কলকাতায় যখন এসেছিলো, হোটেল ঘরে বাবা আমার বই পেয়েছিল, আমার মেয়েবেলা। আমি তো নানা কাজে ব্যস্ত থাকি। হঠাৎ একদিন দেখি বাবা বইটা মন দিয়ে পড়ছে। আমি কেড়ে নিয়েছি বই। বাবাকে ওই বই আমার পড়তে দিতে ইচ্ছে করেনি। আমি জানি বাবা কষ্ট পাবে পড়লে যেসব অংশে বাবার সব দুষ্কর্মের কথা লেখা আছে, ওই যে গভীর রাতে বাড়ির কাজের মহিলার সঙ্গে একরাতে শুতে গিয়েছিলো। না, মা। আমি বাবাকে বাঁচিয়ে বা কাউকে বাঁচিয়ে আত্মজীবনী লিখতে পারিনি। এক রাতে হঠাৎ ঘুম ভেঙে গেলে দেখি বাবা বই পড়ছে। আমাকে লুকিয়ে লুকিয়ে পড়েও নিয়েছে বইয়ের অনেকটা। দেশে ফিরে যাওয়ার সময় যখন নিয়ে যেতে চাইলো একটা বই, জানি না কী ভেবে আর না করিনি। দাদার কাছে শুনতাম, বাবা নাকি আমার মেয়েবেলা বইটা যত্ন করে বালিশের তলায় রেখে দিয়েছে। প্রতিরাতে শুয়ে শুয়ে বইটাপড়ে। উতল হাওয়া বইটাও যোগাড় করেছিল। ওটাও বালিশের তলায় রেখে দিত। প্রতিদিন পড়তো, চেম্বারে যাওয়ার আগে, চেম্বার থেকে ফিরে। বাবা আমার লেখা ভালোবাসতো, তাই পড়তো। কিন্তু কষ্ট কী কম পেয়েছে। কোনওদিন আমাকে বলেনি কেন আমি তার কথা ওভাবে লিখেছি! কেন তার সম্মান আমি গুঁড়িয়ে দিয়েছি। কোনওদিন না। এই না বলা, এই না ধমক দেওয়া, এই না অভিযোগ করা, এই না নিন্দা করা আমাকে আরও ভুগিয়েছে। একবার দাদাকে বলেছিলাম আমার মেয়েবেলা আর উতল হাওয়া বইদুটো যেন যতীন সরকারকে আমার পক্ষ থেকে উপহার দেয়। যতীন সরকার একদিন অবকাশেও গিয়েছিলেন বইদুটো নিতে। কিন্তু বাবা তাঁকে বই দিতে চায়নি। বই না নিয়েই তাকে ফিরে যেতে হয়। কেন বাবা বই দিতে চায়নি আমি বুঝি। লজ্জায়। নিজের অহংকার, নিজের মাথা অন্যের সামনে মাটিতে মিশে যাক চায়নি। কিন্তু জগৎ যেপড়ছে! একদিকে ভালো হয়েছে, বইদুটোই বাংলাদেশে বেরোবার আগেই বা বেরোবার সঙ্গে সঙ্গেই নিষিদ্ধ হয়ে গেছে। আমি মনে মনে স্বস্তিই পেয়েছি মা। তা না হলে কত লোক বই পড়ে বাবাকে হয়তো বলতো, কী ব্যাপার, মেয়ে তো লিখে দিয়েছে তার দুশ্চরিত্র বাবার কীর্তি কাহিনী। বাবা যে প্রতিদিন আমার বইদুটো পড়তো, বাবা কোন অংশগুলো পড়তো, বাবাকে নিয়ে আমার প্রশংসার কথা, নাকি নিন্দার কথা! বাবাকে কেন প্রতিদিন বইদুটো পড়তে হত। কী পেত বাবা ওই বইয়ের মধ্যে। অতীত? হারিয়ে যাওয়া অতীত, সে যত নিষ্ঠুরই হোক, মধুরও তো ছিল মা।
দাদার কাছে আমার মেয়েবেলা বইটা খুব ভালো লাগে। দাদা বলে, কবিতার মতো। একদিন বাবাকে ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞেস করেছিলাম, ফোনে, যেন ভুলে গিয়েছি বাবা সম্পর্কে যত মন্দ কথা লিখেছি, সব, কেমন লেগেছে বই? বাবা বললো, খুব ভালো। আমি আবার জিজ্ঞেস করলাম, ভালো? বাবা আবারও বললো, হ্যাঁ খুব ভালো। তোমার লেখার হাত খুব ভালো। ভাষাটা চমৎকার। খুব সুন্দর লিখতেপারো তুমি। বাবা কিছু বলেনি তার সম্পর্কে যা লিখেছি তার কোনও কথা। আমিও বলিনি। বাবার প্রশংসা শুনতে শুনতে আমার চোখে জল চলে এসেছে। আমি আর কথা বলতে পারিনি বাবার সঙ্গে। গলা বুজে আসছিল। বই নিয়ে বাবার প্রশংসা আমাকেই বাবার সামনে ছোট করে দিয়েছে। ইচ্ছে হয়েছে বাবার চুলে সেই ছোটবেলার মতো হাত বুলিয়ে দিই। বাবার চুলে এখন তো আর কেউ হাত বুলোয় না।
তুমিও নেই। বাবাও নেই। আমার আর দেশে কারও সঙ্গে যোগাযোগ করার কোনও ইচ্ছে, হয়নি। প্রায় বছর গেলে যোগাযোগটা করতে হয়েছে তোমার নামে যে বৃত্তি দিচ্ছিলাম, সেটি যেন প্রতি বছর দেওয়া হয় সেই তাগাদা দিতে। আমার যে ফিক্সড ডিপোজিট আছে বাংলাদেশের ব্যাংকে, সেটির ইন্টারেস্ট চলে যায় বৃত্তির অ্যাকাউন্টে। কিন্তু ও টাকায় তো বৃত্তি সম্ভব নয়। আবারও টাকা পাঠিয়ে দিলাম যেন বৃত্তি দেওয়ায় কোনও ছেদ না পড়ে। দেওয়া হল বৃত্তি। তবে ছবি দাদা যা পাঠালো, দেখে অবাক আমি। হাসিনাকে সামনে আনা হয়েছে বৃত্তি অনুষ্ঠানে। যে তোমার সঙ্গে দুর্ব্যবহার করতো, আমি চাইনি এই বৃত্তির অনুষ্ঠানে তার উপস্থিতি। যে তোমাকে ভালোবাসেনি কোনওদিন, সে কেন তোমার পবিত্র অনুষ্ঠানাদিতে তার কুৎসিত মন নিয়ে সরবে উপস্থিত হবে! শুধু উপস্থিত নয়, রীতিমত ভালো কাজের নেত্রী বনে যাবে! দূর থেকে কী আর করতে পারি আমি, শুধু কষ্ট পেয়ে যাওয়া ছাড়া আমার করার কিছু নেই।
.
খবর পাই অবকাশ পুরো পাল্টে ফেলেছে দাদা। কত কোটি টাকা থাকলে বাড়িটাকে ওরকম বিরাট বড়লোকের বাড়ি করা যায়, তা না দেখলে নাকি বোঝা যাবে না। বাড়ির মোজাইক মেঝে ফেলে দিয়ে মার্বেল বসিয়েছে। বিশাল বিশাল সবুজ দরজা ভেঙে এখন নাকি লাগিয়েছে ছোট ছোট খয়েরি রঙের দরজা। বাবার ঘরটাকে শুভর ঘর করে দিয়েছে। ঝকঝকে তকতকে সব। সেই জানালাগুলোও নেই, সেই নানা রঙের কাঁচের জানালাগুলো। অবকাশের স্থাপত্য শিল্প আমাকে সবসময় মুগ্ধ করেছে। জানি না কী করে পুরোনো স্থাপত্য ভেঙে ম্যাচবাক্স করতে পারে লোকে। কী করে উঁচু সিলিং ধ্বংস করে, কড়িকাঠ ভেঙে মাথার এক হাত ওপরে নামাতে পারে ছাদ। কী করে কেটে ফেলতে পারে দেয়ালের বা কাঠের কারুকাজ। পশ্চিমের দেশগুলোয় দেখেছি যে কোনও মূল্যে তারা পুরোনো বাড়িগুলোকে রক্ষা করে। পুরোনো স্থাপত্য অমূল্য সম্পদ। দাদাকে আন্দালুসিয়া নিয়ে গিয়েছিলাম, স্পেনের দক্ষিণে। ওখানে তো তার দেখা হয়েছে। পুরোনো স্থাপত্য কী করে হাজার বছর ধরে রক্ষা করা হচ্ছে। এমনকী ঘোর শত্রুর বানানো বাড়ি বা মসজিদকিছুই স্পেনের লোকেরা ফেলে দেয়নি। ওখান থেকেও দাদা কিছু শেখেনি। আমার কেন যেন মনে হয় মা, বাড়ি ভেঙে নতুন করে বানানো, দাদার নয়, হাসিনার আবদার। দাদা এখন আর দাদার কথায় ওঠে বসে না। উঠোনের দুটো টিনের ঘরও ভেঙে ফেলেছে। বাইরের কালো ফটক পাল্টে ফেলেছে। ফটকের দুধারে কামিনী আর মাধবীলতার গাছও আর নেই। নারকেল গাছগুলোর পায়ে সাদা মোজা পরিয়েছে। বাথরুম ভেঙে নতুন করা হয়েছে, কমোড লাগানো হয়েছে। শুভর জন্য আলাদা বাথরুম, অ্যাটাচড। বাড়ির সামনের সেই রক আর সিঁড়ি সব ভেঙে মোগলদের বাড়ির মতো বড় থাম বসিয়ে ওপরে বড় করে অবকাশ নাম বসানো হয়েছে। যে অবস্থা বাড়িঘরের, অবকাশ নামটা যে রেখেছে, এই হয়তো বেশি। হয়তো অবকাশ বাদ দিয়ে ব্ল হেভেন বা ইডেন গার্ডেন রাখতে পারতো। বৈঠক ঘর আর আমার শোবার ঘরের মাঝখানে যে অসাধারণ তিনটে গরাদওয়ালা দরজা ছিল, সেগুলো আর নেই। দেয়াল তুলে দিয়ে ঘর জুড়ে পেল্লাই সব রাজা বাদশাদের বাড়ির মতো আসবাবপত্র বসানো হয়েছে। হঠাৎ করে আমাদের সেই অবকাশ ধনী লোকের আধুনিক বাড়িতে রূপান্তরিত হয়ে গেছে। পেয়ারা গাছ, জাম গাছ, কাঁঠাল গাছ, সেগুন গাছ কিছু আর নেই। যে গাছটা শেষে লাগিয়েছিলে, সেই কামরাঙা গাছটা, ওটা বিশাল বড় হয়ে ঝুঁকে আছে শত শত সবুজ কামরাঙায়। দেখলে নিশ্চয়ই তোমার খুব ভালো লাগতো। হয়তো ভেবেছিলে, ছেলে মেয়েরা খাবে। ছেলেরা নাতিরা হয়তো খায় মা, তোমার কথা কেউ মনেও করে না। বাড়িতে মামা খালাদের কোনও যাওয়া আসা নেই। যাওয়া আসা শুধু হাসিনার আত্মীয়দের। হাসিনা রানির মতো বাস করে। তার দুই পুত্র প্রাসাদের রাজপুত্তুর। অবকাশে আমাদের কোনও চিহ্ন রাখা হয়নি। আমাদের কারওরনা। অবকাশ এখন আগাগোড়াই হাসিনার বাড়ি। যেন হাসিনাই জন্ম থেকে থাকে ও বাড়িতে। হাসিনার বাপ দাদা কেউ বানিয়েছে বাড়ি, উত্তরাধিকার সূত্রে সে বাড়ির দখল পেয়েছে। দেখে মনে হয়, এরকম দামি আসবাবপত্রে, এরকম দামি মার্বেলে বাড়ি সাজাবে বলেই সে অপেক্ষা করছিল, কখন তুমি যাবে, কখন বাবা যাবে। জন্মের মতো যাবে। কখন বাড়ি খালি হবে। তোমাদের নিশ্চিহ্ন করার চেষ্টা বাড়িতে ঢোকার পর থেকেই সে করছিল। কী ভয়ংকর এবং কী রকম বীভৎস যে সেই লোভ, রাজত্বের লোভ! হাসিনার সারা শরীরে মনে অদ্ভুত পরিতৃপ্তি। কী ভীষণ কষ্টই না দিত ও তোমাকে! কী অপমানই না করেছে তোমাকে! তোমার মতো নিরীহ ভালো মানুষকে খুশি করতে খুব বেশি কিছুর দরকার ছিল না। তারপরও তোমাকে তোমারই সংসারে ক্রীতদাসীর মতো রেখেছে। বাবাকেও ওরকমভাবে বাবার বাড়িতে, বাবার খেয়ে, বাবার পরে, বাবাকে একইরকম ভাবে ক্রীতদাস করেছে। কাউকেই ছাড়েনি। এই যে বাবা তার দুই মেয়েকে বঞ্চিত করে সব সহায় সম্পত্তি দুই ছেলের নামে লিখে দিয়েছে, হাসিনা তো তাই চেয়েছিল, অঢেল সম্পদ একা একা ভোগ করার বাসনা তার অনেক দিন থেকেই ছিল। বিরাট প্রাসাদের রানি হওয়ার স্বপ্ন সে পূরণ করেছে। দাদা অসুখে ভুগছে, যে কোনও একদিন মরে যাবে। এর মধ্যে ছোটদা তার ভাগ যে করে হোক কবজা করেছে। বাবার বিশাল এসটেট মূলত এখন ভোগ করছে হাসিনা তার ছেলেদুটো সহ তার বাপের বাড়ির আত্মীয় স্বজন। বাবা কি ওর জন্য মাথার ঘাম পায়ে ফেলে সমস্ত বিষয় আশয় করেছিলো? কোটি কোটি নগদ টাকা কি বাবা হাসিনার আরাম আয়েশের জন্য রেখে গিয়েছিলো?