.
বাবা মারা যাবার বছর দুই পর আমি দাদার কাছে জানতে চেয়েছি, বাবার জমি জমা টাকা পয়সা বাড়ি ঘরের কী করা হবে, কবে হবে ভাগবাঁটোয়ারা। বাংলাদেশ সরকার যেহেতু আমাকে দেশে ফিরতে দিচ্ছে না, ভাগাভাগির সময় ইয়াসমিনের যদি দেশে যাওয়ার দরকার হয়, যাবে। দাদা বললো, বাবা তার যা কিছু আছে, উইল করে দিয়ে গেছে তার চার ছেলেমেয়েকে। উইলের একটা কপি দাদা একদিন আমেরিকায় পাঠিয়ে দিল। জমি জমা ভাগের কথা আমার মাথায় আসতো না, যদি না আমি ইয়াসমিনের অর্থনৈতিক দুরবস্থা দেখতাম। উইল দেখে আমি আকাশ থেকে পড়ি। নান্দাইলের হাজার হাজার একর জমি, শহরের চব্বিশটা বাড়ি, অবকাশ, ঢাকার সবচেয়ে দামি এলাকা বারিধারার বিশাল প্লট সব ভাগ করা হয়েছে দাদা আর ছোটদার মধ্যে। বাবাকে অসুস্থ অবস্থাতেই ঢাকায় টেনে এনে বারিধারার জমিটা তার নিজের নামে লিখিয়ে নিয়েছিলো ছোটদা। ঢাকার বারিধারার জমি, জানিনা সেটা দশ কোটি নাকি কুড়ি কোটি টাকা দাম, ছোটদার। নান্দাইলের বিশাল জমিদারি দাদার। শহরের বাড়িগুলোও দাদার আর ছোটদার, আমি আর ইয়াসমিন শুধু ওই বাড়িগুলো থেকে ভাড়া যা আসে, তার শতকরা পনেরো ভাগ পাবো। ওই বাড়িগুলোর মালিক আমরা কোনওদিন হতেপারবো না। অবকাশ দাদার। অবকাশের পেছনে যে উঠোন আছে, সেই সেদিকটায়, ওই তেমনই, শতকরা পনেরো ভাগদু মেয়ে পাবে। কী দরকার ছিল বাবার এই উইলটা করার? বাবার সই আছেউইলে, এসইকি সত্যিই বাবার সই, আমি বারবার দেখি। হ্যাঁ বাবার সই, কিন্তু বিশ্বাস হয় না বাবা এই উইল সুস্থ মাথায় করেছে। কোনও উইল যদি বাবা না করতো, চারভাইবোনের মধ্যে সব ভাগ হতো। বাংলাদেশে যে নারীবিরোধী ইসলামি উত্তরাধিকার আইন আছে, সেই আইনেও যদি ভাগ করা হতো, তাহলেও আমার আর ইয়াসমিনের অর্থনৈতিক দুরবস্থা চিরকালের মতো ঘুচে যেতো। মা, তুমি কি জানতে বাবা এত সম্পদশালী ছিলো? আমার জানা ছিলো না। উইলের কোথাও লেখা নেই বাবার ব্যাংকের টাকার কথা। বাবার নতুন বাজারের চেম্বার, আরোগ্য বিতান এবং আরও কয়েকটা দোকান বিক্রি করে সব টাকা ব্যাংকে রেখেছিলো বাবা, সেসব হয়তো দাদা আর ছোটদাকে আগেই দিয়ে দিয়েছে। শুধু স্থাবর সম্পত্তির কথাই লেখা উইলে। আমার ভেবে কষ্ট হয়, বাবা তার দুই মেয়েকে কখনও ভালোবাসেনি। বাবা আর তার দুই পুত্র যদি ভেবেই থাকে, যে, আমি বিশাল এক ধনী কেউ, বাবার কোনও সম্পদ বা সম্পত্তি আমার না হলেও চলবে, তাহলে ইয়াসমিনের কথা কেউ ভাবেনি কেন? ইয়াসমিন তো অভাবে থাকে, ছোট একটা মুদির দোকানে কাজ করে। বাবা আর তুমি নিজের চোখে দেখে গেছো ইয়াসমিনের অভাব। তাহলে কে স্বচ্ছল, আর কেনয়, তার ওপর ভিত্তিকরে উইল হয়নি, উইল করা হয়েছে লিঙ্গের ভিত্তিতে। পুরুষ লিঙ্গ বেশি পাবে, স্ত্রী লিঙ্গ কমপাবে, অথবা পাবেনা। আমি বুঝি না কী করে বাবা এই চরম অসাম্যকে সমর্থন করেছে। দুটো মেয়ে যেন তার সম্পত্তির কিছু না পেতে পারে, সে কারণেই উইলটি করা হয়েছে বাবার মৃত্যুর আগে। বাবা যে বলতো, আমার লেখা বাবা খুব ভালোবাসে। নারী পুরুষের সমানাধিকারের কথাই তো জীবনভর লিখে গেছি। আসলেই কি সত্যিই ভালোবাসতো বাবা আমার লেখা! উইল তো তা বলে না মা। আমার আরও একটি কারণে, বিশ্বাস হয় না এই উইল বাবা কোনও চাপ ছাড়া করেছে। ধরা যাক, বাবা সম্পূর্ণ নিজের ইচ্ছেতে এই উইল করেছে, দাদাদের কোনও চাপ বাবার ওপর ছিলো না। কিন্তু দাদারা যদি বিশ্বাস করতো বোনদের উত্তরাধিকারে, তবে বাবার লেখা উইল তারা মেনে নিতো না। মেনে নেওয়ার একটাই কারণ তারা মেয়েদের কোনও অধিকারে বিশ্বাস করে না। সম্পত্তি ভাগ করার কথা আমি শত বলার পরও তারা যখন সমান ভাগে বা দেশের উত্তরাধিকার আইনেও ভাগ করছে না, তাতে আরও প্রমাণ হয় বাবাকে এই উইল করাতে বাধ্য করেছে দাদা আর ছোটদা। আমাদের চার ভাই বোনের মধ্যে শুধু অভাবেই নয়, সবচেয়ে বেশি মানসিক কষ্টে আছে ইয়াসমিন। আজ যদি ও বাবার সম্পত্তির ভাগ পেতো, তাহলে ও অশান্তির সংসার ছেড়ে একা বেঁচে থাকার মনোবল পেতো। দুই দাদা ওর কথা ভাবে না। ভাবলে কি আর বাবার বিশাল সম্পত্তি নিজেদের মধ্যে ভাগ করে নিত! আমি দাদাদের অনেক বোঝাতে চেয়েছি। বাবা যেভাবে ভাগ করেছে তার সম্পদ সম্পত্তি, তা অন্যায়। বাবা ভুল করেছে, অন্যায় করেছে, তোমরা তা মেনে নিচ্ছো কেন! তোমরা তো বলো আমার লেখা বই তোমাদের ভালো লাগে, আমি খুব সত্য কথা বলি, আমার আদর্শকে তোমরা সম্মান করো আমার বইয়ে আমি তো মেয়েদের অধিকারের কথাই বলি। বাবার সম্পত্তি ভাই বোনের মধ্যে সমান ভাগের কথা বলি। বাবা ভুল করেছে এ তো জানো তোমরা, তবে বাবার ভুলটা সংশোধন করছো না কেন, বাবার অন্যায়টা মেনে নিচ্ছো কেন? অনেক চিঠি পাঠিয়েছি। বলেছি, বাবার সম্পত্তি সমান ভাগ করতে প্রাণ না চায়, তাহলে দেশি আইনেই ভাগটাই বা করছে না কেন, যে ভাগে তোমরাই বেশি পাবে, আমরা কম পাবো? না, ওরা দু বোনকে উত্তরাধিকার থেকে বঞ্চিত করবেই। দেশে ফেরার অনেক চেষ্টা আমি করেছি। সে খালেদা বলো, তত্ত্বাবধায়ক সরকার বলো, হাসিনা বলো, কেউ আমাকে দেশে ফিরতে দিচ্ছেনা। ফেরার সব পথ যদি বন্ধ করে রাখে, তবে কী করে কী করবো বলো, কী করে দাদাদের এই অন্যায়ের প্রতিবাদ করবো! ইয়াসমিনের বিশ্বাস বাবা স্বেচ্ছায় ঠাণ্ডা মাথায় এই উইল করেছে। ইয়াসমিনের বিশ্বাস বাবাপুরুষতান্ত্রিক মনোভাবের লোক, বাবার কাছে পুত্ররাই তার বংশের লোক, কন্যারা নয়। বাবা যদি এত পুরুষতান্ত্রিক মানসিকতার মানুষ হতো, তাহলে মেয়েদের লেখাপড়ার জন্য প্রাণপাত করেছে কেন, পনেরো বছর বয়স হলে ধরে বেঁধে বিয়ে দিয়ে দেয়নি কেন? ছেলেদের ইস্কুল কলেজ নিয়ে যা করেছে, মেয়েদের ইস্কুল কলেজ নিয়ে তার চেয়ে কিছু কম তা করেনি! কী করে তবে বিশ্বাস করবো বাবা পুরুষতান্ত্রিকতায় বিশ্বাস করতো! সবচেয়ে মজার ব্যাপার, উইলে যে তিল পরিমাণ উত্তরাধিকার আমার আর ইয়াসমিনের, সেটুকুও আমরা কোনওদিন পাইনি। বাড়িগুলোর ভাড়া থেকে যে সামান্য আমাদের কাছে আসা উচিত, তা তো আসেইনি, অবকাশের উঠোনও ভাগহয়নি। দাদা আর ছোটদাইসব ভোগ করছে। দুভাইয়ে আগে এত সখ্য ছিলো না, বাবার অসুস্থতার সময় এবং বাবা মারা যাওয়ার সময় তাদের বন্ধুত্ব এবং ভ্রাতৃত্ববোধ তুঙ্গে উঠেছে। চারভাইবোনের মধ্যে অর্থনৈতিক অবস্থা সবচেয়ে খারাপইয়াসমিনের আর সবচেয়ে অনিশ্চিত জীবন আমার। আজ খেয়ে পরে বেঁচে আছি, কিন্তু কাল পারবো কিনা জানি না। লেখালেখি আমার উপার্জনের উৎস। তার ওপর আমি বাংলায় বই লিখি, পাশ্চাত্যের কোনও ভাষায় লিখি না। বাংলাদেশ থেকে বইয়ের কোনও রয়্যালটি আমি পাইনা। অন্য দেশে আজ বই চলছে, কাল হয়তো চলবে না। ভারতে বা বাংলাদেশে, যেখানে জীবন যাপনপশ্চিমের দেশগুলোর মতো এত ব্যয়বহুল নয়, আমার বাস করার কোনও অধিকার নেই। আজপশ্চিমে আমার মাথা গোঁজার ঠাঁই আছে, কাল কী হবে জানি না। জমানো টাকা ফুরিয়ে যেতে সময় খুব নেয় না। দাদারা যে আমাদের এই অনিশ্চয়তা জানে না, তা তো নয়, খুব ভালো করে জানে। কিন্তু একটা জিনিসই তারা নির্লিপ্ত থেকে প্রমাণ করেছে, আমাদের অভাবে অসুখে তাদের কিছু যায় আসে না।