.
হারভার্ড থেকে যে বছর গেলাম কলকাতার বই মেলায়, সে বছর আমার আত্মজীবনীর তৃতীয় খণ্ড দ্বিখণ্ডিত পশ্চিমবঙ্গ সরকার নিষিদ্ধ করেছে। একই বই ক নামে বেরিয়েছিলো বাংলাদেশে, বেশ কিছুদিন আগে সেটিও নিষিদ্ধ হয়েছে। কলকাতার মেলায় আত্মজীবনীর চতুর্থ খণ্ড সেই সব অন্ধকার বইটার উদ্বোধন হলো, এই বইও বাংলাদেশে প্রকাশ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে নিষিদ্ধ হয়ে যায়। পৃথিবীতে কোথাও কোনও লেখক পাবে না, যার এতগুলো বই নিষিদ্ধ। বাংলাদেশ ছাড়া কোথাও কোনও দেশ তুমি পাবে না যে দেশে বই নিষিদ্ধ করার বিরুদ্ধে আন্দোলন হয়নি। পৃথিবীর কোথাও তুমি এমন অসম্ভব ঘটনা দেখবে না, যেখানে লেখক-বুদ্ধিজীবীরা বই নিষিদ্ধ করার জন্য সরকারকে অনুরোধ করেন, মত প্রকাশের স্বাধীনতার বিরুদ্ধে দাঁড়ান। পশ্চিমবঙ্গে নিষিদ্ধ দ্বিখণ্ডিতর জাল বই বেরিয়ে গেছে। বই বাজেয়াপ্ত করার বুদ্ধি, পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী বলেছেন, তাঁকে পঁচিশ জন লেখক-বুদ্ধিজীবী দিয়েছেন। দ্বিখণ্ডিত লেখার জন্য সৈয়দ শামসুল হক বাংলাদেশে আমার বিরুদ্ধে এক কোটি টাকার মানহানির মামলা করেছেন। তাঁর রাগ, তাঁর শালির সঙ্গে তাঁর গোপন সম্পর্ক ফাঁস করে দিয়েছি। কলকাতার এক ছোটখাটো কবিও একই কাণ্ড করেছে। সেও এককোটি টাকার মানহানির মামলা করেছে। মানহানির উকিল বললেন, কবিটি আমার বিরুদ্ধে মামলা করেছে ওর সঙ্গে আমার দুদিনের ওই আকস্মিক সম্পর্কের কথা ফাঁস হয়ে গেছে বলে নয়, তার হিন্দু বিরোধী মানসিকতা ফাঁস হয়েছে বলে।
.
সুযোগ পেলেই কলকাতা চলে যাই। ঝুনু খালা কলকাতায় আমাকে দেখতে আসে। ঝুনু খালাকে পেয়ে আমার মনে হয়েছে যেন তোমাকেই পেয়েছি। ঝরঝর করে ঝুনু খালা কাঁদে আমাকে জড়িয়ে ধরে! জানিনা আমার জন্য কাঁদে, নাকি তোমার জন্য। কলকাতার একটা হোটেলে আমি অনেকদিন ছিলাম। ওখানে ঝুনু খালাও ছিল আমার সঙ্গে। ঝুনু খালার রিউমাটয়েড আরথ্রাইটিস সারাবার জন্য বড় ডাক্তার দেখিয়ে চিকিৎসার ব্যবস্থা করি। তাকেও শারীরিক মানসিক সুস্থতা দিতে যা কিছু করার সব করি। যেখানে যাই, সব জায়গায় সঙ্গে নিয়ে যাই ঝুনুখালাকে। ভারতের সিকিম নামের পাহাড়ি এলাকায় ঝুনু খালাকে বেড়াতে নিয়ে গেছি। লক্ষ করি, ঝুনু খালা তোমার বোন হলেও তার আর তোমার মধ্যে এক পাহাড় পার্থক্য। প্রিয়জনের মৃত্যু মানুষকে পাথর করে তোলে, আবার কিছু মানুষ যেমন ছিল, তেমনই রয়ে যায়। ঝুনু খালা আগের মতোই আছে, হাসিখুশি, ঝকঝকে। আরথ্রাইটিস নিয়ে খুব একটা দুর্ভাবনা নেই। ঝুনু খালার সঙ্গেও আমি তোমাকে নিয়ে কথা বলি না। মাঝে মাঝে ঝুনু খালা হয়তো বলতে শুরু করে কিছু আমি থামিয়ে দিই। তোমার না-থাকার কষ্টকে আমি কারও কাছে বলে হালকা করতে চাই না। কষ্টটা যেমন আছে থাক। কষ্টটা আমার একার। আর যা কিছু দুঃখ সুখ ভাগ করি না কেন, এই কষ্টটাকে কারও সঙ্গে আমি ভাগ করি না। ফকরুল মামা তার মেয়ের অসুখ দেখাতে কলকাতার হাসপাতালে ছিল কদিন। অনেক আগেই আমার কাছে এক লাখ টাকা ধার চেয়েছিলো। সেদিন সেই টাকার কথাটা তুললে পাঁচশ ডলার ছিল হাতে, দিয়ে দিই। ধার নয়, এমনিতেই দিই। এ কারণে আরও, যে, তোমার অসুখের সময় ঢাকায় যখন ছিলে, তোমাকে দেখতে নিয়মিত আসতো। তোমার হয়তো খারাপ লাগবে শুনে যে ফকরুল মামা টাকা চাইছে। কিন্তু মা, তোমার মতো কজন আছে যে দিতে চায়, নিতে চায় না? ছটকুও এসেছিল। বউএর জন্য অনেক কিছু কিনে নিয়ে যায়। নানির শাড়ি কেনার জন্য কিছু টাকা দিই। নিজের অনেক শাড়িও দিয়ে দিই গরিবদের দিতে। দিতে আমার তোমার মতোই ভালো লাগে। কারও কাছ থেকে কিছু আমার চাওয়ার নেই। আমি না পেতে জানি। তুমিও যেমন না পেতে জানতে। এর আরও দুবছর পর আবারও কলকাতায় যখন আমি, দাদা, ঝুনু খালা, বড় মামা, বড় মামার দুই ছেলে বিক্রম আর রুদ্র, ছটকুসবাই আমার সঙ্গে দেখা করতে কলকাতা এসেছিলো, কীযে ভালো লেগেছিলো আমার! যেন এক ঝাঁক তুমি এসেছো। তুমি ছিলে না ওই ভরা আসরে, কিন্তু তুমি ছিলে মা। তোমার হয়ে আমি ছিলাম। বড়মামা একদিন অনেকক্ষণ তাকিয়ে থেকে আমার মুখের দিকে, বললো, তোকে একেবারে ঈদুনের মতো দেখতে লাগছে। শুনে, যেন শুনিনি, আমি বাথরুমে চলে যাই, আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজের মুখটা দেখি, দেখতে দেখতে চোখের জলও দেখি আমার। অনেকক্ষণ দেখি।
আমি জানিনা নিজে ডাক্তার বলে, নাকি বাবা আর তোমার মৃত্যু আমাকে এত ভয় পাইয়ে দিয়েছে যে চাইনা কারও অসুখ হোক, কেউমরে যাক। যাদের ভালোবাসি তাদের সামান্য অসুস্থতার খবর পেলে আমি অস্থির হয়ে উঠি। বড় মামাকে ডাক্তার দেখিয়ে দিই। রক্তের চিনি কমিয়ে রাখার জন্য দিনরাতপরামর্শ দিই। আসলে ডায়বেটিস যাদের আছে, তাদের বোধহয় অত নিয়ম কানুন মানতে ইচ্ছে করে না। সবাই এমন নয়। তুমি মানতে। আর তো কাউকে দেখিনা যে মেনে চলে। বেঁচে থাকার জন্য তোমার যে প্রচণ্ড ইচ্ছে ছিল, এই ইচ্ছে সবার মধ্যে নেই। তুমি অত যে ভুগতে জীবন নিয়ে, তারপরও চাইতে বেঁচে থাকতে। তুমি কি খুব ধার্মিক ছিলে! ধর্ম তো তোমাকে বলে, মরে গেলেই তুমি সোজা আল্লাহর কাছে পৌঁছে যাবে, আর কোনও দুর্ভাবনা তোমার নেই। কিন্তু মৃত্যু নিয়ে তোমার দুর্ভাবনা ছিল। তোমার সব ভাই বোনদের মধ্যে বড় মামাকে আমি সবচেয়ে বেশি শ্রদ্ধা করি। মানুষটার যুক্তি তর্ক, মানুষটার আদর্শ সেই ছোটবেলা থেকেই আমার পছন্দ। কদিন কলকাতায় কাটিয়ে কলকাতা থেকে শাড়ি কাপড়, শাল এসব কিনে সবাই ফিরে যায় দেশে। ছোট খাটো সাংসারিক আর ব্যবহারিক জিনিস থেকে মানুষের মন ওঠানো খুব সহজ কথা নয় মা। আমি সেই জায়গায় এসে পৌঁছে গেছি, যেখানে জিনিসপত্রের জন্য কোনও মোহ থাকে না। চারদিকের আর কাউকে দেখি না মোহ থেকে মুক্ত হতে। সবাইকে আমি ভালোবাসা বিলিয়ে দিই। যা চাই, তা নিতান্তই ভালোবাসা, অন্য কিছু নয়। তবে মাঝে মাঝে কষ্ট হয়, এই মামা খালারা কেউ আমাকে কখনও দূর বিদেশে একা পড়ে থাকি যখন, ফোন করে জিজ্ঞেস করে না কেমন আছি। দেশ থেকে কারও ফোন আমি পাই না। দাদারাও খোঁজ করে না। আমি বেঁচে আছি কী মরে গেছি, কারও জানার প্রয়োজন হয় না। এরা কি সত্যিই আমার আত্মীয়! যে যার জীবন নিয়ে চমৎকার বেঁচে আছে। যদি আমি স্বার্থপর হতাম, হয়তো চমৎকার আমিও বেঁচে থাকতে পারতাম। কিন্তু পারি না মা। তোমার রক্ত বইছে আমার শরীরে। ভালো থাকা আমাদের জন্য নয়। মা, আসলেই কি ওরা চমৎকার বেঁচে আছে! নাকি আমি নদীর এপারের মতো, ওপারেই যত সুখ আছে বলে আমার বিশ্বাস! ওরাও হয়তো ভাবে, আমি ওদের ভুলে থাকি। ওরাও হয়তো ভাবে, আমার জাঁকজমকের জীবনে আমি চাইনা ওদের মতো ছাপোষা লোকদের সঙ্গে কথা বলে সময় নষ্ট করতে! অভিমান আমি করি, নাকি ওরা করে, বুঝি না।