বাবা আবার কথা বলতে পারবে, এই আশায় আমি বসে থাকি, বার বার শুনছি অবস্থার কোনও পরিবর্তন হয়নি। দাদা, ছোটদা, ঝুনু খালা, বড় মামা, ফকরুল মামা সবার সঙ্গে কথা বলি। সবাই বিষণ্ণ। বাবা ফিরছেনা। তাকাচ্ছে চারদিকে, সেই তাকানো অর্থহীন। মুখের শব্দকে কেউ কেউ অনুবাদ করার চেষ্টা করছে, কিন্তু সবই নিশ্চয়ই ভুল অনুবাদ। ঝুনু খালা শুধু বললো, দুলাভাই কিছু বলতে চাইছে, পারছে না। কী বলতে চাইছিলো বাবা?
একসময় আমাকে জানিয়ে দেওয়া হল, বাবা আর শ্বাস নিচ্ছেনা। ঝুনু খালা ফোনে হাউমাউ করে কাঁদলো। আমি আর জানতে চাইনি এরপর কী ঘটছে। বাবাকে নিয়ে কী মৃত্যুউৎসব তারা করছে, জানতে চাইনি। আমার আগ্রহ, আবেগ সব বেঁচে থাকাকালীন। আমি মৃত্যুরপরের কোনও কিছুতেই বিশ্বাসী নই। জগৎ আমার সম্পূর্ণই ফাঁকা হয়ে গেছেমা। শেষ আশ্রয় বলে কিছু থাকে, বাবা আমার তাই ছিলো। বাবা ছিলো আমার গৌরব, জীবনের সবচেয়ে বড় অহংকার। বাবা ছিলো আমার পথ প্রদর্শক, আমার সাহস আর শক্তির উৎস। বাবা ছিলো বলেই আমি আজ আমি, এই যে মাথা উঁচু করে আজ পৃথিবীর সব দেশে চলতে পারি, সে বাবা আমাকে গড়ে দিয়েছিলো বলেই। আমার বাবা যদি অন্য কেউ হতো, তাহলে আজি আমিও অন্য কেউ হতাম। জীবনের যা কিছুই আমার কৃতিত্ব, বাবা ছাড়া কিছুই সম্ভব হতো না। সংগ্রামী বাবাকে দেখে দেখেই সংগ্রাম করতে শিখেছি। সামনে দুর্যোগ এলে বাবা যেমন করে সামলাতো, তেমন সামলাতে আমিও শিখেছি। আদর্শের জন্য প্রাণপাত করতে বাবা ছাড়া আর কাকে দেখেছি, চোখের সামনে!
.
তোমাকে যেমন অবকাশে অত্যাচার করছিলো দাদা আর দাদার বউ, একইরকম ভাবে বাবার ওপর শুরু হল অত্যাচার। এসব আমাকে বাবাই বলতো আর কাঁদতো। একসময় অবকাশে খাওয়া বন্ধ করে দিয়েছিলো। নিজের বাড়ি। নিজের টাকা। সব নিজের অথচ খাবার জোটেনি বাবার। অভিমানে বাবা, ডায়বেটিসে কিডনি নষ্ট হতে থাকা বাবা, যেখানে তার মাছমাংস খাওয়া বারণ, ছটকুর রেস্তোরাঁয় গিয়ে ওসবই খেতো৷ কী করবে বলো! কে তাকে আদর করে সবুজ সবজি সেদ্ধ করে দেবে। হাসিনা তো দেবে না। হাসিনার সঙ্গে রাগ করে বা অভিমান করে বাবা কথা বন্ধ করে দিলে লাভ হাসিনারই হয়। হাসিনা, আমার ধারণা, চাইছিলো বাবা যেন তাড়াতাড়ি মারা যায়। যেমন চাইছিলো তুমি যেন মারা যাও। কষ্ট পেতে পেতে, দুর্ভোগ পোহাতে পোহাতে যেন মরো। এত আদর করে বউকে ঘরে তুলেছিলে। মুখে তুলে খাওয়াতে। কোনওদিন যাকে রান্নাঘরের ছায়াও মাড়াতে হয়নি। কারও জন্য রাঁধা তো দূরের কথা। বরং বিয়েরপর বাবা তাকে কলেজে ভর্তি করিয়ে দিল, বিএড এমএড পাশ করতে। বউ কলেজ থেকে ফিরলে তুমি তাকে আদর করে খেতে বসাও, ঠিক যেমন করে তোমাদের ছেলেমেয়েদের খাওয়াও। যে বউ শুধু আমাদের দু বোনকে অপমান করে অবজ্ঞা করে অপদস্থ করে ছাড়েনি, এমনকী গায়েও হাত তুলেছে। ভেবেছিলাম দুবোনকেই বোধহয় শুধু। কিন্তু তোমার মতো মাটির মানুষকে, যে মানুষ জীবন দিয়ে দেয় ছেলে মেয়েদের জন্য, ছেলের বউদের জন্য, তাকে চোখের জলে ভাসাতো। তোমার টাকাপয়সা ধন দৌলত কিছু ছিল না। ছিল বড় একটা হৃদয়। এই তোমাকেই যে জ্বালিয়ে পুড়িয়ে ছাই করে দিয়েছে, সে বাবাকে দেবে না কেন! বাবার আজীবন প্রতাপছিল। যে বাবাকে দেখে ভয়ে কেঁপেছি সারাজীবন, সেই বাবা দুর্বল হয়ে পড়লে গালি গালাজ করার স্পর্ধা তো আমাদের কারও হয়নি। হয়েছে হাসিনার। হাসিনা দিনভর অকথ্য ভাষায় বাবাকে গালি দিত। উঠতে বসতে অপমান করতো। বাবার সেই রোষ আর ছিল না। দাদা ভেঙে দিয়েছিল। বাবাকে ঘরবন্দি করে ভেঙে দিয়েছিল বাবার সব দাপট। বাবার চেম্বারবিক্রি করে দিয়ে গুঁড়ো করে দিয়েছিল বাবার সব স্বাধীনতা। পরাধীন বাবা মাথা নিচু করে দাদার আর দাদার বউএর অত্যাচার সইতো। প্রতিদিন। যে মামাদের বিরুদ্ধে কথা বলে বলে বাবা সময় কাটাতো দাদার সঙ্গে, দাদার বউএর অত্যাচার থেকে বাঁচতে সেই মামাদের কাছে গিয়ে বাবা আশ্রয় নিতো। ছটকুর কাছে সংসারের দুঃখের কাহিনী বাবা বলতো। সব শুনে ছটকু আমাকে ফোন করতো। যেন বাবার সমস্যার সমাধান করি, যেন বাবার কান্নাগুলো শুনি। বাবা সত্যি সত্যি কাঁদতো। মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে থাকা বাবা, কোনও দুর্যোগ দুঃসময় যাকে ভাঙতে বা মচকাতেপারতোনা, সেইভয়ংকর প্রতাপশালী বাবা কী করে এমন অসহায় হয়ে যেতে পারে! কে তাকে অত নিরস্ত্র করেছিলো? বয়স? ওই বয়সে মানুষ দাপিয়ে বেড়ায়। অসুখ? অসুখ তো বাবাকে কোনওদিনই কাবু করতে পারেনি। কী অসুখ ছিল বাবার? ধীরে ধীরে কিডনি নষ্ট হচ্ছিল। হচ্ছিল, হয়ে তো আর যায়নি। কত কিডনি নষ্ট হওয়া মানুষকে দেখেছি, রক্ত পাল্টাচ্ছে, আর দিব্যি বেঁচে থাকছে। আত্মীয় স্বজন আর বন্ধুরা পাশে থাকলে শরীরে অসুখ থাকলেও, মনে সুখ থাকে। কিন্তু বাবার শারীরিক কষ্টের চেয়ে মানসিক কষ্টটাই দুর্বিষহ হয়ে উঠেছিল। বাবার টাকায় দাদা তার বউ বাচ্চা নিয়ে বাবার বাড়িতে থাকছে, খাচ্ছে, পরছে। সেই বাবাই বাড়িতে জবুথবু বসে থাকে। শুভ, তার আদরের নাতি তাকে ছুরি নিয়ে তাড়া করে, বাবা ছুরির ভয়ে দৌড়ে পালায়। না, নাতির সঙ্গে দাদাভাইয়ের খেলা নয়, বাবা সত্যি সত্যি ভয়ে দৌড়োয়। কাঁদতে কাঁদতে আমাকে তো বললোও হাসিনা নাকি ফাঁক পেলেই বলে, দুনিয়ার কত কেউ মরে, বুড়োটা মরে না কেন!’ বাবার চুল পাকেনি, বয়স সত্তরও হয়নি, মাথায় কোনও গণ্ডগোল হয়নি, দিব্যি শক্ত সমর্থ মানুষ, সেই বাবাকে বুড়ো, দুর্বল, পঙ্গুর মতো ঘরে বসিয়ে রাখলো, ঘরে বসিয়ে বাবার মতো কর্মঠ কাজপাগল মানুষকে মেরে ফেললো! হ্যাঁ মা, বাবা আর সেই বাবা ছিল না। দাদা দৌড়োচ্ছে বাবার সম্পত্তি পেতে। দাদার বউ ঘরে অতিষ্ঠ করে মারছে বাবাকে। যে অসুখে যে খাবার খাওয়া বারণ বাবার, বাবার কপালে সেসব ছাড়া আর কিছু জুটছেনা। ক্ষিধে পেলে বাবা করবে কী? তার নিজের বাড়ির রান্না করার তোক তো আর তার কথা শুনবে না, শুনবে দাদা, হাসিনা আর তাদের ছেলেদের হুকুম। বাবার কান্না শুনতে হয় আমাকে দিনের পর দিন। দাদাকে জিজ্ঞেস করেছি, বাবা কেন খাচ্ছেনা বাড়িতে? ’দাদার ঠাণ্ডা উত্তর, বাবা কথা শোনে না, বাইরে বেরিয়ে যায়, বাড়িতে খাওয়া বন্ধ করে দিয়েছে। বাবা খাওয়া বন্ধ করেছে, এতে দাদার কী। তার কোনও উদ্বেগ নেই। দাদার উদ্বেগ অন্য কিছুতে। বাবা আবার গোপনে কোনও বিয়ে নিয়ে যদি করে বসে তাহলে তো সম্পত্তির ভাগ চলে যাবে অন্য কোনওদিকে। বাবাকে সত্যিকার বাঘ বা সিংহের মতো চেপে ধরে দাদা একদিন শুনে নিল বাবা নাকি এদিকে ওদিকে দুএকটি বিয়েও করে রেখেছে। মা, তোমার কি কষ্ট হচ্ছে শুনতে? নাকি কষ্টের ওপারে চলে গেছ! বাবার কোনও স্থলনে তোমার হয়তো আর কষ্ট হয় না। জানতেও না। তো কত কিছু। যখন অসুখ তোমার, অসুখ যখন ধরা পড়লো, শুধু ধরা পড়া বলবো কেন, যখন ডাক্তার বলে দিয়েছে সব, কবে তুমি মরে যাবে, সব জেনেও তোমাকে তো কাঁদিয়েছে বাবা। জীবনে কেঁদেছো মা অনেক। দাদা তো বাবার ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে মাথা কখনও ঘামায়নি। কিন্তু হঠাৎ এমনই অসভ্যের মতো ঘামানো শুরু করলো যে দেখলে হয়তো তোমার ভালো লাগতো। কিন্তু ভালো কি সত্যিই লাগত! তুমি তো নিশ্চয়ই জানতে এই ঘামানোটা আসলে বাবার সম্পত্তির ভাগ বাইরের কাউকে না দেওয়ার জন্য ঘামানো।