মনে আছে বাবার ওপর ক্ষুব্ধ তখন আমি, যখন তোমার ওই বৃত্তির ব্যানারটা দেখিয়ে দেখিয়ে বলেছিলাম, হ্যাঁ মার নামে ইস্কুল হবে, মার নামে বৃত্তি হয়ে গেল, বাবার মতো চরিত্রের লোকদের জন্য কিছুহবেনা। কেউ করবেনাইস্কুল, কেউ দেবে না বৃত্তি। বাবা তোমার পাশে বসে শুনলো। বাবাকে অপমান করার জন্য জোরে জোরেই বলছিলাম। তোমাকে খুশি করার জন্য, তৃপ্তি দেওয়ার জন্য, বাবাকে কেঁচোর মতো কুঁচকে ফেলার জন্য। জীবনে যে কখনও ভেঙে পড়ে না, তাকে ভাঙতে চাইছিলাম। যার জীবনে কোনও কষ্ট নেই, তাকে কষ্ট দিতে চাইছিলাম। তোমাকে এতকাল যেভাবে বাবা অপমান করেছে, সেই অপমানের প্রতিশোধ নিচ্ছিলাম মা। কীরকম বেপরোয়া আর বেয়াদপ হয়ে উঠেছিলাম। যে বাবার চোখের দিকে তাকিয়ে কোনওদিন কথা বলার সাহস ছিল না, সেই বাবাকে মাটির সঙ্গে মিশিয়ে দেওয়ার সব আয়োজন আমি করছি। তোমারও বোধহয় আমার ব্যবহার দৃষ্টিকটু লাগছিল। তুমি সম্ভবত বলেছিলে, এরকম বলো না, তোমার বাবারও তো শরীর ভালো নয়, পরে এই ব্যবহারের জন্য তোমারই কষ্ট হবে। তুমি ঠিকই জানতে মা, ওই ব্যবহারের জন্য আমার পরে কষ্ট হবে। বাবা শিশুর মতো বলেছিলো, আমার জন্যও ইস্কুল হবে। কোনওদিন কাঁদতে দেখিনি বাবাকে। কোনওদিন কোনও কারণে চোখের জল ফেলতে দেখিনি। কিন্তু যখন বলছিলো আমার নামেও ইস্কুল হবে, নান্দাইলে। বাবার ঠোঁট কেঁপে উঠছিল অভিমানে, অপমানে। হয়তো চোখও ভিজে উঠেছিল। বাবা বোধহয় একটু আড়াল করে চোখটা মুছেও নিয়েছিল মা। সারাজীবন বাবার কাছ থেকে যে দুঃখ পেয়েছো তুমি, তার শোধ নিতে চেয়েছিলাম। কিন্তু শোধ নিতে গিয়ে বাবাকে যে কষ্ট দিয়েছি, সেটাও কি এখন আমাকে কম ভোগাচ্ছে!
নান্দাইলে বাবার নামে ইস্কুল তো হওয়া উচিত মা। বাবা কাদামাটি থেকে উঠে এসে নিজে একার চেষ্টায় লেখাপড়া করে ডাক্তার হয়েছে। নিজের বই ছিল না, বই কেনার টাকা ছিল না, মেডিকেল কলেজের এক সহপাঠীকে অনুরোধ করে করে রাজি করিয়েছিলে রাতে যখন সে ঘুমিয়ে যাবে, তখন তার অ্যানাটমি বা ফিজিওলজি বই নিয়ে আসবে বাবা, রাত জেগে সে বই পড়ে ভোরবেলা সহপাঠীর বাড়িতে গিয়ে বই ফেরত দিয়ে আসবে। হ্যাঁ মা, রাতে সহপাঠীর বাড়ির বাইরে দাঁড়িয়ে থাকতো, কখন সহপাঠী ঘুমোত যাবে, আর তার বইটা বাবা পাবে। রাত জেগে বাবা ধার করা বই এনে পড়তো। সকালে সে বই সহপাঠীর বাড়িতে ফেরত দিয়ে পরে কলেজে যেতো। এভাবেই পড়ে বাবা ক্লাসে সবচেয়ে ভালো নম্বর পেতো। এই বাবার নামে ইস্কুল কেন হবেনা, মা? নিজের ছেলেমেয়ে তো বটেই, কাকাঁদের, কাকার ছেলেমেয়েদের, ফুপুদের ছেলেমেয়ে সবাইকেই তো বাবা লেখাপড়া করিয়েছে। এমনকী অবকাশে রেখে ওদের অনেককেইস্কুল কলেজে পড়িয়েছে। যত তার আত্মীয়, দূর আত্মীয় সবাইকে লেখাপড়া করিয়েছে, গ্রামের কত গরিবদের লেখাপড়া করার জন্য ইস্কুলে ভর্তি করিয়ে দিয়েছে, লেখাপড়ার খরচ জুগিয়েছে। বাড়ির বউদেরও ছাড় দেয়নি। ওদের সংসার করা বন্ধ করে কলেজে ইউনিভার্সিটিতে পাঠিয়েছে। তার নামে কেন ইস্কুল হবে না? চিরকাল পড়াশোনা করে বড় হও, নিজের পায়ে দাঁড়াও, ছেলে মেয়ে নির্বিশেষে শুধু শুকনো উপদেশ দেয়নি, দিন রাত ওদের পেছনেই অর্থ আর সময় ব্যয় করেছে। আমার সুযোগ থাকলে আমি ওই গ্রামে বাবার নামে ইস্কুল খুলতাম একটা। বাবা ছাড়া কে আর আছে ওই গ্রামের ছেলে যে লেখাপড়াকে সবচেয়ে মূল্য দিয়েছে! আমার কেন ইস্কুল খুলতে হবে, ওই গ্রামের লোকদের যদি বিবেক বলে কিছু থাকে, বাবার নামে ইস্কুল কলেজ খুলবে।
বাবার হয়তো জমিজমা কেনার আগ্রহ ছিলো, সন্তানের ভবিষ্যতের কথা ভেবেঅথবা নিজের শেকড়ের টানে। কিন্তু তাছাড়া পার্থিব জিনিসের প্রতি লোভ বাবার ছিলো না। কোনওদিন কারও দেওয়া কোনও উপহার ছুঁয়ে দেখেনি। দাদা, ছোটদা, আমি, ইয়াসমিন কত উপহার দিয়েছি তাকে। সবকিছুই আলমারিতে যত্ন করে রেখে দিতো। তোমার অসুখের সময় যখন বাবার ঘরটা তোমার জন্য পরিষ্কার করছিলাম, তোমাকে ও ঘরে শোয়াবো বলে, বাবার আলমারি খুলে দেখি আমার দেওয়া সব লোশন, পারফিউম, অডিটয়লেট, অডি কোলন, শেভিং কিটস, জামা জুতো, আরও নানা রকম উপহার সব সুন্দর করে সাজিয়ে রাখা কিছুই বাবা এত বছরে ব্যবহার করেনি। কিন্তু আলমারি খুলে প্রতিদিনই দেখতে সব, আলমারি তো নয়, তার এক বিচিত্র জাদুঘর। আলমারির চাবিটা খুব যত্ন করে পকেটে রেখে দিত, কাউকে দিত না। নিজের জামা জুতো না ছেঁড়া অবদি কিনতো না। সেলাই করে পরার অভ্যেস ছিলো। টুথ ব্রাশের দাঁতগুলো প্রায় সব ভেঙে গেলে তবে নতুন কিনতো। আমি কিনে দিলে সেটা যত্ন করে রেখে দিত, নিজে একটা কমদামি কিছু কিনে নিতো। দাড়ি কামাবার ব্রাশও, সেই কোন আমলের প্রায় ভোঁতা রেজর দিয়েই কামাতো, গাল কেটে কেটে যেতে। ফোম, আফটার শেভ? ওগুলো আলমারিতে পড়ে থাকতো। বাবা বোধহয় ভুলে যেতো না গ্রামের গরিব ঘর থেকে উঠে এসেছে সে। ঝকমকে ঝলমলে জিনিস তার জন্য নয়। নিউইয়র্কে একটা গাউন জোর করে ঘরে যখন থাকতো, পরিয়ে রাখতাম। হয়তো ভালো লাগতো তার, কিন্তু কী যেন আবার সব তাকে খুলিয়ে রাখতো।