নিচতলায় তোমার ওই ঘরের লাগোয়া কোনও বাথরুম নেই। তোমার ঘরের সামনে একটা ঘর পড়ে আছে যেখানে একটা চেয়ার, নড়বড়ে একটা হলুদ আর কাঠের পুরোনো একটা লম্বা সোফা। টেলিভিশন। একটা বেঢপ কাঠের তাক। তাকে পুরোনো গানের রেকর্ড। এটাকে বৈঠকঘরই হয়তো বলতে হয়, কিন্তু এত করুণ বৈঠকঘর তুমি কি আমার কোনও বাড়িতে দেখেছো? দেখনি। আমার রুচি ছিল, সৌন্দর্য বোধ ছিল। কোনও কাঠখোট্টা অসামাজিক পুরুষের বাড়িতে রুচির আশা করা নিতান্তই বৃথা। ওই বৈঠকঘরের পেছনে একটা আয়তক্ষেত্রর মতো ঘরে হাবিজাবি জিনিস রাখা। ভাঙা টেবিল চেয়ার, মাল নেওয়ানেওয়ির কাগজের বাক্স। কায়ক্লেশে ওসব ডিঙিয়ে গিয়ে এক কোণে ছোট্ট একটি ঘর আছে, ওই ঘরটি প্রথম দিনই তোমাকে দেখিয়ে এনেছি। কাঠের দু সারি বেঞ্চ, সামনে আগুন জ্বালানোর জিনিস। ওই সওনায় বসে লোকে আগুন তাপায়। তারপর ঠাণ্ডা জলে স্নান করে নেয়। কেউ কেউ আবার বাইরের বরফে ঝাঁপিয়ে পড়ে। সওনার ব্যাপারটি নিশ্চয়ই তোমার কাছে অদ্ভুত লেগেছিলো। দেশের বীভৎস গরমে বছর বছর তোমার ত্বকে ঘামাচি বেরোয়, তুমি তিষ্ঠোতে পারো না। আর এদেশে লোকে কিনা গায়ে গরম লাগাতে চায়শখ করে! বুঝতে তোমার অসুবিধে হয়। শীতের দেশের বরফের কথা শুনেছো, বরফ যে ঠিক কী জিনিস, তুমি নিজের চোখে দেখলে একদিন। সেদিন কী যে আনন্দ তোমার। কী যে বিস্ময় তোমার চোখে, কী যে মুগ্ধতা। দেখে আমার খুব ভালো লাগলো। আর কিছু না দেখাতে পারি, আমাকে নিয়ে কোনও উৎসব বা মহোৎসব, অন্তত তোমাকে এ দেশের বরফ দেখাতে পারলাম। কিছু একটা দেখলে জীবনে, যা জীবনে দেখনি কোনওদিন। শুধু কী বরফ, যা তুমি আগে কখনও দেখনি, তাও তো দেখলে, দেখলে ঝাঁক ঝাঁক অন্ধকার। আলোর মুখ দেখছো না তুমি। দুপুরের দিকে একটু আবছা আলো যাও আসে, ঝুপ করে আঁধার নেমে যায় ওর ওপর। দেখলে আমরা জানালায় বাতি জ্বালিয়ে রাখি শীতকালে। কত নতুন কিছু দেখছো, বোঝালে বুঝছও। কিন্তু তোমার যে বিদেশের নাড়ি নক্ষত্র জানার আদৌ কোনও আগ্রহ আছে, তা আমি টের পাই না। যতটুকু দেখ, আমাকে খুশি করতেই দেখ। যা শোনো, আমাকে আনন্দ দেবার জন্যই শোনো। তোমার আগ্রহ আমাকে নিয়ে। আমি ডানে গেলে তুমি ডানে যাবে, বাঁয়ে গেলে বাঁয়ে। পেছনে হীরের খনি পড়ে থাকলেও ফিরে তাকাবে না তুমি।
কেমন ছিলে মা তুমি ওই ছোট্ট ঘরে? ওপরে আমি, আমার শোওয়ার ঘর, ওপরে খাবার টেবিল রান্না ঘর, ওপরে সব। আর তুমি নিচে। তুমি একা। কেমন ছিলে মা? তুমি হয়তো ভেবেছিলে আমার সঙ্গে রাতে শোবে তুমি, আমার সঙ্গে ঘুমোবে প্রতিরাতে। গায়ে হাত বুলিয়ে দেবে, চুলে বিলি কেটে দেবে। সেই পুরোনো দিনের মতো রূপকথার সেই প্রিয় প্রিয় গল্পগুলো শোনাবে, গান শোনাবে। শুনতে শুনতে একসময় ঘুমিয়ে পড়বো, ছোটবেলার মতো। এরকম নিশ্চয়ই ভেবেছিলে যখন দেখতে আসছে আমাকে। একটি রাতও তো ওইনিচের ঘরে তোমার সঙ্গে ঘুমোইনি আমি। খুব একা লাগতো তোমার? কাঁদতে? একাই তো ছিলে সারাজীবন, আমার কাছে এসেও সেই একাই রয়ে গেলে। যে তোমার একাকীত্ব কোনওদিন অনুভব করেনি, হঠাৎ করে সে কেন এখন অনুভব করতে যাবে! বিদেশ বলে? দেশ আর বিদেশে হাজার ফারাক থাকুক, চুরানব্বই সাল আর সাতানব্বই সালের ব্যবধান থাকুক, আমি সেই আমিই ছিলাম। বয়স বেড়েছে, শরীরে পাল্টেছে, মন পাল্টায়নি। তোমাকে না বোঝার মন।
তুমিও এলে, আর আমারও বই লেখার শখ হলো। এমন লেখা নিয়ে পড়েছিলাম যে দিন রাত আর কিছুর ভাবনা ছিল না আমার। সেই চুরানব্বইয়ে এসেছিনির্বাসনে। চুরানব্বইপঁচানব্বই ছিয়ানব্বই চলে গেল সামান্য কিছু কবিতা ছাড়া লিখিনি কিছু, সাতানব্বইএর নভেম্বর থেকে আদাজল খেয়ে লিখতে আরম্ভ করলাম। সাহিত্যিক হয়ে উঠলাম হঠাৎ। যে সেবইনয়, রীতিমত আত্মজীবনী। আত্মজীবনী লেখার ভাবনা কোত্থেকে এলো, কেন এলো জানি না। সম্ভবত তুমি আমার সেই ছোটবেলার কথা স্মরণ করছিলে বলে। পুরোনো দিনের কথা তুমি বলছো, আর আমি পরিকল্পনা করছি ওই স্মৃতি নিয়ে বই লেখার। বই যখন লিখছি, বইই লিখছি, আর কিছু করার আমার সময় নেই মোটেও। তুমি অসুখ শরীরে আমাকে চা বানিয়ে দিতে, রান্না করতে, আমাকে খাওয়াতে, বাসন কোসন মাজতে, ঘরবাড়ি গুছিয়ে রাখতে। কাউকে নেমন্তন্ন করতাম তো তাদের সবার জন্যই রাঁধতে, সবারই এঁটো বাসন মাজতে। আমার চুল আঁচড়ে দিতে। গায়ে লোশন লাগিয়ে দিতে। বসে থেকে থেকে পা ফুলে গেলে সেই পা মালিশ করে করে ফোলা কমিয়ে দিতে। সারাদিন তুমি আমার যত্ন করতে, যেমন করতে দেশে। তোমার দিকে ফিরে তাকাতাম না আমি, দেশেও যেমন তাকাতামনা। যেমন একা কাটাতে, তেমনই একাই কাটিয়েছো আমার সঙ্গে। তবে তোমাকে যে সবসময় দূরে সরিয়ে রাখতাম তা নয়। তোমাকে কাছে ডাকতাম তথ্যের জন্য। নানা নানি, দাদা দাদি, তোমার ইস্কুল, তোমার বিয়ে হওয়ার কাহিনী, তোমার শ্বশুর বাড়ির লোকজন, তোমার বাপের বাড়ির সবাই কে কেমন ছিল, কী কী ঘটতে দেখেছো, খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে জিজ্ঞেস করতাম সব। তুমি বলতে, তবে বুঝে পেতে না এত অজরুরি তথ্য আমার কেন এত প্রয়োজন। এমন অভিজ্ঞতা আগে তোমার হয়নি। তোমার জীবন নিয়ে এত উৎসাহ আগে কখনও দেখাইনি। আমার এই উৎসাহ তোমাকে আনন্দ দিত, নিজেকে খুব মূল্যবান কিছু মনে হয়েছিলো কি তোমার? আসলে আমার কাছে তোমার চেয়ে তোমার তথ্যের গুরুত্ব ছিলো বেশি। তুমি নির্দ্বিধায় আমাকে তথ্য দান করেছে। নিজের পরিবারের দারিদ্র্য, দুঃখ, দুর্দশা কিছু বাদ দিয়ে বলোনি। তুমি তো মিথ্যে বলতে জানতে না মা। তোমার বাবার আর্থিক অবস্থা স্বচ্ছল হওয়ার আগে, তুমি যখন খুব ছোট, তোমার মা নারকেলের বরফি বানিয়ে দিত, সেই বরফির বাক্স নিয়ে গিয়ে তোমার বাবা বাজারে বিক্রি করতো, এই সত্য তোমার ভাই বোনেরা গোপন করলেও তুমি কোনওদিন করোনি। দরিদ্রের প্রতি তোমার কোনওদিনই কোনও অশ্রদ্ধা ছিলো না। সত্যকে, সে যত অপ্রিয়ই হোক না কেন, স্বীকার করতে তোমার কোনও সংকোচ হতো না। তুমি অকপটে বলেছো তোমার ভাই বোনদের ভালো মন্দ। তোমার নিজের দুঃখ সুখ। আমাকে এত বিশ্বাস করেছিলে কেন মা? তুমি তো জানতে আমি সব লিখছি। একবারও তোমার কিছু লুকোতে ইচ্ছে করলো না কেন?