এই বেলজিয়ামে কত যে উৎসব হয়েছে আমাকে নিয়ে। এই ব্রাসেলসএর রাস্তায় ছিল আমার বুলেটপ্রুফ গাড়ির সামনে পেছনেপুলিশের গাড়ি, রেড কার্পেট রিসেপশান। ছিল প্রধানমন্ত্রীর আমন্ত্রণ। ব্রাসেলস বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্রিসমাসের ছুটি হয়ে যাওয়ার পরও আমার বক্তৃতা শুনবে বলে সবারই বসে থাকা, গেন্ট বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আমার ডকটর অনোরিস কোজা’ বা ডক্টরেট পাওয়া, সঙ্গে আমি ছাড়া যাঁরা পেয়েছিলেন, সবাই আগে নোবেলপুরস্কার পেয়েছেন। বেলজিয়ামের এয়ারলাইনস সাবেনা ভয় পেয়ে আমাকে, ফতোয়া আক্রান্ত লেখককে, উড়ানে নেয়নি বলে প্রেস কনফারেন্সে সাংবাদিকদের ক্ষোভে ফেটে পড়া, আমাকে বিপুল সমর্থন জানানো। জনগণ আমাকে দুদণ্ড দেখার জন্য উতলা। সেই একই আমি ব্রাসেলসএর রাস্তায় যখন হাঁটছি, আমি নিতান্তই বাদামি রঙের এক মেয়ে, সম্ভাব্য ইমিগ্রেন্ট, ইললিগ্যাল। টুরিস্ট নই। বাদামি রঙের মেয়েরা সাধারণত গরিব দেশের, পর্যটক হওয়ার সামর্থ্য তাদের নেই। যত তোমাকে আমার সেই ঝলমলে দিনের কথা বলেছি, তুমি তত বোধহয় অবাক হয়েছে। কারণ তুমি এসে যা দেখছো, তার সঙ্গে আমার গল্পের কিছু মিলছে না। আমি এখন রাস্তার যে কোনও মানুষের মতো। কেউ চিনতে পারছেনা আমাকে। আমার গল্প তুমি শোনো, কিন্তু এ নিয়ে তুমি আরও শোনার আরও জানার কোনও আগ্রহ দেখাও না। আর যদি দেখতেইমহোৎসব, খুব কিপুলকিত হতে! মনে হয় না আমার। তুমি ওই ঘরের মেয়ের ঘরে ফেরার কথাই ভাবতে।
.
ছোটদাকে ব্রাসেলসে রেখে, তোমাকে নিয়ে সুইডেনে ফিরি। যে বাড়িতে তোমাকে ওঠালাম সুইডেনে, বাড়িটা বড়, আধখানা মাটির তলায়, আধখানা ওপরে, বাড়িটার সামনে পেছনে মাঠ আছে, মাঠে গাছগাছালি আছে, কিন্তু বাড়িটা আমার নয়, বাড়িটা অন্যের। গোপনে তুমি কি দীর্ঘশ্বাস ফেলেছিলে? হয়তো ফেলেছিলে। কেন নয়! আমি তো কোনও পুরুষের বাড়িতে আশ্রিতা হিসেবে থাকার মানুষ কোনওদিনই ছিলাম না। দেশে থাকাকালীন যুদ্ধ করেছি একা থাকার জন্য! ঢাকা শহরে আর কোনও মেয়ে কি একা থাকতে পেরেছিলো আমার মতো! নোংরা পুরুষতান্ত্রিক সমাজের সঙ্গে কী ভীষণ লড়াই করেই না শুধু মনের জোরে আমি একা থাকতে শুরু করেছিলাম। একা দাঁড়িয়েছি। একা বেঁচেছি। সেই আমিই কিনা একশ বছর পিছিয়ে গেলাম। একটা লোকের সঙ্গে আমার বাস। লোকটাকে আমি মানিয়ে চলি। হ্যাঁ মা, মানিয়ে চলি। আমি যতই তোমাকে বোঝাতে চেয়েছি, আমরা বন্ধু, যে যার মতো থাকি, আমার যেমন ইচ্ছে তেমন চলি, তার যেমন ইচ্ছে সে তেমন চলে। কিন্তু তোমার চোখ তো মা, মায়ের চোখ, মায়ের চোখ বোধহয় এমনই হয়, কিছু বলার দরকার হয় না। তোমার চোখকে ফাঁকি দেওয়ার উপায় নেই। আমার মানিয়ে চলাটা আমার চোখে না পড়লেও তোমার চোখে পড়ে। চারদিক অন্ধকার হয়ে আসতো। আমরা ঘরবন্দি পড়ে থাকতাম। তোমাকে নিচের তলায় একটা ছোট ঘরে জায়গা করে দিয়েছিলাম মা। ঘরটা সম্ভবত বারো বাই দশ ফুটের একটা ছোট ঘর। তুমি আসার আগেই ঘরটাকে একটুখানি গুছিয়েছিলাম, একটা ছোট টেবিল আর একটা বুকসেল্ফ পেতে, বিছানায় ভালো চাঁদর পেতে। পুরো বাড়িটা কাঠের। সুইডেনের চিরাচরিত লাল বাড়ি, জানালাদরজার সাদা বর্ডার। ওপরতলায় একটা শোবার ঘর, সে ঘরের সঙ্গে একটা স্নানঘর, পাশে লন্ডি। শোবার ঘরে ঢুকতে হয় বাঁদিকে রান্নাঘর আর খাবার ঘর রেখে। খাবার ঘরের মাঝখান দিয়ে নিচের তলায় চলে গেছে সিঁড়ি। ওপরে সিঁড়ির দুকিনারে দুটো ঘর, একটা ছোট, আরেকটা খানিকটা বড়। ছোটটায় সুয়েনসনের বইপত্তর, বড়টায় আমার ডেস্ক, বইয়ের আলমারি, যাবতীয়। মা তুমি তো এসেই দেখেছো এসব। দেখেছো আমার আর সুয়েনসনের শোবার ঘর একই। আমরা এক বিছানায় শুই। তোমাকে এত যে রক্ষণশীল বলে ধমক দিই, তুমি কিন্তু একবারও প্রশ্ন করোনি ওর সঙ্গে আমি শুই কেন। যে সম্পর্ক হলে শুতে হয়, সম্ভবত সম্পর্কটা সেই সম্পর্ক, তুমি ভেবে নাও। আগেও দেখেছো কায়সারের সঙ্গে বিয়ে না হয়েও একটা সম্পর্ক ছিল আমার। এই সম্পর্ক নিয়েও তুমি মাথা ঘামাও না। মাথা ঘামাও আমি কেমন আছি, তা নিয়ে। তখন কি আমি প্রাণপণে প্রমাণ করতে চাইছিলাম না যে খুব ভালো আছি? হ্যাঁ চাইছিলাম। বিদেশ বিভুইএ যে একাকীত্বে ভুগছি না, সঙ্গে যে একটা সঙ্গী আছে, সে সঙ্গী যেমনই হোক, শরীরের চাওয়া পূরণ করার জন্য কেউ যে আছে, তা তোমাকে দেখিয়ে দিই যেন তুমি স্বস্তি পাও। তুমি কি স্বস্তি পেয়েছিলে মা? আমার মন বলে, পাওনি। পাওনি বলে বারবার তুমি দীর্ঘশ্বাস ফেলেছো। বুঝেছিলে, লোকটি, যে লোকটির সঙ্গে আমি ঘুমোই রাতে, তার সঙ্গে আমার লক্ষ যোজন ব্যবধান। এই ব্যবধান নিয়ে আর যাই গড়া যাক, কোনও সম্পর্ক গড়া যায় না। আমিই কি আর তা জানি না? কিন্তু তোমাকে বলিনি যে আমার আর উপায় নেই। দেশে যেমন ছিলাম আমি, যে তেজ, যে আগুন, যে জোর নিয়ে আমি বাঁচতাম, দেখেছো নেই। তলোয়ারের ঘায়ে দেশ আমাকে শত টুকরো করতে চাইলেও এমনশক্তিময়ী ছিলাম যে আমাকে স্পর্শ করতে পারতো না। আমার ধারের কাছে এসে ধারালো তলোয়ারও ভেঙেপড়তো। দেখলে, আমার সব গেছে। শরীরের সেই অসাধারণ সৌন্দর্যও আর নেই। সেই তন্বী সুন্দরী এখন মেদবহুল পিপে। একটার পর একটা সিগারেট ফুকছে। তুমি টিকতে পারছে না দুর্গন্ধে। কিন্তু এ তোমার প্রাণের চেয়ে প্রিয় মেয়ের মুখ থেকে বেরোচ্ছে, তার সারা শরীর থেকে কাপড় চোপড় থেকে, তার বিছানা বালিশ থেকে–তুমি কী করে দূরে সরো, তোমাকে ওই দুর্গন্ধে অভ্যস্ত হতেই হবে। এ ছাড়া তোমার করারই বা কী ছিল। না, গন্ধ সইতে তোমার ভালো লাগছেনা বলে নয়, বারবার তুমি আমাকে সিগারেট ছাড়তে বলো আমার ভালোর জন্য। সিগারেট খাওয়া শরীরের জন্য ক্ষতিকর। সে তো আমি জানিই, তারপরও বলো। বলো মুখে কিছুলবঙ্গ বা এলাচ রাখতে, নয়তো চুইংগাম রাখতে, কিছু একটা রাখতে বলো যেন সিগারেট ছাড়া যায়। আমি তোমাকে বিষম হেসে সিগারেটের নানাবিধ উপকারিতা বর্ণনা করি। বাপ ভাইরাই যেখানে সিগারেট খায়নি কোনওদিন, সেপরিবারে মেয়ে হয়ে সিগারেট খাচ্ছি, সংস্কার টংস্কার সব গুঁড়িয়ে দিয়েছি, রীতি নীতিরপরোয়া করি না। কার সাধ্য আছে এত সাহসী হয় আমার মতো!