেকে থেকে আমার মৃত্যুর জন্য অপেক্ষা করা স্বজনদের চোখের অস্থিরতা পড়তে না হয়, যেন দ্রুত মৃত্যু হয়, যেন কেউ কোদাল শাবল আর কাফনের কাপড় হাতে অপেক্ষা করছে দেখতে না হয়। তুমি তো সারাজীবন প্রার্থনা করতে, আমার জন্য বেশি করতে, যেন তোমার আল্লাহতায়ালা আমাকে ক্ষমা করে দেন, যেন আমাকে দোযখে নিক্ষেপ না করেন, যেন দোযখের আগুন থেকে আমাকে রক্ষা করেন। তেমন প্রার্থনাই না হয় কয়রা, এই নিষ্ঠুর পৃথিবী আর এই প্রকৃতির কাছে প্রার্থনা করো যেন মৃত্যু হয় আমার, দ্রুত। যেন আমাকে দেখতে না হয় দোযখের আগুনের চেয়ে যে আগুন বেশি ভয়ংকর, সে আগুন। যাদের ভালোবাসি, তাদের নির্লিপ্তির আগুন, তাদের ভালোবাসাহীনতার আগুন।