ছোটদার সঙ্গে আরও কথা বলার পর যা বুঝেছি তা আরও ভয়ংকর। আমার টাকা পয়সার ওপর, সে মনে করে, তার অধিকার একশ ভাগ। কারণ আমার স্বামী নেই, সন্তান নেই, তার মানে আমার ‘সংসার’ নেই, এবং আমি যেহেতু পুরুষ নই, মেয়ে, আমার টাকায় আমার ওপর আমার যত অধিকার, ভাইদের অথবাপুরুষ আত্মীয়দের তার চেয়ে অনেক বেশি অধিকার। সুতরাং আমার যা কিছু আছে, তা আসলে ছোটদার। আমি মরে গেলে আমার সব সে পাবে। আর স্বামী সন্তানহীন সংসারহীন বেঁচে থাকা মানে তো ঠিক বেঁচে থাকা নয়, তাই আমি বেঁচেও মৃত, আর যে দেশে আমার জন্ম বড় হওয়া, যে দেশে আমার সম্পদ সম্পত্তি এখনও বর্তমান, সে দেশেই যেহেতু আমি বেঁচে থাকা অবস্থায় উপস্থিত থাকতে পারবো না, তাই বিদেশের বরফে ডুবে থাকা আর মরে থাকা ওই একই কথা। বাবার উত্তরাধিকারী হওয়ার যোগ্য আমি নই।
তুমি যদি এই নিষ্ঠুর পৃথিবীটায় থাকতে, তবে সইতে পারতে এই অন্যায়! পারতে না। তোমার স্বামী পুত্রদের এই অনাচার আর অবিচারের বিরুদ্ধে তুমি মুখর হতে। নিশ্চয়ই হতে। কতই বা আর লড়াই করার ক্ষমতা ছিল তোমার! জানি তুমি কষ্ট পেতে, বাকি জীবনভর কাঁদতে। কেঁদে তো জীবনে কিছুই অর্জন করতে পারোনি। রাগ করে, চেঁচিয়েও তো কিছু করতে পারোনি। তোমার চিৎকার অবকাশের চার দেয়ালের ভেতর ধাক্কা খেয়ে খেয়ে তোমার কাছেই ফিরে এসেছে। তোমার চোখের জল নদী হয়ে হয়ে তোমাকেই ভাসিয়েছে, ডুবিয়েছে।
মা, আপন আসলে কাঁদের বলবো মা? ভাইরা কি আপন? কী করে ছোটদাপারলো তার যে বোনটা দেশে ফিরতে পারছে না, তার বাড়িতে থেকে তারই সর্বনাশ করতে? তুমি যতদিন ছিলে, আমার যা কিছু সব যত্ন করে রেখেছিলে। ছোটদাকে তুমি খুব ভালোবাসতে বাসতে তো মা। আমার বাড়িতে ছিলে একসঙ্গে। কী হিসেবে ছিলে মা? ছোটদার দাসী হিসেবে, তাকে খাওয়ানো দাওয়ানো তো আছেই, তার কাপড়চোপড় ধোয়া, ইস্ত্রি করা, ফ্লাইটে যাওয়ার আগে তার সুটকেস গুছিয়ে দেওয়া, তার ঘর দোর, বিছানাপত্র সাজিয়ে রাখা, তার জন্য অপেক্ষা করা। কখন ফিরবে অপেক্ষা। ভোগবাদী ছোটদা বাইরে থাকতো প্রেম করতে, অথবা বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা দিতে, বাড়ি ফিরতো মদ খেয়ে মাতাল হয়ে, অথবা বাড়িতে বসেই মদ খেতো। তুমি ওগুলোকে মদ বলতে না, হাইনেকেন বিয়ার কে তুমি ভাবতে সবুজ কোকোকোলার ক্যান। কিন্তু ওই সবুজ কোক খেয়ে তোমার ছেলে অমন মাতাল হয় কেন, জীবনে কোনওদিন মাতাল না দেখা তুমি, কী রকম দুঃখ পেতে, তা আমি বেশ বুঝি। এই আদরের ছেলে যে অল্প বয়সে বিয়ে করে গীতা গীতা করে জীবন পার করলো, গীতার মুঠোর ভেতর থেকে বেরিয়ে আসা ছেলেকে তুমি প্রথম পেলে। কিন্তু কী রকম সে পাওয়া তোমার! ছোটদার আমার মনে হয় না তোমার প্রতি কোনও ভালোবাসা ছিল।
তুমি ঢাকায় এক ছেলের যত্ন করবে। আর বাবা ময়মনসিংহে আরেক ছেলের যত্ন করবে। এই তত ছিল অলিখিত নিয়ম, মা। তোমাদের যত্ন করার, তোমাদের কথা ভাবার কেউ ছিল না মা। সবাই যার যার নিজের জীবন নিয়ে ব্যস্ত। তোমার আদরের ধনেরা। তুমি বোধহয় আশা করতে তোমার বিপদে আপদে, অসুখে বিসুখে তোমার সন্তানেরা তোমার পাশে থাকবে। কিন্তু হল কই মা। কাউকেই তো পাওনি। আমার যে বাড়িটা তুমি গুছিয়ে রাখতে, আগলে রাখতে, তুমি বিদেয় নেওয়ার পর সংসারে আর কেউ নেই তুমি যা করতে, তার সামান্য হলেও করার। আমার আলমারিগুলো দেশ থেকে আমি বেরোবার পরই ছোটদা খুলে ফেললো সব। আমার এতদিনকার সব কিছু আমার জরুরি, অতি জরুরি কাগজপত্র, চিঠি, অপ্রকাশিত গল্প, উপন্যাস, প্রবন্ধ কবিতা–সব ছোটা খুলে দিল সবার জন্য। যে কেউ এসে যা ইচ্ছে করতে পারে আমার সব প্রয়োজনীয় সবকিছুকেই। ভেঙে ফেলতে পারে, আবর্জনার বাক্সে ফেলে দিতেপারে, নির্দ্বিধায় নিজের মনে করে নিয়ে যেতে পারে, ছিঁড়ে ফেলতে পারে। হ্যাঁ মা, বিশ্বাস করো নাই করো, আমার যক্ষের ধনকে ছোটদা বিলিয়ে দিল যার তার কাছে। যে কাউকে যা ইচ্ছে তাই করার অধিকার ছোটদা দিয়ে দিল। আমার কিছু আর আমার রইলো না। ছোটদা কেন এই কাজটি করেছে আমি আজও ভাবি। তার টাকার দরকার, সে সবকটি আলমারির তালা ভেঙে টাকা পয়সা খুঁজে যা কিছু তার দরকার নিয়ে আবার ঠিক সেরকম করেই রেখে দিতে পারতো যেমন ছিল সব, যেমন আমি রেখেছিলাম। একটি মেয়ে দেশে ফিরতেপারছে না, একটি মেয়ে নির্বাসনের দুঃসহ যন্ত্রণার মধ্যে দিন কাটাচ্ছে, সে তার নিজের যা কিছু গড়েছিল, সব ফেলে আসতে বাধ্য হয়েছে, আর তার বাড়িতে থেকে এত বড় অকৃতজ্ঞ হতে পারে কেউ মা? পারে, ছোটদা পারে। বাড়িতে কত কেউ থেকেছে, কী করেছে কে জানে। তোমার আলমারিটায় আমি তোমার জিনিসপত্র গুছিয়ে, যেভাবে তুমি নিজের হাতে রেখেছিল, সেভাবেই, তোমার চিঠিপত্র, তোমার বইখাতা, তোমার ব্যবহারের জিনিসপত্র, তোমার জগৎটাকে রেখে তালা লাগিয়ে এসেছিলাম। ইয়াসমিনকে বলেছিলাম, তুই দেশে গেলে ঢাকা আর ময়মনসিংহে রাখা মার দুটো আলমারি খুলে মার স্মৃতিগুলো স্পর্শ করিস। ইয়াসমিন গিয়েছিলো বটে দেশে, কিন্তু তোমার ময়মনসিংহে আলমারি খুলে তোমার জিনিসপত্রগুলোকে স্পর্শ করার তার সময় বা ইচ্ছে কোনওটাই হয়নি। ঢাকার বাড়িতে রাখা তোমার আলমারি ও বললো, খোলা। ঢাকায় এখন শুভ থাকে, তোমার আলমারিতে শুভ তার কাপড় চোপড় রাখে। শুনে আমি বাকরুদ্ধ বসে ছিলাম। শুভর কাপড় চোপড় রাখার জন্য মার আলমারি খুলে দিতে হল ছোটদাকে! শুভর জন্য কি কোনও আলমারি কিনে দেওয়া যেত না! ছোটদা ঠিক কী দিয়ে গড়া মানুষ, আমি জানি না। তোমার গর্ভ থেকেই তো জন্ম মা। তোমার হৃদয় উপচে ওঠা মায়া মমতার সামান্য এক তিলও পায়নি কি ছোটদা? কিন্তু পেয়েছে তো, সেটা ও কাজে লাগায় শুধু তার বেলায়, অথবা জুইএর বেলায়। তোমার সব স্মৃতি এক ফুৎকারে উড়িয়ে দিতে তার এতটুকু বাধে না। আমার জগৎকেপায়ের তলায় পিষে ফেলতে তার কোনও কষ্ট হয় না। সে তোমাকে আমাকে সবাইকে বিনা দ্বিধায় হাটে বাজারে বিক্রি করে দিতে পারে। সেই বিক্রির টাকাগুলো ডলার করে গীতার চরণে উৎসর্গ করতে পারে। কিন্তু গীতার সঙ্গে তো শারীরিক এবং সামাজিক সম্পর্ক চুকিয়ে ফেলে জুইকে বিয়ে করে তার সঙ্গেই জীবনযাপন করছে। তাহলে গীতার প্রতি তার এখনও এই ভালোবাসা কেন! আজও সে গীতার মতো দুষ্টু চরিত্রের মহিলার বিরুদ্ধে একটি শব্দও উচ্চারণ করে না, কারণ কি? গীতা, ছোটা বেশ জানে যে আমাদের বাড়ির সবাইকে ভুগিয়েছে। বাবাকে, তোমাকে, আমাকে, ইয়াসমিনকে অকথ্য অপমান করতে ছাড়েনি। গীতাকে কোনওদিন সে এ কারণে দোষ দেয়নি। ভালোবাসতে যে ছোটদা পারে না, তা নয়, পারে। নিজের জীবনে সে তা প্রমাণ করেছে। তবে বহুগামিতা তার রক্তে, তাকে দমন করার কোনও ইচ্ছে তার নেই। আমি পারি না এমন। দাদা, আমি, তুমি, ইয়াসমিন বড় দুর্ভাগ্যজনকভাবে একগামি। আমাদের পরিবারের সবচেয়ে সুখী এবং পরিপূর্ণ মানুষ ছোটদাই। দুঃখতার ধারে কাছে ঘেঁষতে পারে না। আমার চেয়ে বয়সে আট বছরের বড় হলেও তাকে দেখতে এখনও আমার চেয়েও কমবয়সি। আনন্দে থাকার এই একটা গুণ, মনের বয়স যেমন বাড়ে না, শরীরের বয়সও কোন অদৃশ্য গুহায় যেন লুকিয়ে থাকে। তুমি ভেবো না এরপরও ছোটদাকে আমি কোনও মন্দ কথা বলি। দেখা হলে এখনও আগের মতো আনন্দে ফেটে পড়ি। তার সামান্য কটা চুল পেকেছে বলে আমার সে কী মন খারাপ, কলপ লাগিয়ে কালো করার পরামর্শ দিই। ছোটদা অবশ্য বললো, মেয়েরা নাকি বলে ওই গ্রেতেই তাকে বেশি সেক্সি দেখতে লাগে। এই সেদিনও ছোটদার প্রেমে মেয়েরা কী করে উন্মাদ হয়, তার হাই-ইস্কুল-সুইটহার্টনাসরিন এতকাল পর কী করে স্বামী সন্তান ফেলে ছোটদার কাছে ছুটে ছুটে আসে, বললো। ছোটদার মন ভালো আছে, ভাবলে আমার ভালো লাগে। ছোটদা যা খেতে ভালোবাসে, তাই তাকে আদর করে খাওয়াই। ওয়াইন খেতে ভালোবাসে, সবচেয়ে ভালো ওয়াইন কিনে রাখি ওর জন্য। এই সেদিনও ছোটদাকে তার দুই ছেলেমেয়েসহ লাস ভেগাস আর গ্র্যাণ্ড ক্যানিয়েন বেড়াতে নিয়ে গিয়েছি, সবচেয়ে ভালো হোটেলে থেকেছি, ভালো রেস্তোরাঁগুলোয় খেয়েছি। আর সারাদিন রাত শুধু তুমুল হৈহল্লা আর গল্প করে কাটিয়েছি। যেন ছোটদার ভাল লাগে। ছোটদা খালি হাতে এলেও কখনও তাকে খালি হাতে বিদেয় দিই না। নিউইয়র্কে আমার বাড়িতে তাকে জোর করেই রেখে দিই, আমার বিছানায় তাকে ঘুমোতে দিয়ে যে বিছানায় আমার ভালো ঘুম হয় না, সে বিছানাতেই আমি রাত কাটাই। ছোটদার যেন আরাম হয়, ছোটদার যেন ভালো ঘুম হয় চাই। ইয়াসমিন আমার চেয়েও আরও এক কাঠি ওপরে, ছোটদা বলতে পাগল সে। ছোটদা আসবে শুনলে সে বাড়িঘরপরিষ্কার পরিচ্ছন্ন অভিযানে নেমে যায়, সারাদিনপনেরো যোলো রকম খাবার রান্না করে। দাদার জন্য একইরকম করি। কলকাতায় দাদা আমাকে দেখতে আসতো। খালি হাতেই আসতো, তবে একবার মুক্তাগাছার মণ্ডা আর গরুর মাংসের ঝুরি নিয়ে এসেছিলো, দুটোই আনার সময় গরমে নষ্ট হয়ে গিয়েছিলো। কিন্তু রেফ্রিজারেটরে ওইনষ্টগুলোই রেখে দিয়েছিলাম অনেকদিন। খেতে পারিনি, কিন্তু দেখে ভালো লাগতো, দাদা কিছু এনেছে। বন্ধুদের বলেছি, দাদা আমার জন্য দেশ থেকে কত কিছু নিয়ে এনেছে। দাদার রক্তে বেশি সুগার পেয়ে আমি দিন রাত ব্যস্ত হয়ে পড়লাম তার সুগার কমাতে, ডাক্তারের কাছে নিয়ে ইনসুলিন কতটা নেবে কী নেবে তা শুধু জেনে আসা নয়, সবচেয়ে আধুনিক যে ইনসুলিন বেরিয়েছে, সেসব ব্যবহার করিয়ে, তাকে পথ্য খাইয়ে, তার সুগার কমিয়ে, তার হতাশা দুর্বলতা ইত্যাদি ঘুচিয়ে পরে আমি শান্ত হলাম। দাদা নাটক দেখতে ভালোবাসে, তাকে প্রায় সন্ধেয় নাটক দেখাতে নিয়ে যেতাম। গান ভালোবাসে, একশ গানের সিডি কিনে দিই। তরুণ মজুমদারের সিনেমা তার ভালো লাগে, তাঁর সঙ্গেও যে করেই হোক আলাপ করিয়ে দিই। দাদার তাজমহল দেখার ইচ্ছে, সেই তাজমহলও দাদাকে দেখিয়েছি। রেডফোর্ট, আগ্রাফোর্ট সব। তোমাকে যেমন সেবা করেছিলাম, দাদাকে কিছু আমি কম করি না, মা। বাবার সম্পত্তি নিয়ে যা করেছে, সব জানার পরও দাদাকে পেলে জগৎ সরিয়ে রেখে দাদার শরীর মন সব সুস্থ করে তুলি। দাদা চলে গেলে চোখের জলে ভাসি। ভালোবাসাটা জগদ্দল পাথরের মতো হৃদয়ে বসে থাকে, সম্পত্তি বা টাকা পয়সার মতো তুচ্ছ কারণ এসে সে পাথর নড়াতে পারে না।