.
আমার ইচ্ছে করে মামা খালাদের সবার অভাব আমি দূর করি। ওরা তোমারই ভাই বোন। ভালো তো তোমাকে ওরা কিছু হলেও বাসতো। শুধু তোমার ভাই বোন বলে যে ওদের আমি ভলোবাসি নয়। কাকা ফুপুদের চেয়েও মামা খালাদের সঙ্গে স্বাভাবিকভাবেই আমার ঘনিষ্ঠতা বেশি। আমি জন্মেছি ওদের বাড়িতে। শৈশব কেটেছে ওদের কোলে কাখে, ওদের সঙ্গে উঠোনে মাঠে সারা বিকেল খেলে, একই খাবার খেয়ে, ভূতের গল্প শুনে, একই ইস্কুলে পড়ে। ওদের কারও দুঃখ দেখলে মন আমার কাঁদবে না কেন! আশ্চর্য কী, জানো মা, ওদের সঙ্গে দেখা হলে মনে হয় না যে আমাদের দেখা হয়নি অনেক বছর, সেই আগের মতো কথা বলি, সেই শৈশব কৈশোরের মতো। অবশ্য বয়স দেখলে চমকে উঠি, ছটকুর পাকা চুল দেখে, শরাফ মামার হাড়গিলে শরীর দেখে, ফেলু মামার হতাশা দেখে বুকের ভেতরটা হুহু করে উঠেছিলো। ওদের অভাব ইচ্ছে করলেও ঘোচাতেপারি না আমি। শুধু তোমার ভাইবোনের নয়, ইচ্ছে করে তোমার আদরের ওই গরিব ভিখিরিদের দারিদ্র ঘুচিয়ে দিই। কিন্তু কী করে পারবো দূর থেকে, ওদের কাছে পৌঁছোনোর ক্ষমতা আমার নেই। কলকাতায় গিয়ে গরিবদের দুহাত ভরেদান করি। ওখানেও তুমি চারদিকে গরিব দেখতে পাবে। পৃথিবীর সব দেশেই গরিব আছে। গরিবদের জীবন পৃথিবীর সব দেশেই প্রায় একইরকম। তুমি আমার ভবিষ্যতের কথা ভাবতে। আমার সে কথা ভাবতে ইচ্ছে করে না। ভবিষ্যৎ–এই ব্যাপারটাকে আমি আর বিশ্বাস করি না। আমার এক অতীত ছিল। আর আছে এক বর্তমান। অতীতই আমার সম্পদ। বর্তমানটা আমি শুধু যাপন করি। তোমার মৃত্যু আমাকেপার্থিব জীবন থেকে কতটা যে দূরে সরিয়েছে, কতটা নির্মোহ করেছে, তা না দেখলে তুমি বিশ্বাস করতে পারবে না। জীবনে কোনও চাওয়া নেই আমার আর। শুধু দেশে ফিরতে চাই, তুমি আমার দেশে ফেরা চাইতে বলে। তুমি নেই বলে দেশে ফেরার ইচ্ছেটা অনেকটা উবে যায়, কিন্তু যেহেতু তুমি চাইতে ফিরি, ঘরের মেয়ে ঘরে ফিরি, সেই ঘরের মেয়েটি তার ঘরে ফিরে তোমার স্বপ্নপূরণ করতে চায়। দেশের দুয়ার যেহেতুবন্ধ, কলকাতায় বসবাস শুরু করেছিলাম, সে আরও অনেক পরে। কলকাতায় দাদা তার মস্ত এক অসুখ নিয়ে এসেছিলো। হাঁটা চলা করতে পারতো না, কথা বলতে পারতো না ভালো করে। যত বড় বড় ডাক্তার আছে কলকাতায়, সবাইকে দেখিয়ে তার চিকিৎসা করার ব্যবস্থা করি। হ্যাঁ মা, কাড়িকাড়ি টাকা খরচ করি খুব দামি সব চিকিৎসায়। জীবন ঢেলে দিই এই দাদার জন্য, যে দাদা তোমার চিকিৎসার জন্য এক পা নড়তে চায়নি, যে দাদা বাবার মৃত্যুর জন্য দায়ী। তারপরও কী হয় জানি না, দাদাকে অসুস্থ দেখে আমি স্থির থাকতে পারি না। বুঝি এ তোমার কারণেই, তোমার যে চরিত্র আমার ভেতরে স্থায়ী আসন গেড়ে বসেছে, সেখানে উদারতা ছাড়া, ক্ষমা ছাড়া, মায়া মমতা ছাড়া, শর্তহীন ভালোবাসা ছাড়া কিছু নেই। তুমিও তো সেই দাদাকেই ভালোবাসতে, যে তোমাকে ভালোবাসেনি। তুমিও তো সেই মানুষদের কাছে টেনে নিতে, যারা তোমাকে দিনের পর দিন অপমান করেছে। তোমার সেই চরিত্রকে আমি নিন্দা করি বটে, কিন্তু ভেতরে বুঝি, চরিত্রটি আমারও। যে মৌলবাদীরা আমার মুণ্ডু চেয়ে মিছিল করে, সম্ভবত ওদের কাউকে বিপদে পড়তে দেখলে আমিই গিয়ে সবার আগে ওদের বাঁচাবো। মুসলমানদের মধ্যে নাস্তিক বা খুব প্রগতিশীল, সমানাধিকারে, মানববাদে বিশ্বাসী না হলে আমার মতের সঙ্গে একমত তো হবেই না বরং তীব্র নিন্দাই করবে। গোটা একটা সমাজের মানুষের মানসিকতার এই হাল দেখলে অবশ্যই মন খারাপ হয়ে যাওয়ার কথা। তারপরও দেখ, যখন দেখলাম হিন্দু মৌলবাদী দ্বারা ভারতে গুজরাতের মুসলমানরা আক্রান্ত হয়েছে, উদ্বাস্তু হয়েছে হাজার হাজার গরিব মুসলমান, আমি উঠে দাঁড়ালাম। আমি তো মিছিল মিটিং করায় পারদর্শী নই। কলকাতায় বসে কবিশঙ্খ ঘোষ গুজরাতের ওই আক্রান্ত মুসলমানদের সাহায্য করার জন্য টাকা তুলছিলেন, শঙ্খ ঘোষের হাতে দশ হাজার টাকা দিয়ে এসেছি। বলেই দিয়েছি, প্রচারের জন্য নয়। তুমি যেমন দিতে মানুষকে, তোমাকে লোকে ভালো বলুক বা বাহবা দিক, সে কারণে কিন্তু দিতে না। তোমার মন কাঁদতে মানুষের জন্য, তাই দিতে। মানুষ যদি কষ্ট পায়, সে মানুষ হিন্দু হোক, বৌদ্ধ হোক, খ্রিস্টান বা মুসলমান হোক, পাশে দাঁড়াই। তাদের ধর্ম পরিচয়কে আমি কোনওদিন মূল্য দিইনি। মানুষ পরিচয়কেই দিই। খুব বেশি সামর্থ্য আমার নেই। যেটুকু আছে সাধ্য, তার মধ্যে অথবা তার বাইরেও করি বা করার চেষ্টা করি। মানুষের জন্য সবচেয়ে বড় যে কাজটি করি, তা আমার লেখা। কেউ লেখা বোঝে, কেউ বোঝে না। কিন্তু জীবনের ওপর নেমে আসা শত ঝড় ঝঞ্ঝার মধ্যেও লেখা আমি বন্ধ করতে পারি না। তুমিও তোআমার লেখা ভালোবাসতে, শুধু ধর্মকে আক্রমণ করে লিখতে আমাকে বারণ করতে। কিন্তু মা, মেয়েদের স্বাধীনতার কথা লিখতে গেলে সবচেয়ে বড় যে বাধা, ধর্ম, এবং পুরুষতন্ত্র, এদুটোর বিরুদ্ধে কথা না বললে চলবে কেন বলো। বাধা রেখে কি স্বাধীনতা বা অধিকার আদায় করা যায়! বড় বাধার পরও শত শত ছোট বাধা আছে, সেগুলো ডিঙোনোও তো চাট্টিখানি কথা নয়। ছোট ছোট বাধার বিরুদ্ধে বললে লোকেরা খুব আপত্তি করে না। বড় বাধার কথা বললেই বড় বড় লোকেরা আমার লেখায় বাধা দিতে শুরু করে, আমার জীবন তছনছ করে দিতে তাদের কোনও দ্বিধা হয় না। ধর্মের সমালোচনা আর না করলেই যে ধর্মান্ধ, ধার্মিক বা ধর্মব্যবসায়ীরা আমাকে মুক্তি দেবে তা আর হবার নয়। ওদের স্বার্থ উদ্ধার করতে, ওদের শক্তি প্রদর্শন করতে একটা সমাজকে পিছনে টেনে নেওয়ার জন্য, পুরো জগতে ধর্মের আইন কায়েম করতে ওরা আমাকে হত্যা করতে চাইবেই অথবা আমার মুণ্ডু কেটে নেওয়ার জন্য, বা আমার ফাঁসির জন্য রাস্তায় নামবেই। এব্যাপারে তুমি নিশ্চিন্ত থাকতে পারো। আমাকে খুন করে যে কোনও মূর্খ ধর্মান্ধ বেহেসতে যেতে চাইবেই। সারা পৃথিবীতে তাই ঘটছে। ভারত বা বাংলাদেশে কোনও বিচ্ছিন্ন ঘটনা ঘটছে না। আমেরিকার টুইন টাওয়ারের পতনের কথা তুমি জানো না। মুসলমান মৌলবাদীরা আল্লাহর নাম নিয়ে শত শত নিরপরাধ মানুষকে ওই টুইন টাওয়ারের ভাঙনের মধ্যে ফেলে মেরেছে। আমি জানি, ওদের ওই অপকর্মের কথা শুনলে তুমি শিউরে উঠতে। তুমি মরে যাওয়া মানুষগুলোর জন্য দুঃখ পেতে। তোমার কাছেও তো মানুষ সবচেয়ে বড়, যে ধর্মের বা যে লিঙ্গেরই সে হোক না কেন। হিন্দুদের, কাফেরদের ঘৃণা করার জন্য তোমাকে পীরবাড়ি থেকে শিখিয়ে দেওয়া হয়েছিল। তুমি মন থেকে কখনও পারোনি ওদের ঘৃণা করতে। পাশের বাড়ির ডলি পালকে ডেকে এনে গল্প করতে। ওর দুরবস্থায় ওকে সাহায্যও করেছে। এসব আমার নিজের চোখে দেখা। তুমি মানুষ ছিলে মা। সব ধর্মের ঊর্ধ্বে ছিলে, তুমি নিজেই জানতে না যে, ছিলে। তুমি যদি কোরানের অর্থ ঠিক ঠিক জানতে, হয়তো ওই ধর্ম ছেড়ে যোদ্ধার মতো বেরিয়ে আসতে। তুমি তো মূর্খ ছিলে না মা। বুদ্ধিমতী ছিলে। কিন্তু সমাজের নারীবিরোধী সংস্কারের শেকলে বন্দি হতে হয়েছিল তোমাকে, যে বন্দিত্ব থেকে মুক্তি কিছুতেই পেতে পারোনি।