আমার জন্য বাংলাদেশের দরজা বন্ধ। ইয়াসমিনকে পাঠিয়েছিলাম বাংলাদেশে বাবার সঙ্গে থাকার জন্য। ইয়াসমিন গিয়ে হাসিনার দাপট উপেক্ষা করে কিছুটা বাবার যত্ন করেছিল বটে, কিন্তু ও চলে আসার সঙ্গে সঙ্গে আবার আগের মতো দুরবস্থায় ফিরে যেতে হয়েছিল বাবাকে। ইয়াসমিনকে দিয়েও দাদা যে কাজটি করতো, সে কাজ করিয়েছে। বাবার বান্ধবীরা বাবার সঙ্গে দেখা করতে এলে অপমান করে বাড়ির ফটক থেকে তাড়িয়েছে। জানিনা সবাই হয়তো ভেবেছে, বাবার সাংঘাতিক উপকার তারা করে ফেলেছে। কী জানি কিসের উপকার। বাবাকে তারা জীবনের শেষ সময়ে এসে সতী সাধ্বী পুরুষ বানাতে চাইছিল হয়তো। বাবা একা একা পড়ে থাকতো হতাশার চরমে ডুবে। ওষুধ টষুধ সম্ভবত খেতো না। ওষুধ খাওয়াবার দায়িত্ব নেবে দাদা, সে সময় তার কই! আমার কেন যেন মনে হয়, হাসিনা বাবার মৃত্যুর জন্য দিন রাত প্রার্থনাই শুধু করছিল না, মরতে হলে যা যা করা প্রয়োজন তার সবই প্রাণপণে করে যাচ্ছিল। দাদা তড়িঘড়ি সব গুছিয়ে রাখছিল বাবার মৃত্যু হলে যেন তার কোনও অসুবিধে না হয়। বাবাকে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে জেনেছে কাকে কাকে বিয়ে করেছে, তাদের সবাইকে দাদাই বাবার সই নিয়ে তালাকনামা পাঠিয়ে দিয়েছে। পুংখানুপুঙ্খ হিসেব নিচ্ছিল দাদা, বাবার ধন দৌলত কোথায় কী আছে। কোথায় কোন অঞ্চলে কোন মাটি লুকিয়ে আছে। ইয়াসমিন দেশ থেকে ফিরে খবর দিল, বাবা উকিল ডাকছে বাড়িতে, দাদার সঙ্গে বসে পরামর্শ করছে সম্পত্তির ব্যাপারে। বিশাল সম্পত্তির মালিক বাবা, এ তো আমরা জানতাম। ঠিক কীরকম বিশাল সেই সম্পত্তি, তা হয়তো জানা ছিল না। বাবা যখন দাদার সঙ্গে জমি জমা নিয়ে কথা বলতে, ইয়াসমিন ঘরে ঢুকলে দুজনই চুপ হয়ে যেত। বাড়িতে উকিল এসে কথা বললেও সে ঘরে বাবার সঙ্গে দাদা থাকতো, ইয়াসমিনের থাকাটা কেউ চাইতো না। ইয়াসমিন বুঝতে পারছিল, তার উপস্থিতি অনাকাঙ্ক্ষিত। কিন্তু বাবার সন্তান হিসেবে দাদার যেটুকু অধিকার, সেটুকু তো ইয়াসমিনেরও অধিকার। বাবা যদি হিসেব করতে বসে তার সম্পদ সম্পত্তির, সেখানে তার সব সন্তানের উপস্থিতিই তো স্বাভাবিক। আলোচনা থেকে ইয়াসমিনকে বাদ দেওয়া হয় কেন! কেন হয়েছে তার রহস্য তখন না বুঝলেও সে অবশ্য পরে বুঝেছে।
বাবার মতো মানুষ, যে জীবনে কোনওদিন প্যান্ট সার্ট কোট ছাড়া কিছুপরেনি। পাজামা পাঞ্জাবি শুধুঈদের সময় পরতো। অনেকটা সামাজিক কারণেইপরতো। ধর্মীয় কোনও কারণ তো বাবার ছিল না। পাঞ্জাবিপাজামা টুপি দাড়িঅলা পাঁচবেলা নামাজ পড়া বিচক্ষণ বড়লোক এম এ কাহহার আর তারই ভাই মোমেনকে বাবা খুব শ্রদ্ধা করতো। বাবা কিন্তু ওদের পোশাক দ্বারা কোনও রকম প্রভাবিত হত না। এম এ কাহহার নিজেরপাড়ায় একটি মাদ্রাসা আর মসজিদ গড়ে দিয়েছে। বাবা জীবনে কখনও মসজিদে যায়নি, মাদ্রাসাতেও যায়নি, ওসব তৈরি করা তো দূরের কথা। মসজিদের চাঁদাও কখনও দিয়েছে বলে মনে হয় না। শুধু কি ওরাই, বাবার চারদিকে যারা ছিলো তাদের সবারই তো ধর্মের দোষ ছিল! বাবা কেন মোটেও চারপাশ দ্বারা প্রভাবিত হয়নি, অন্তত এই বিশ্বাসের ব্যাপারে! অন্য কত কিছুতে তো প্রভাবিত হত। জীবনের সব কিছু তো বাবার নিজের উদ্ভাবনের বিষয় ছিল না! নিজে ঘোষিত নাস্তিক না হয়েও কী করে দিব্যি ধর্ম থেকে। যোজন দূরে বাস করেছে! বছরে দুবার শুধু নামাজে দাঁড়াতো। তাও ওইঈদের মাঠে। সামাজিকতা বজায় রাখার জ্ঞান আবার টনটনে ছিলো। ওটা না করলে চলে না। কিন্তু নামাজ তত বাবা পড়তে জানতো না। কোনও সুরা সে জানতো না। লোকরা মাথা নোয়ালে সেও নোয়াতো, ওঠালে ওঠাতো। এ ছাড়া আর কী! একবার সুরা শেখার জন্য একটা লোক রেখেছিলো মনে আছে, জানিনা ওটা আবার কারপাল্লায়পড়ে করেছিলো। দুদিনপর লোককে বিদেয় করে দিয়েছে। ও বাবার পোষাতো না।
মানুষ তো এমন, বয়স বাড়লো, হঠাৎ হুট করে টুপি দাড়ি শুরু হল, পাজামা পাঞ্জাবি শুরু হল, পাঁচবেলা নামাজ শুরু হল। কিন্তু বাবা কেন কোনওদিন সামান্যও বদলাতে চায়নি নিজেকে! .. একটুও ধর্মচিন্তা তার ভেতরে আসেনি। বাবার ওই মেয়েমানুষের দোষ ছাড়া আর তোমাকে অবহেলা করা ছাড়া আর তো কোনও দোষ ছিল না। সব তো তার গুণই ছিল। তারপরও দেখ মেয়েদের নিয়ে যা করতো, সব কিন্তু বাইরে করতো। কোনওদিন ঘরে কোনও মেয়েকে আনেনি। কোনওদিন আমাদের কাউকে বুঝতে দেয়নি আদৌ তার কোনও সম্পর্ক কারও সঙ্গে আছে। কেবল শুনেছি, প্রমাণ পাইনি। নিজের কোনওকিছু ছেলেমেয়েদের না জানানোর মানসিকতাই। বা কোথায় বাবা পেয়েছিলো, যখন অন্যরা দিব্যি দ্বিতীয় বিয়ে করে বাড়িতে বউ তুলছে! বাবা তার নিজের ব্যক্তি-জীবন, অন্য কারও সঙ্গে সম্পর্ক বা বিয়ে আমাদের জীবন এবং জীবন যাপন থেকে সম্পূর্ণ আলাদা রেখেছিলো। এক শহরেই বাস করি, অথচ কোনওদিন আমাদের জানা ছিল না বাবা বাড়ির বাইরে কোথায় কার সঙ্গে কী সম্পর্ক করছে। এমন কোনও রাত নেই, যে রাতে বাবা অবকাশে রাত কাটায়নি। শুধু শহরের বাইরে কোনও মেডিকেল কলেজে পরীক্ষা নিতে গেলে বা চাকরিসূত্রে কোথাও গেলে দেখেছি বাবা নেই অবকাশে। ইস্কুল শেষ না হতেই দেখতাম মেয়েদের বিয়ে হয়ে যাচ্ছে। শহরের অন্য বাবারা তো মেয়েদের যে লেখাপড়া করে বড় হবার, নিজের পায়ে দাঁড়াবার দরকার আছে, তা-ই মনে করেনি। কিন্তু বাবা তো ওদের মতো ছিল না। এমনকী বন্ধু কাহহার বা মোমিনের মেয়েদেরও তো ইস্কুলের গণ্ডি পেরোতে না পেরোতে ধরে বেঁধে বিয়ে দিয়ে দিয়েছে, শুধু ছেলেদের লেখাপড়ার জন্য যা করার সব করেছে। বাবা ওদের কাছ থেকে শেখেনি সমাজের এই নিয়মটা। তার কাছে প্রতিদিন লোক আসতো মেয়েদের বিয়ের জন্য পাত্রর খোঁজ নিয়ে, সবাইকে এক বাক্যে বাবা না করে দিত। বাবা তো ওই সমাজেই বাস করতো, যেখানে মেয়েদের অল্পবয়সে বিয়ে দিয়ে দেওয়াটাকেই যৌক্তিক মনে করতে সবাই। বাবা তো তার গন্ডগ্রাম নান্দাইল থেকে মেয়েদের ডাক্তার ইঞ্জিনিয়ার বানানোর চিন্তাধারা নিয়ে আসেনি! যদি বাবাকেশিখতেই হয় অন্যদের থেকে, যদি তার নিজের না হয় এই আবিষ্কার, তবে দেখ, যারা শহরের শিক্ষিত বনেদি বাড়ির বড় বড় লোক, যাদের মেয়েরা লেখাপড়া চালিয়ে যেত, বড় হতো, সেসব বাড়ির সঙ্গে বাবার খুব মেলামেশা না থাকার পরও বাবা ওদের ওই নিয়মকে পছন্দ করলো কেন, কেন সমাজের বেশির ভাগ মানুষের নিয়মকে নয়!