কেমনপুত্রধন পেটে ধরেছিলে মা? তোমার সততা, তোমার বিবেক, তোমার মায়া মমতার এক ফোঁটা ওরা কিছুপায়নি কেন! বাবার উদারতা, বিচক্ষণতা, বাবার আদর্শ, মনোবলও তো ওরা কিছু পায়নি। যে দিকটা বাবার মন্দ ছিল, সেই মন্দটাই বিকট করে বীভৎস করে দুজনকে গড়ে তুলেছে। ওরা ধনলোভ, কৃপণতা, স্বার্থপরতা পেয়েছে। বাবাও কিন্তু এতপাষণ্ড কোনওকালে ছিল না। বাবা শুধু তোমার সঙ্গেই নিষ্ঠুরতা করেছে, আর কারও সঙ্গে তো করেনি। শেষ বয়সে তার দুটো কন্যার সঙ্গে এই নিষ্ঠুরতা সত্যিই করেছে কিনা কোনওদিন তা জানার সুযোগ না হলেও, এই বোধোদয়ের সুযোগটা অন্তত হচ্ছে, যে, আপন দুটো ভাইয়ের সামান্যও ভালোবাসা দু বোনের জন্য নেই। ভাবতে দুঃখ হয়, ওরা আমার ভাই। কী জানি কী সুখ ওরা পায় বোনদের ঠকিয়ে। দুটো মাত্র বোন, এমন তো নয়, যে, সম্পত্তি অতি সামান্য, এমন তো নয় যে বারো কী তেরোটি বোন তাদের ভাগ নিয়ে নিলে ভাইদের কিছু কম পড়ে যাবে। বেঁচে থাকার জন্য কত টাকার দরকার হয় মা! কত সম্পদের দরকার! জানি, তুমি এই অন্যায় মেনে নিতে পারতে না। বাবা নিজেই অন্যায়টি জেনে বুঝে করে গিয়েছিলো, নাকি তাকে ভয় দেখিয়ে, ভুল বুঝিয়ে অন্যায়টি করতে বাধ্য করা হয়েছিল! আমরাও তো বাবারই সন্তান ছিলাম, আমাদের বঞ্চিত করার জন্য বাবা এত উদগ্রীব ছিলো কেন! এই রহস্যের সমাধান কোনওদিনই করা সম্ভব নয়। কারণ দাদা আর ছোটদা ছাড়া আর কেউ জানে না আসলে ঘটেছিল কী। তারা আমাদের কিছুই জানাচ্ছে না, শুধু এটুকুই বলছে যে বাবা নিজে উইল লিখে গেছে। বাবা যা করে গেছে তা যদি সত্যিই বাবার একক সিদ্ধান্তে হয়, ভাইরা, আমি অনুমান করি, ক্রমাগত এই মন্ত্রই বাবার কানে দিয়েছে যে আমাকে আর ইয়াসমিনকে সম্পদ বা সম্পত্তির যা-ই দেওয়া হবে, নিশ্চিতই সব মামাদের হাতে চলে যাবে। আমরা দু বোন মায়ের মতো মন পেয়েছি, সহানুভূতি সমবেদনা ইত্যাদি এত বেশি যে মামাদের অভাব দেখলে আমাদের যা কিছু আছে, সব ঢেলে দেব। বিশেষ করে আমি, মামাদের দুঃখ দুর্দশা ঘোচাবার পণ করেছি আমি, না দিয়ে আমি পারবো না। ভালো যে তুমি বেঁচে নেই মা, বেঁচে থেকে এসব দেখনি। আরও কষ্ট পেতে মা। তোমার বাবা মার জমিজমা তোমার ভাই বোনের মধ্যে দেশের উত্তরাধিকার আইনে ভাগ হয়েছিলো। ভাইরা দুভাগ পেয়েছে, তুমি আর তোমার বোনেরা একভাগ করে পেয়েছে। তোমার ভাগটায় শরাফ মামা একটা ঘর বানিয়ে থাকছে, নিজে যা পেয়েছিলো, তা সে বিক্রি করে দিয়েছে। তোমার ভাগে কে থাকছে, না থাকছে তা নিয়ে মাথা ঘামাওনি তুমি। শরাফ মামাকে তোমার ভাগটা লিখে দিতে তোমার আপত্তি ছিলো না, তোমার উত্তরাধিকারী হিসেবে আমার আর ইয়াসমিনেরও আপত্তি ছিল না যে তোমার ভাইদের কেউ নিয়ে যাক তোমার অংশ। এখনও নেই। কিন্তু তোমার ওইটুকু ছোট্ট জমিই নাকি এখন দাদা দাবি করেছে। যেহেতু লিখে পড়ে দাওনি কিছু, তাই দাদা ওটুকুও ছাড়েনি। যে ভাগ তুমি নিতে চাওনি, আজ তোমার গর্ভের সন্তান, তোমার প্রতি ভালোবাসা না দেখালেও তোমার জমির প্রতি তার ভালোবাসা দেখাচ্ছে। তোমাকে ছেড়ে দিতে তার মায়া হয়নি, তোমার ওই ছোট্ট সামান্য জমিটুকু ছাড়তে তার মায়া। তুমি কী দেখ এসব মা, আকাশের কোথাও থেকে দেখ? দেখে কী তোমার লজ্জা হয় না?
১২. ইতি তোমার আদরের নাসরিন
যতই বলি না কেন যে বাবা তার জীবনের শেষ সময়ে চরম নিষ্ঠুরতা করে গেছে তার দুই কন্যার সঙ্গে, অসম্ভব অপমান করেছে দুই কন্যাকে, বাবার জন্য তবু আমার কষ্ট হয়। তার পরও বাবার না থাকা আমাকে কাঁদায়। বাবা কবে থেকে নেই? মনে নেই। হয়তো দুহাজার এক বা দুই সাল হবে। তোমার আর বাবার ক্ষেত্রে মারা গেছে এই শব্দ আমি উচ্চারণ করি না কখনও। আমি পারি না। এরমধ্যে একদিন বাংলাদেশের একপুরোনোপরিচিতর সঙ্গে কথা হচ্ছিল। কথায় কথায় আমার ভাই বোন কে কেমন আছে প্রশ্ন ওঠায় বলেছিলাম, বাবা তো সব সহায় সম্পত্তি ছেলেদের নামে উইল করে দিয়ে গেছে। যার সঙ্গে কথা বলছিলাম, শুনে তাজ্জব, বলে, বাংলাদেশের ইসলামি আইনে তো উইল চলে না? চলে না? না চলে না। সমস্ত সম্পত্তির তিন ভাগের একভাগ শুধু লিখে দিতে পারে কাউকে, তাও আবার উত্তরাধিকারীদের অনুমতি নিয়ে। তাছাড়া সম্পত্তি লিখে দেওয়ার বা উইল করার নিয়ম নেই। ছোটদাকে একদিন বলেছিলাম, তুমি কি জানো যে বাংলাদেশে উইল চলে না? বললো, জানি। তাহলে বাবার উইলটা তো অবৈধ। ছোটদা বললো, তোরা মেনে নিলে বৈধ, না মেনে নিলে অবৈধ। আমি বললাম, আমরা তো মেনে নিইনি এই উইল, তাহলে সম্পত্তি ভাগ করার ব্যবস্থা করো। ছোটদা বললো, সম্পত্তি ভাগ আমরা করবো না, বাবা যা দিয়ে গেছে আমাদের, তা নেব। বললাম, আইনের আশ্রয় যদিনিই? ছোটদা বললো, নে, দেখি কী করে নিতে পারিস। ছোটা এবং দাদা জানে যে আমার পক্ষে দেশে ফেরা সম্ভব নয়। আর ইয়াসমিনের সেই মানসিক সবলতা বা সুস্থতা নেই যে ভাইদের বিরুদ্ধে দাঁড়াবে। অগত্যা আর সব দুর্ভাগা মেয়েরা বাংলাদেশে যেভাবে বঞ্চিত হয়, আমাদেরও তেমন ভাবেই বঞ্চিত হতে হবে। কিন্তু যে আমি সমানাধিকারের পক্ষে এতকাল লড়াই করে এসেছি, মেয়েদের বিরুদ্ধে সমাজের আর আইনের যে অন্যায় চলে, তার প্রতিবাদ করে এসেছি সেই অন্যায় যখন নিজের পরিবারে, নিজের জীবনে, তখন আপোস করবো? আপোস যদি করি, তাহলে আমার বিশ্বাসের সঙ্গে আমার নিজেরই প্রতারণা করা। না, মা, সম্পত্তির লোভ আমার নেই। পরিবারের সবার জন্য আমার উপার্জিত টাকার সিংহভাগ আমি খরচ করেছি ইচ্ছে করেই করেছি, ভালোবেসে করেছি। কিছু পাওয়ার আশায় করিনি। কিন্তু যাদের জন্য জীবন দিই, তারাই যখন পেছন থেকে পিঠে ছুরি বসানোর পরিকল্পনা করে, এবং বসায়, তখন চমকে উঠি। বিশ্বাস হতে চায় না রূঢ় নিষ্ঠুর বাস্তব।