আমেরিকার হারভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে বক্তৃতা দিতে গেলে হারভার্ডের এক প্রফেসর আমার খোঁজ করেন, তাঁর বাড়িতে আমন্ত্রণ জানান। সুয়ানি হান্ট, বিখ্যাত মহিলা। উনিই দুপুরের খাবার খাওয়াতে খাওয়াতে আমাকে প্রস্তাব দেন হারভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে কোনও ফেলোশিপ করতে চাই কিনা। লুফে নিই প্রস্তাব। কদিন পর যখন চিঠি আসে হারভার্ড থেকে, যাবো কী যাবো নার দোলনায় দুলি। বিশ্ববিদ্যালয়ে আবার কোনও পড়ানোর দায়িত্ব পড়লে আমার লেখালেখি নষ্ট হবে। কিন্তু সুইডেন ছাড়ার ইচ্ছেয় জানিয়ে দিলাম রাজি আছি। জে ওয়ান ভিসা, যেটি স্কলার বা প্রফেসরদের জন্য নিয়ে রওনা হলাম বোস্টন শহরেরপাশে কেমব্রিজ শহরে। প্রফেসর ডাক্তার জো গারস্টেনের বাড়িতে দুদিন থেকে একসময় কেমব্রিজে একটা বাড়িও ভাড়া করে নিলাম। প্রফেসর জো গারস্টেন সাহায্য করলেন বাড়ি নিতে। উনি ম্যাসাচুস্টেস-এর মানববাদী দলের একজন। নিজে মানববাদী, তাই বিশ্বের চারদিকে মানববাদী মানুষগুলোর সঙ্গে যোগাযোগ। নারীবাদীদের সঙ্গেও। মানুষের মঙ্গলের জন্য, সত্যের জন্য সংগ্রামে বিশ্বাসী আমি, এই সংগ্রামে, এই ত্যাগে খ্যাতি জোটে হয়তো, যশ জোটে না। সম্মান জোটে কিন্তু প্রাচুর্য জোটে না। যে সাধারণ সাদাসিধে সরল সহজ মানুষ ছিলাম আমি, তেমনই থেকে যাই। টাকা পয়সা আগের মতোই আমার কাছে নিতান্তই অনাকর্ষণীয় হয়ে পড়ে থাকে। হারভার্ডে বসে সেই সব অন্ধকার, আত্মজীবনীর চতুর্থ খণ্ড লিখতে থাকি। মাঝে মাঝে নিউইয়র্কে ইয়াসমিনকে দেখতে যাই। ইয়াসমিন আমার প্রায় এক বছরের হারভার্ডের জীবনে একদিন এসেছিলো বেড়াতে, তাও একদিনের জন্য। প্রচুর জামা প্যান্ট কিনে দিয়ে গেছে আমাকে। সুহৃদ, মিলন, আর ছোটদাও এসেছিলো। সুহৃদকে হারভার্ডের বিশাল লাইব্রেরিটা দেখিয়ে বলেছি যেন সে একদিন বড় হয়ে এই বিশ্ববিদ্যালয়েপড়তে আসে, এই লাইব্রেরিতে বসেপড়তে পারে অনেক দুর্লভ বই। দূর থেকে কিছু বন্ধু বান্ধবও এসেছিলো। ম্যাট চেরি, পুরোনো সেই ইংরেজ মানববাদী বন্ধুটি আমেরিকার এক মেয়েকে বিয়ে করেছে, বউ নিয়ে দুদিন থেকে গেল আমার কাছে। হারভার্ডের বাড়িটি বড়, অতিথিদের জন্য কোনও অসুবিধে হয় না। টাঙ্গাইলের সেই রতন এসেছিলো, ছোটবেলায় যে ছেলেটা আসতো অবকাশে। জার্মানিতে ও রাজনৈতিক আশ্রয় চেয়েছিলো, আমার সাহায্য চেয়ে লিখেছিলো। আমি লিখে দিয়েছিলাম সত্য কথা যে রতনকে আমি চিনি বটে কিন্তু ও আমার কোনও অনুসারি ছিল না, আমার জন্য কোনও মিছিল তাকে আমি করতে দেখিনি। ও চিঠির পর জার্মানিতে তার আর রাজনৈতিক আশ্রয় পাওয়া হয়নি। ঘুরে ঘুরে কানাডায় এসে বসত শুরু করেছে। অনেককালপর যোগাযোগ হয়। রতন দেখতে আসে আমাকে বোস্টনে। ওকে বোস্টন থেকে নিউইয়র্কেও নিয়ে যাই। ইয়াসমিনের বাড়িতে দুদিন থেকে ও ফিরে যায় কানাডায়। ওর জন্য খুব মায়া হয়েছিল। এখন ভালো আছে দেখতে পেয়ে ভালো লাগে। পূরবী বসুকে তো তুমি চেন, সাহিত্যিক, আমার শান্তিনগরের বাড়িতে যেতেন। উনিও এসেছিলেন তার স্বামী জ্যোতিপ্রকাশ দত্ত, আর বন্ধু সংবাদপত্রিকার সম্পাদক বজলুর রহমানকে নিয়ে। ওঁরাও থেকেছেন ও বাড়িতে। ওঁদের অনেক বলেছি, আমাকে দেশে ফিরিয়ে নিন। কেউ আমার দেশে ফেরার ব্যাপারে খুব একটা কিছু রা শব্দ করেন না। ওঁরা মনে করেন আমি বিদেশেই ভালো আছি। আমাকে যে কেউ দেখলেই ভাবে আমি বেশ আছি। কিন্তু আমি সত্যি ঠিক কেমন আছি কাউকে বোঝাতে পারি না। দেশে ফিরলে মৌলবাদীরা আমাকে মেরে ফেলবে বা তারা আবার তাদের নোংরা আন্দোলন শুরু করবে, এই ভয় সবার। দেখলে বড় রাগ হয় আমার। হারভার্ডের জীবন আমার অন্যরকম। রক্তের চিনি প্রায় সীমানা ছুঁয়েছিলো বলে স্বাস্থ্যের প্রতি এমন সচেতন হই যে বিকট বেড়ে যাওয়া ওজন প্রচুর কমিয়ে নিই, এতে চিনি বাপ বাপ করে আমাকে ছেড়ে পালায়, রক্তচাপও এত কমে যায় যে ডাক্তারের কাছে গেলে হারভার্ডের ডাক্তার ইসিজি করে বলে, আমার নাকি একটা হার্ট অ্যাটাক হয়েছে। দুঃসংবাদটি শুনেই আমার হৃৎপিণ্ডের ক্রিয়া বন্ধ হওয়ার জোগাড় হয়েছিল। অ্যাম্বুলেন্সে করে বোস্টনের উইমেন এণ্ড ব্রিঘাম হাসপাতালে পাঠিয়ে দেয় ওরা। ওখানে বড় হৃদরোগ বিশেষজ্ঞ এসে নানারকম সব পরীক্ষা করেন, পরীক্ষার ফল হাতে নিয়ে বলে দেন, তোমার কিচ্ছুহয়নি। তোমার হৃদপিণ্ড যে কোনও সুস্থ সবল মানুষের হৃৎপিণ্ডের চেয়েও বেশি সুস্থ। বললেন, রক্তচাপ কমাবার ওষুধ আর খেতে হবে না। জিজ্ঞেস করলাম, তবে যে হারভার্ড হেলথ সেন্টার থেকে বললো, হার্ট অ্যাটাক? বললো, ওদের ইসিজি করতে কিছু গোলমাল হয়েছিল। তবে বিদায় দেবার আগে একটা কথা জিজ্ঞেস করেন, তোমার পরিবারে কারও কি রক্তচাপ বেশি? হ্যাঁ বাবার ছিল। ডায়বেটিস? বলি, বাবা মা দুজনের। কবে ওরা মারা গেছেন? বলি। আজকাল ডাক্তারদের কাছে বাবা মার কত বছর বয়সে মৃত্যু হয়েছে, এ খুব জরুরি তথ্য। বাবা মার যে বয়সে মৃত্যু হয়, সন্তানদেরও ওই একই বয়সে মৃত্যু হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। বলেন, সিগারেট খাও? বলি খাই। দিনে কটা? দুপ্যাকেট। তারপর জিজ্ঞেস করেন, বাঁচতে চাও? বলি, চাই। বলেন, বাঁচতে চাইলে সিগারেট খাওয়া বন্ধ করো। হাসপাতালে পৌঁছেইইয়াসমিনকে খবর দিয়েছিলাম। ইয়াসমিন ওই রাতেই নিউইয়র্ক থেকে মিলন আর সুহৃদকে বোস্টনে পাঠিয়ে দিয়েছিল। ওরা আসায় খুব ভালো লাগে। নিজেকে খুব একা মনে হয় না। জীবনে ওরা না থাকলেও, অন্তত মৃত্যুর সময় পাশে থাকবে এই বিশ্বাস আমার হয়। কিন্তু মৃত্যু নিয়ে আমার বিলাসিতা নেই। সঙ্গে কেউ না থাকলেও আমার চলবে। আমি চাই, আমার জীবনে ওরা পাশে থাকুক। বিশেষ করে ইয়াসমিন আর সুহৃদ। ওদের দুজনের জন্য আমার ভালোবাসা প্রচণ্ড। বোস্টনের হাসপাতাল থেকে বেরিয়ে আমি আর সিগারেট খাইনি মা। তুমি আমাকে কত বলেছো সিগারেট না খেতে। তোমার অনুরোধ শুনিনি। বলেছো সিগারেটের তৃষ্ণা পেলে মুখে এলাচ রাখতে, চুইংগাম চিবোতে। তোমার ওসব অনুরোধ হেসে উড়িয়ে দিয়েছি। আর মৃত্যুর কথা যখন মনে করিয়ে দিল ডাক্তাররা, তখনই সিগারেট খাওয়া বন্ধ করলাম। মৃত্যু জিনিসটাকে আমি সহ্য করতে পারি না। স্টেম সেল রিসার্চ হচ্ছে, তোমাকে বলেছিলাম বিজ্ঞানের এই আবিষ্কারের কথা? বাচ্চাদের নাভিতে অনেক স্টেম সেল থাকে, এক একটা সেল থেকে শরীরের এক একটা অঙ্গ প্রত্যঙ্গ সব তৈরি হয়। বাড়তি সেলগুলো বিনা কাজেপড়ে থাকে। ওই সেলগুলো থেকেই গজিয়ে ওঠে নতুন অঙ্গ। ধরো তোমার লিভার যখন নষ্ট হয়ে গেল, লিভারের একটা স্টেম সেল ঢুকিয়ে দিলেই নতুন একটা লিভার তৈরি হয়ে যেত তোমার শরীরে। তোমার শরীরে যেপ্যানক্রিয়াস নামের একটা জিনিস ছিল, সেটাপর্যাপ্তপরিমাণ ইনসুলিন তৈরি করতে পারছিলো না বলে তোমার ডায়বেটিস হয়েছিল। সেই পুরোনো অকেজো প্যানক্রিয়াসটা ফেলে দিয়ে প্যানক্রিয়াসের একটা নতুন সেল লাগিয়ে দিলে নতুন প্যানক্রিয়াস তৈরি হতে পারতো, তুমি দিব্যি সব রোগ শোক ঝামেলা থেকে মুক্ত হতে পারতে। জরায়ুর মধ্যে থাকাকালীন বাচ্চাদের শরীর তৈরি হতে থাকে এসব সেল থেকে। তবে একটা অঙ্গের জন্য কেবল একটা সেল বা কোষ অপেক্ষা করে থাকে না, অনেকগুলোই থাকে, একটা শুধু কাজে লাগে। বাকিগুলো, যেগুলো কাজে লাগে না, তা অসুখে বিসুখে নষ্ট হয়ে যাওয়া, ক্ষয় হতে থাকা মানুষের অঙ্গ প্রত্যঙ্গকে রীতিমত গড়ে দিতে পারে। বিজ্ঞানের এই আশ্চর্য আবিষ্কার মানবজীবনকে অনন্তকাল বাঁচিয়ে রাখবে। ডারউইনের বিবর্তন প্রমাণ যদি মানুষের বিশ্বাস না হয়, তবে এই স্টেম সেলের ঘটনাতেই ধর্ম তাসের ঘরের মতো ভেঙে যেতে বাধ্য। কিন্তু মা, মূর্খরা ধর্মকে বাঁচিয়ে রাখতেপণ করেছে। মূর্খ যতদিন থাকবেপৃথিবীতে, ততদিন ধর্ম থাকবে। আমার মরে যেতে ইচ্ছে করে না, পৃথিবীতে হাজার বছর থেকে দেখতে চাই কী হয় পৃথিবীর, পৃথিবীর মানুষের, কী হয় এই বিশ্ব ব্রহ্মাণ্ডের। কিন্তু আমি বেঁচে থাকতে চাইলেই কি আর বেঁচে থাকতে পারবো মা! তোমার মতো, বাবার মতো আমাকেও চলে যেতে হবে একদিন। যারা ধর্মে বিশ্বাসী, কারও মৃত্যু হলে তাদের কোনও কষ্ট হয় না। আল্লাহর জিনিস আল্লাহ নিয়ে যাচ্ছে, সুতরাং দুঃখ পাওয়ার তারা কোনও কারণ দেখে না। পরপারে একদিন তাদের আবার দেখা হবে, এই ভেবে একধরনের সান্ত্বনা পায়। আচ্ছা তুমিই বলো মা, তুমি কি এখন আল্লাহর কছে পোঁছেছে, আল্লাহ ঠিক কেমন দেখতে বলো তো আমাকে! ওখান থেকে পৃথিবীর কারও সঙ্গে যোগাযোগ করার ব্যবস্থা নেই বুঝি! তোমার কি ইচ্ছে হয় না তোমার ভালোবাসার মানুষদের সঙ্গে কথা বলতে? ইচ্ছে নিশ্চয়ই হয়, তুমি পারো না। তাহলে কিপরকালে মানুষের সাধ আহ্লাদের কোনও মূল্য থাকতে নেই, সব আল্লাহর ইচ্ছেয় ঘটবে! তাহলে নিশ্চিতই একনায়কতন্ত্র চলছে ওখানে। পৃথিবীর একনায়কদের আমরা পছন্দ করি না জানো তো। ডিকটেটরদের বিরুদ্ধে মানুষ কী রকম আন্দোলন করে দেখেছো। পরকালেও দেখবে মানুষ একনায়কতন্ত্রের বিরুদ্ধে রুখে উঠছে। না, মা, পরকাল বিশ্বাসের কোনও কারণ আমার নেই। কারও মৃত্যু হলেই আমার কষ্ট হয়। কেউ, যে কেউ, যদি চলে যায়, জানি ফিরে আসবে না সে কোনওদিন। কোনওদিন আর তার সঙ্গে তার ভালোবাসার মানুষদের দেখা হবে না, কথা হবে না। এ আমাকে কষ্ট দেবে না কেন, বলো! অবিশ্বাসীদের কষ্ট অনেক বেশি। হারভার্ডে থাকাকালীন স্টিভ লেসির মৃত্যু আমাকে দেখতে হল। খুব বড় জাজ বাদক ছিলেন, থেলোনিয়াস মংকের নামি জাজ দলের সঙ্গে যৌবনে বাজাতেন। শুরু থেকেই সপ্রানো বাজাতেন স্টিভ। আমেরিকায় জন্ম। ইহুদি। ইওরোপে থেকেছেন বহু বছর। আমার সঙ্গে দেখা হয়েছিল, যখন আমি জার্মানিতে। আমার অনেকগুলো কবিতা, যেগুলো ইংরেজিতে অনুবাদ হয়েছে, সেগুলোতে সুর দিয়ে সাত জন জাজ বাদক নিয়ে সারা পৃথিবীতে গেয়েছেন। স্টিভের সুর দেওয়া গান গেয়েছেন সুইজারল্যান্ডের মেয়ে ইরেন এবি। স্টিভ আর ইরেন বেশি বয়সে বিয়ে করেছেন। জার্মানিতেই ওঁদের সঙ্গে সখ্য গড়ে ওঠে আমার তখনই। তারপর ওঁরাপ্যারিসে চলে যান। দুবছর পর আমিও প্যারিস থাকতে শুরু করি। ওঁদের সঙ্গে দেখা হতো প্রায়ই। আবার প্যারিস থেকে বোস্টনে চলে যান ওঁরা, আর তার পর পরই আমিও বোস্টনের পাশের শহর ক্যামব্রিজ শহরে ডেরা বাঁধি। কী আশ্চর্য যোগাযোগ! হারভার্ড থেকে প্রায়ই চলে যেতাম ওঁদের বাড়িতে। স্টিভ তখন নিউ ইংলেণ্ড কনজারভেটরিতে সঙ্গীত শিক্ষক হিসেবে চাকরি করছেন। ওইসময় একদিন ধরা পড়ে স্টিভের লিভার ক্যানসার। স্টিভ খুব ভালোবাসতেন আমাকে। ম্যাকআরথার জিনিয়াস পুরস্কার পাওয়া এত বড় একজন সঙ্গীতশিল্পী কিনা আমার মতো এক ছোট কবির এতগুলো কবিতা গানে রূপ দিয়ে ইওরোপ আমেরিকায় বড় বড় থিয়েটারে গাইছেন। মাঝে মাঝে স্বপ্নের মতো মনে হয় এই ঘটনাগুলো। বিশ্বাস হতে চায় না সত্যি সত্যি ঘটছে এসব। স্টিভের ক্যানসার ধরা পড়ার পর দিব্যি আছেন। সপ্রানো বাজাচ্ছেন, বইপড়ছেন, সিনেমা দেখছেন, লোকের সঙ্গে আড্ডা দিচ্ছেন। জিজ্ঞেস করলে বলেন, দিব্যি আছি। কী করে যে পারেন মৃত্যুর মতো বীভৎস কিছুকে মেনে নিতে। স্টিভ কোনও ধর্ম বিশ্বাস করেন না। অসাধারণ এক দার্শনিক তিনি। স্টিভের সঙ্গে সময় কাটাতে যখনই সুযোগপাই, যাই। খুব বেশিদিন স্টিভকে কষ্ট করতে হয়নি। শরীর কেমন কেমন করছে বলে হাসপাতালে গেলেন, আর ফেরেননি। আমি ভেবেছিলাম তোমার মৃত্যুর পর আর কারও মৃত্যুতে আমার কষ্ট হবে না। কিন্তু স্টিভের জন্য হয়। একসময় যে মানুষটি আমার খুব কাছের মানুষ ছিলেন, সেই নিখিল সরকারেরও শুনি ফুসফুসে ক্যানসার হয়েছে। ফুসফুস থেকে মাথায় উঠেছে ক্যানসার। মৃত্যু সামনে এসে দাঁড়ালে মানুষ যোদ্ধা হয়ে ওঠে। নিখিল সরকারকে কাঁদতে বা হাহাকার করতে দেখিনি। বরং নিজের অপ্রকাশিত লেখাগুলো প্রকাশের ব্যবস্থা করলেন, জীবনে যে কাজগুলো করার স্বপ্ন দেখে ছিলেন, তাড়াহুড়ো করে তার সবটা না হলেও কিছুটা করে নিলেন, নিপাট গুছিয়ে নিলেন সব। তোমার কোনও কিছু ছিল না গুছোবার। নাহলে তুমিও হয়তো গুছিয়ে নিতে। তোমার ছিল না কিছু কাউকে দেবার, না হলে দিয়ে যেতে। শূন্য হাতে সারাজীবন ছিলে, শূন্য হাতে গেলে। তোমার মৃত্যু আমাকে পার্থিব জিনিসপত্রের প্রতি আমার সব মোহ জন্মের মতো ঘুচিয়ে দিয়েছে মা। আমার এখন প্রচুর টাকা খোয়া গেলে, বা যা কিছু অর্জন উপার্জন সব হাওয়া হয়ে গেলেও কিছু কষ্ট হয় না। আমি অমরত্বে বিশ্বাস করি না। আমি আমার লেখার মাধ্যমে বা সন্তানের মাধ্যমে, বা কোনও কিছুর মাধ্যমে বেঁচে থাকবো, এই ভেবে আমার কোনও সুখ হয় না। জীবন যতদিন আছে, ততদিনই যা পাওয়ার পাবো। ভালোবাসা ছাড়া আর কোনওকিছুর গুরুত্ব আমার কাছে নেই। সাধারণ মানুষের যে ভালোবাসা জোটে, ওতেই আমার মন ভরে। নিখিল সরকারের মৃত্যু আমাকে কাঁদিয়েছে। কাছের মানুষগুলো একে একে চলে যাচ্ছে মা। যারা ভালোবাসতেন, তাঁদের অনেকেই আর নেই। অন্নদাশংকর রায় নেই। শিবনারায়ণ রায় নেই। বড় খালি খালি লাগে এই জগৎ। ভেবেছিলাম তোমার মৃত্যুর পর আর কারও মৃত্যু আমাকে কষ্ট দেবে না। কিন্তু ভুল ভেবেছিলাম মা। সবার মৃত্যুই আমাকে কষ্ট দেয়।