.
জীবন অনেক বদলে গেছে মা। তোমার স্বপ্ন শেষ পর্যন্ত সফল হলো না। বাংলাদেশে ফেরার আমার কোনও উপায় নেই। আমার পাসপোর্টের মেয়াদ উত্তীর্ণ করা হয় না। বিদেশের বাংলাদেশ দূতাবাসগুলোয় ধর্না দিয়ে ওই একই উত্তর শুনতে হয়, তারা আমার পাসপোর্টের মেয়াদ বাড়াবে না। আমি যেন দেশে যেতে না পারি তার সবরকম কায়দা কানুন ওরা করে রেখেছে। সুইডেনের পাসপোর্ট হাতে, ওতেও বাংলাদেশের ভিসার জন্য আবেদন করেছি। একই উত্তর মা। না। যে সরকারই বাংলাদেশে আসে, নিজেদের মধ্যে আর সব বিষয়ে তাদের মত পার্থক্য থাকলেও আমার ব্যাপারে সবাই একমত, আমাকে দেশের মাটিতে পা রাখতে দেবে না তারা। অগত্যা সুয়েনসনের বাড়িটিকেই নিজের বাড়ি মনে করে সাজিয়ে তুলোম। ঢাকায় ফেলে আসা আমার সবকিছুকে ভুলে তো যেতে পারি না, কিন্তু আর কতকাল জীবন আমাকে কেবল শেকড়হীন হাহাকার দিয়ে যাবে, যেন রূঢ় বাস্তবতার বিরুদ্ধেই রুখে দাঁড়ালাম। স্বপ্নের বীজ ছড়াতে শুরু করলাম জীবনের ধূসর ঊষর অকর্ষিত জমিতে। কিন্তু তাই বা কদিন বলো। ভিন দেশে ভিন মানুষের সঙ্গে তুমি চলতে ফিরতে পারো, কিন্তু কোথায় যেন কিসের এক ফাঁক থেকে যায়, অথবা ফাঁকি। অস্তিত্বের লড়াই শুরু হয় অলক্ষ্যে। সুয়েনসনের বাড়িতে অন্তত চোখ কান নাক মুখ বুজে একটি কাজ করা যায়, সে লেখা। প্যারিস থেকে ফিরে এসে ফরাসি প্রেমিক নামে বড় উপন্যাস লিখে ফেলেছি। উপন্যাস লেখা আমার হয় না, ও লেখা একরকম বাদই দিয়েছিলাম। আমার মেয়েবেলার কথা তো জানোই। বইটা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বাংলাদেশে বেরোবার আগেই নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছেন। কলকাতায় আমার বই বেরোনোর সঙ্গে সঙ্গে বাংলাদেশ দূতাবাস থেকে লোক এসে কিনে নিয়ে যান। এরকমই বোধহয় নির্দেশ। সে বই তারা নিজেরা পড়ে মত জানান, অথবা সরাসরি প্রধানমন্ত্রীর দপ্তরে পাঠিয়ে দেন। প্রধানমন্ত্রী পড়ে বা নাপড়ে বই নিষিদ্ধ করেন। কেন, কী বুঝে, কে জানে। অবাক লাগে এসব চরিত্র দেখে। চারদিকে এই বই নিয়ে উচ্ছাস। আর এটি কি না যে দেশের কাহিনী, সে দেশেই নিষিদ্ধ। হাসিনা কী কারণে যেন ফ্রান্সে এসেছিলেন। ওকে দেখে ফরাসি সাংবাদিকরা ছুটে গিয়ে একটা প্রশ্নই করেছে, আপনি তসলিমার আমার মেয়েবেলা নিষিদ্ধ করেছেন কেন, হাসিনা ঠেটি উল্টে বলে দিয়েছেন, ও বই ভালগার, পর্নোগ্রাফি। ভেবেছেন বেশ বিজ্ঞের মতো বুঝিমন্তব্যটি করা হল। ফরাসিরা ওই বইটা পড়েছে, হাসিনার মন্তব্য শুনে তাজ্জব বনে যায়। ল্য মন্দ পত্রিকার সাংবাদিক ব্রুনো আমাকে পরে বলেছে এমহিলা দেখি আগাগোড়া মূর্খ। ফরাসিরা জানে বইটা কী বই, ভালগারের কিছু আদৌ আছে কী বইয়ে। তাদের তো আর বোকা বানানো যাবে না। নিজেকেই বরং বোকা হয়ে যেতে হবে। সরকার বই নিষিদ্ধ করে, সে সরকারের দোষ। আমি আমার লেখাকে, আমার মতকে অস্বীকার করবো কেন, নিষিদ্ধ করবো কেন। নিজের লেখা নিজের নিষিদ্ধ করার মতো ভয়ংকর আর কিছু নেই। বলো, বই কি আমি কাউকে খুশি করতে লিখি নাকি? যা বিশ্বাস করি, তাই তো লিখি। আমার মেয়েবেলা শুধু ফরাসি ভাষায় নয়, জার্মানির বড় একটি প্রকাশকও বের করেছে। আমেরিকাতেও বের হয়েছে। আমেরিকায় আবার আমাকে বুক ট্যুরে যেতে হল, আমেরিকার উত্তর দক্ষিণপূর্বপশ্চিম সব অঞ্চলের বিশ্ববিদ্যালয়ে বা বড় বড় মঞ্চে বই প্রকাশ উপলক্ষে আমার বক্ততা হল। আমেরিকার প্রায় সবপত্রিকায় বইয়ের সমালোচনা বের হল, সবাই উচ্ছ্বসিত প্রশংসা তো করলোই, লস এঞ্জেলেস টাইমস আর গ্লোব এণ্ড মেইল নামের দুটো নামি পত্রিকা বইটিকে দুহাজার দুই সালের শ্রেষ্ঠ নন ফিকশন বইএর লিস্টেও রাখলো। কিন্তু রয়্যালটির টাকা? পাইনি বললেই চলে। আমেরিকার ওই প্রকাশক এককালীন টাকা দিয়ে ফরাসি প্রকাশকের কাছ থেকে কপিরাইট কিনে নিয়েছে। আমেরিকায় ভালো বিক্রি হয়েছে বই। হলিউড থেকে একটি মুভি কোম্পানি যোগাযোগ করেছিলো। বই নিয়ে ছবি বানাতে চায়। লিটারেরি এজেন্ট থাকলে এসব সমস্যা হয় না। কিন্তু ওইসব এজেন্ট টেজেন্ট রাখা আমার ভালো লাগে না, লেখাটা আমার পেশা, কিন্তু ভেতরে ভেতরে আমি সেই এলোমেলো লেখক, লেখা যার নেশা। পেশা হলেও পেশাদারি মনোভাব আমার আসে না। ভারতের বিভিন্ন ভাষাতেও বইটি ছাপা হয়েছে। কোথায় কে ছাপাচ্ছে, কী ছাপাচ্ছে, তার হিসেবও আমার রাখা হয় না। মহেশ ভাট অনেকদিন আগেই বলেছিলেন, আমার জীবন নিয়ে ছবি বানাবেন, সে কথা অবশ্য কথাতেই রয়ে গেছে। উতল হাওয়া নামে দ্বিতীয় আত্মজীবনীর দ্বিতীয় ভাগটিও একদিন লেখা হয়ে যায়। বাংলার বাইরে অন্য ভাষাতেও এ বই অনূদিত হয়। ফরাসি প্রকাশক লুফে নেন উতল হাওয়া। লেখাই আমার আশ্রয় হয়ে ওঠে। তুমি নেই, বাবা নেই, সব আশ্রয় যখন শেষ হয়ে যায়, বোধহয় আশ্রয় খুঁজি অন্য কিছুতে। ফরাসি প্রেমিক বইটি বাংলাদেশে বের হয়, এই বইটির যেখানেই যৌনতা পেয়েছে, কেটে বাদ দিয়েছে বাংলাদেশের প্রকাশক। কলকাতার প্রকাশক বাদ দেয়নি কিছু। বিরাট করে বইটি বের করেছে, এবং পেঙ্গুইন ইন্ডিয়াও বইটি ইংরেজিতে অনুবাদ করে ছাপিয়েছে। এত সব লেখালেখি, এর মধ্যে তোমাকে কি ভুলে থাকি একটি দিনের জন্য? না, মা, ভুলে থাকতে পারি না। উতল হাওয়ায় তোমাদের কথাই লিখি, তোমার কথা, বাবার কথা। লিখতে লিখতে কাঁদি। চোখ মুছি। আবার লিখি। আমার শব্দে, আমার স্মৃতিতে তুমি জীবন্ত হয়ে দেখা দাও। পুরোনো দিনগুলোয় ফিরে যেতে হলে কী যে প্রয়োজন হয় রেখে আসা কত কিছুর। দাদাকে বলি রুদ্রর চিঠিগুলো অন্তত পাঠিয়ে দিতে। শান্তিনগরের বাড়িতে আমার লেখার ঘরে কত চিঠি যে পড়ে আছে, কত যে ডায়রি, কত যে বই, স্মৃতির পাহাড় ওখানে। গোটা পাহাড় কে পাঠাবে বলো! রুদ্রকে লেখা আমার চিঠিগুলোই পেয়েছি, আমাদের বিচ্ছেদের সময়ই ওর কাছ থেকে চিঠিগুলো নিয়ে এসেছিলাম। আমাকে লেখা রুদ্রর চিঠির খুব অল্প কিছু ছাড়া আর কিছু পাঠায়নি দাদা। বলেছেপায়নি। কোথায় সব গেল জানি না। শুধু কিরুদ্রর চিঠি, বাক্সরপর বাক্স চিঠিতে বোঝাই ছিল। পাঠকদের চিঠি, দেশ বিদেশের শিল্পী সাহিত্যিকদের চিঠি। আমাকে লেখা বাবার এক ট্রাংক চিঠি। নিজের জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সময় নিয়ে আত্মজীবনীর তৃতীয় বইটি যখন লিখছি, তখন তথ্যের দরকার পড়েছে। যদি হাতের কাছে তথ্য না থাকে, তবে কত আর স্মৃতি থেকে লেখা যায় বলো! আমার লেখক জীবন কী করে শুরু হল, সেই সব জনপ্রিয়তা, একইসঙ্গে সমাজের সব বাধার বিরুদ্ধে আমার রুখে দাঁড়ানো, হাসপাতালের ব্যস্ততা, সরকারের বিরোধিতা, পাসপোর্ট আটকে রাখা, ফতোয়া, মিছিল, বইমেলায় আমাকে আক্রমণ, বইমেলায় আমার উপস্থিতি নিষিদ্ধ হওয়া, বই বাজেয়াপ্ত হওয়া, দেশের রাজনৈতিক পরিবর্তন, ব্যক্তিজীবনের ভয়াবহ অস্থিরতা আর সব কিছু ভেঙেচুরে নিজের পায়ে দাঁড়ানোর প্রবল মনোবল আর শক্তি নিয়ে কুৎসিত পুরুষতান্ত্রিক সমাজে একটি মেয়ের মাথা উঁচু করে একা থাকা, এত কিছু নিয়ে বড় একটি বই লেখা শুধু স্মৃতির ওপর নির্ভর রইলো।