.
আমার জীবন সম্পূর্ণই একার জীবন মা। রাজনৈতিক, সামাজিক, বৈষয়িক, ব্যক্তিক, শারীরিক, মানসিক, পারিপার্শ্বিক সব প্রলয় আমাকেই একা সামলাতে হয়। অনেকে বলে, পাশে আছি। এ ঠিক পাশে থাকা বলে না। তারা আমাকে সমর্থন করে, ভালোবাসে, তা ঠিক। এ মনে কিছুটা আনন্দ দেয় বৈকি, কিন্তু দুর্দশায় যখন আমি আক্রান্ত, তখন কেউই আসলে পাশে থাকে না। মনের জোর আমার কম হলে অনেক আগেই আমি মরে যেতাম মা। অথবা যেভাবে বাঁচতাম, সেই বাঁচার কোনও মানে থাকতো না। তোমাদের আমি পুরোনো পন্থার মানুষ বলে কত গালি দিয়েছি। অথচ দেখ, বিয়ে করলাম, ছাড়লাম, বিয়েতে মত হয়তো দাওনি, কিন্তু বিচ্ছেদে বা তালাকে কোনও দ্বিমত তোমাদের কারওর ছিল না। সাধারণত অন্য যে কোনও পরিবারেই স্বামী যেমনই হোক, যত অযোগ্য এবং পাষণ্ডই হোক, কেউ চায় না, বিচ্ছেদ হোক। কায়সারের সঙ্গে বিয়ের বাইরে সম্পর্ক মেনে নিতে তোমার তো কোনওদিন কোনও অসুবিধে হয়নি। তুমি তো চিরকালই সতী সাধ্বী ধর্মকর্ম করা নীতি আদর্শের মানুষ ছিলে। কেন একদিনের জন্যও আপত্তি করোনি! আমার যশ খ্যাতি ছিলো বলে আমাকে ভয় পেতে! না মা, আমার মনে হয় না। আমার মনে হয় তোমার কাছে আমাদের যৌনসম্পর্ককে অযৌক্তিক, অসুন্দর, অবৈধ বলে মনে হয়নি। তুমি বোরখা পরতে, জানি না কেন পরতে, অভ্যেস হয়ে গিয়েছিলো বলে হয়তো। অবশ্য শেষের দিকে কোনও বোরখাপরোনি, সুইডেনে, আমেরিকায়, তারপর দেশেও যে বাইরে বেরোলে, কোনও বোরখার চিহ্ন দেখিনি। মা, তুমি খুব আধুনিক মানুষ ছিলে। সম্ভবত বাড়ির সবার চেয়ে। খুব গভীর ভাবে দেখতে গেলে, আসলে অনেক ক্ষেত্রে বাবার চেয়েও বেশি আধুনিক ছিলে তুমি। বাবা হয়তো বিজ্ঞানমনস্ক বেশি ছিলো তোমার চেয়ে। ক্ষুদ্রতা, হীনম্মন্যতা, কূপমণ্ডুকতা এসবের অনেক ঊর্ধ্বে ছিলে তুমি। বাইরে থেকে বোঝা না গেলেও তোমার অসম্ভব মনের জোর ছিল। কিন্তু মনের জোরে স্বামীর সংসার ছাড়তে পারোনি। আমার মনের জোরের সঙ্গে অর্থের জোর ছিলো বলে পেরেছি। তা না হলে স্বামীর আদেশ নির্দেশ মেনে দুতিন ছেলে মেয়ের মা হয়ে সংসারের ঘানি টানতে হতো কোথাও, বাংলাদেশের কোনও অজপাড়াগাঁয়ে, অথবা শহরে বন্দরে কোথাও। এটা ঠিক, সাংসারিক অশান্তি থাকলেও কোনও রাজনৈতিক অশান্তি থাকতো না।
.
তুমি নেই। তারপরও জগৎ চলছে। তোমার স্বজন আত্মীয়, চেনা পরিচিতরা যে যার মতো আগের মতোই জীবন যাপন করছে। তুমি নেই বলে কারও জীবন কোথাও থমকে নেই। ইয়াসমিনের মানসিক অবস্থা দিন দিন খারাপ হচ্ছে। সুখের ছিটেফোঁটা ওর সংসারে নেই। ভালোবাসা ক্রমশ ভালোবাসাহীন হিংসুক প্রাণী হয়ে উঠেছে। হতাশার গহ্বরে তলিয়ে থাকে ইয়াসমিন, ওকে সবরকম চেষ্টা করেছি জীবনের দিকে ফেরাতে। বাড়ির অস্বাস্থ্যকর চিৎকার চেঁচামেচির পরিবেশেই ও অভ্যস্ত হয়ে গেছে। ফ্লাসিং নামের ওই এলাকায় বছরের পর বছর থেকে যাচ্ছে, একই বাড়িতে, আরশোলা, ছারপোকা আর ইঁদুরের সঙ্গে, অসুখীআর হতাশাগ্রস্ত মানুষগুলোর সঙ্গে। ওর বেড়ানো বলতে, জ্যাকসন হাইটসে বাজার করতে যাওয়া, বা অন্য কোনও দোকানে কেনাকাটা করতে যাওয়া। আজকাল ওকে জোর করেও কোথাও নিয়ে যাওয়া যায় না। কোনও সিনেমা থিয়েটারে, কোনও লেকচারে, বা কনসার্টে, কোথাও নিতে পারি না। অথচ এই ইয়াসমিন টই টই করে ময়মনসিংহ শহর ঘুরে বেড়াতো। কত বন্ধু ছিল ওর। এখন কোনও বন্ধু নেই। মেয়েটা কবিতা আবৃত্তি করত, কী অসাধারণ রবীন্দ্রসঙ্গীত গাইতো। এখন কবিতা, গান, বই সব ওর জীবন থেকে সহস্র মাইল দূরে। আমেরিকায় ভালো কোনও চাকরি করার চেষ্টা করেনি। ভালোবাসার জন্য জীবন উৎসর্গ করেছে একরকম। নিজের জীবন নষ্ট করে মেয়েকে মানুষ করতে গিয়ে দেখে নিজের জীবনও গেছে, মেয়েও মানুষ হয়নি। মেয়ে সারাদিন ইংরেজিতে গালিগালাজ করে মাকে। ইয়াসমিন মনে করে ব্যাপারটা জেনেটিক। মিলনের জিন পেয়েছে ভালোবাসা, দেখতেও মিলনেরমতোও, স্বভাব চরিত্র ব্যবহার সবই মিলন। সুবুদ্ধি, কুবুদ্ধি, চতুরতা, হীনম্মন্যতা সব এক। ভালোবাসা একসময় সুন্দরপদ্য লিখতো, ওকে প্রচুর সাহিত্যের বই কিনে দিয়েছিলাম, না, একটারও পাতা উল্টে দেখেনি। সুহৃদও ভালো লিখতো, খুব ভালো ছিলো কবিতা লেখার হাত। ছবি আঁকতে চাইতো বলে ছবি আঁকার যাবতীয় সরঞ্জাম ওকে দিয়েছিলাম। না কোনওটাই বেশিদিন চালালো না। ওকে প্রেরণা দিয়ে গেছি বছরের পর বছর। শেষ অবধি দেখেছি কারও শিল্পী বা সাহিত্যিক হওয়ার কোনও সম্ভাবনাই নেই। সাহিত্য সংস্কৃতির প্রতি সত্যিকার কোনও আকর্ষণ কারওর নেই। পরিবারে একজন লেখক আছে, এ নিয়ে কোনও গৌরব কারওর নেই। আমার লেখা কেউ পড়েও দেখেনি, আমাকে নিয়ে কারও উৎসাহও নেই। ছোটদা আর গীতার রক্ত সুহৃদের ভেতরে। শুধু রক্তই তো সবনয় মা, পরিপার্শ্ব, সমাজ, সংস্কৃতি এগুলোও একজনের গড়ে ওঠার পেছনে বড় ভূমিকা রাখে। কিন্তু মনে হচ্ছে, পরিপার্শ্ব ছাপিয়ে রক্তটাই আমাদের পরিবারের সবার মধ্যে যেন বেশি কাজ করেছে। সুহৃদ তার বাবা আর মার চরিত্রই পেয়েছে, নিজের কোনও আলাদা চরিত্র নেই ওর। ইয়াসমিন যে জীবনটা যাপন করছে, তা প্রায় একশ ভাগ তোমার জীবন। ইয়াসমিন দেশে ফেরার স্বপ্ন দেখে। ভালোবাসাকে অনেক চেষ্টা করেছে। দেশে ফেরাতে, ও ফিরবে না। ও ফেরে না বলে ইয়াসমিনও ফিরতে পারে না। ভালোবাসা বড় হয়ে কলেজের হোস্টেলে চলে গেলে ভাবছে দেশে ফিরবে, কিন্তু আমি জানি ওর কোথাও ফেরা হবে না। ভালোবাসার টানে ওকে থেকেই যেতে হবে বিদেশ বিভুইয়ে। দেশ তো আসলে শৈশব কৈশোরের স্মৃতি ছাড়া আর কিছু নয়। কিন্তু দেশে ফিরলেই কী আর ও দেশ পাবে। যে দেশে মা নেই, সে দেশ আবার কী রকম দেশ মা! ইয়াসমিন ফিরেছিল, হতাশার গভীর গহ্বর থেকে পালিয়েছিলো, পুরোনো বন্ধুদের কাছে, আত্মীয়দের কাছে। হাসি আনন্দে ছিলো, কলকাতাতেও ওকে ঘিরে উৎসবের আয়োজন করেছি। সব উৎসব আনন্দ ছেড়ে ও আবারও আমেরিকায় ছুটে যায় ভালোবাসার টানে। কিন্তু যেই না মিলনের দুর্ব্যবহারের শিকার হয়, আবারও নিঃসঙ্গতার হাঁমুখ ওকে গিলে ফেলতে থাকে। মিলনকে ছাড়াও ওর চলে না, আবার মিলনকে নিয়েও ওর চলে না। দেশে বিদেশে কত কত মেয়ে আমার প্রেরণায় উঠে দাঁড়ায়, নিজের মতো করে বাঁচে। আর জন্ম থেকে যে আমার ছায়ার মতো ছিলো, সেই বোনটিই পারেনা কিছু।