মা, ইয়াসমিন আমাকে ঠিক তোমার মতো করে আদর করে। ও যে আমার ছোট বোন, মাঝে মাঝে ভুলে যাই। যেন মা ও। ঠিক তোমার মতোই কষ্ট ও করে যাচ্ছে প্রতিদিন, স্বামী সন্তান ওর হাড়মাংস জ্বালিয়ে যায়। তারপরও ও থেকে যাচ্ছে ওদেরই আঁকড়ে ধরে। মাঝে মাঝে মনে হয় তোমার আর ওর জীবনে কোনও পার্থক্য নেই। কতবার ওকে বের করতে চেয়েছি বাড়ি থেকে, বলেছি চল দুজনে দুরে কোথাও যাই, শুধু আনন্দ করবো ও রাজি নয়। বলেছি তাহলে বাড়ির সবাইকে নিয়ে চল দূরে কোথাও কোনও পাহাড়ের কাছে, বা সমুদ্রের ধারে চল, মন ভালো লাগবে, ও তবুও যেতে চায় না কোথাও, ওকে এক চুল নড়াতে পারি না বদ্ধ ঘর থেকে। ও ঠিক তোমার মতোই ভাবে আমার টাকা পয়সা যেন খামোকা খরচা না হয়। আমাকে বাঁচাতে চায় ও ঠিক তোমার মতো করে। যেখানেই ছিলাম, যে দেশেই, ইয়াসমিনকে দেখতে গিয়েছি প্রায় প্রতি বছরই। ওকে বের করতে পেরেছি একবারই, জোর করেই, প্রায় টেনে হিঁচড়ে। একটা ভাড়া গাড়ি নিয়ে চলে গিয়েছিলাম অতলান্তিকের পাড় ধরে যত শহর আছে, যত পাহাড় পর্বত, সব কিছুর কাছে, নায়াগ্রা জলপ্রপাতেও নিয়ে গেলাম, জলপ্রপাতের ধোঁয়ার মধ্যে, ও যে কী খুশি হয়েছিলো। তুমি বিশ্বাস করো বা না করো, ওকে আনন্দ দিলে আমার মনে হয়, আমি তোমাকে আনন্দ দিচ্ছি। নিউইয়র্ক শহরের ব্রডওয়ে মিউজিকাল শো গুলোতে জোর করে করে নিয়ে গেছি। পূতিগন্ধময় পরিবেশ থেকে বেরিয়ে ও যেন জীবনের সুঘ্রাণ পায়, সুন্দরের স্বাদ পায়। ইয়াসমিনের বাড়িতে একবার আমার হোঁচট খেয়ে পা মচকে গিয়েছিলো, ও আমাকে শুশৃষা করলো ঠিক তোমার মতো করে। ঠিক তোমার মতোই রান্না করে ও, আমাকে তোমার মতো করেই যত্ন করে খাওয়ায়, মুখে তুলে। আমরা দুজন কখনও তোমাকে নিয়ে আলোচনা করি না। খুব সচেতন ভাবেই করি না। তুমি নেই, এ কথা আমরা ভাবতে চাই না বলে করি না। যেন তুমি আছো কোথাও। দূরে আছো, কিন্তু আছো।
.
দাদা আর ছোটদা দুজনই নিজেদের কিডনি নিয়ে অতি সচেতন। যদিও কিডনিতে কিছুই ঘটেনি, কিন্তু বাবার কিডনি নষ্ট হয়ে যাওয়া ওদের ভীষণ ভয় পাইয়ে দিয়েছে। কিডনি নষ্ট হয়ে যেতে থাকলে যে খাবারগুলো খাওয়া বারণ, কিডনি সম্পূর্ণ সুস্থ থাকা অবস্থাতেও তারা ওগুলো মুখে তুলছেনা। তুমি মারা যাওয়ারপরও আমার আরইয়াসমিনের আশংকা হয়েছিলে বুঝি আমাদেরও কোলন ক্যানসার হয়েছে। সারাশরীরে মনে হতো, ক্যানসার। ছুটে ছুটে গিয়ে স্তন, জরায়ু, কোলন কোথাও কোনও ক্যানসারের ছিটেফোঁটা কিছু আছে কিনা পরীক্ষা করিয়েছি।
নানি বেঁচে আছে। তবে নানিকে তার নিজের ঘর থেকে বেরিয়ে যেতে হয়েছে। ফেলু মামার সংসারে আরও জায়গা চাই, সোফা বসাতে হবে, বাড়তি খাট বসাতে হবে, তাইনানিকে একরকম বেরই করে দিয়েছে নানির ঘর থেকে। নানিবাড়ির লাগোয়া উঠোনটার ছোট্ট ঘরটায় যেখানে আমরা ছোটবেলায় একসময় থাকতাম, সেই টিনের ঘরটিতে নানির জায়গা হয়েছে। সারাদিন শুয়ে থাকছে আর নিজের মৃত্যু কামনা করছে। বেঁচে থাকা নানির জন্য এখন লজ্জা। হাশেম মামা নেই, তুমি নেই, টুটু মামাও হঠাৎ একদিন মরে গেল। তিন তিনটে সন্তান বেঁচে নেই, মা এখনও বেশি বয়সেও বেঁচে আছে, এ নানির জন্য লজ্জাই বইকি। অসুখ না থাকলেও অসুখ আছে এমন ভান করতে হয় তাকে, অন্যকে স্বস্তি দিতে। তারপরও নানিকে দেখে লোকে চোখ কপালে তোলে। নানিকে দেখাশোনার দায়িত্ব ছটকুর হাতে। মাঝে মাঝে একটু টাকা পয়সা পাঠাতে চাই নানির জন্য, হয় না মা। যা পাঠিয়েছি এপর্যন্ত, অতি সামান্যই। না মা, নানি আমার কাছে কোনও অর্থকড়ি কখনও চায়নি। নানিকে অনেকদিন ফোনে বলেছি, যেন উঠে হাঁটাচলা করে, যেন পাশের বাড়িগুলোয় বেড়াতে যায়। ছটকুদেরও বলেছি, নানি যে বেঁচে আছে, এ আমাদের সবার জন্য অনেক বড় গর্ব। নানিকে অবহেলা যেন না করে, নানির মৃত্যু কামনা যেন না করে। বলি বটে, কিন্তু নানিকে ওরা যদি বাড়তি বোঝা বলে বিশ্বাস করে, তবে আমিই বা কতটুকু বদ্ধমূল বিশ্বাসের বদল করতে পারবো! তবুও বলি, যদিও সে কথার কোনও মূল্য কারও কাছে নেই। নানির মতো সাহসী মানুষও কী রকম হতাশায় ডুবে থাকে! একটা সভ্য সমাজে মানুষের দীর্ঘকাল বেঁচে থাকাটা রীতিমত উৎসবের ব্যাপার। আর একটা অসভ্য সমাজে যখনই কারও প্রয়োজন ফুরিয়ে যায়, তখনই তাকে খড়কুটোর মতো ফেলে দেওয়া হয়। আসলে অভাব মানুষকে অত ভোগায় না, যত ভোগায় অভাববোধ। অভাবে মানুষ নিষ্ঠুর হয় না; অভাববোধের কারণে হয়। ধনী লোকেরও এই অভাববোধ থাকতে পারে, দরিদ্রের নাও থাকতে পারে। দরিদ্রর যত অভাববোধ দেখেছি, তার চেয়ে বেশি দেখেছি অভাব যাদের নেই, তাদের অভাববোধ। তোমার অভাব ছিল, অভাববোধ ছিল না। তবে সত্যি বলছি মা, নানিকে যতটা সাহায্য করা আমার উচিত ছিল, তার কিছুই করা হয় না। নানি বলে, ওই তোমার মতোই বলে, যেন দেশে ফিরি। চোখ ভিজে যায় শুনে। খুব ইচ্ছে করে নানির কাছে বসেপুরোনো দিনের গল্প করি। শুনি। নানির সঙ্গে গল্প করার সময় কারও নেই। ওই বাড়িটা ভাগ হয়ে গেছে, যে যার ভাগের মধ্যে দেয়াল তুলে দিয়েছে। বাড়ি নাতি পুতিতে গমগম করছে, কারও সময় নেই নানির কাছে এসে দুদণ্ড বসার। একটা ভুলে যাওয়া বাড়তি মানুষ উঠোনের এক কোণে একটা ভাঙা টিনের ঘরে পড়ে আছে। গরমকালে আগুন হয়ে থাকে টিন, আর শীতে অজস্র ফুটো দিয়ে ঠাণ্ডা ঢোকে। নানির জন্য অতি সামান্যই খরচ হয় ছটকুর। নানিরশরীর ঠিক আছেমা, মন ঠিক নেই। অসুস্থতার অভিনয় করতে হয়, মুহুর্মুহু মৃত্যুর কথা বলতে হয় লোককে ভারমুক্ত করতে, লোকের কপালে ওঠা চোখকে কপাল থেকে নামাতে। নানির জন্য খুব কষ্ট হয় আমার। নানি আমাকে অনুরোধ করেছিলো দু সপ্তাহ পর পর যেন তার সঙ্গে ফোনে কথা বলি। দু বছর পার হয়ে যায়, নানিকে ফোন করা হয় না আমার। কেন হয় না জানি না। জীবন বোধহয় এরকমই মা, দূরত্ব আরও দূরত্ব রচনা করে।