বারডেম হাসপাতালের ডায়ালাইসিসের যন্ত্রপাতি সব আধুনিক। ডাক্তাররা যত্ন নিয়ে বাবাকে দেখছে, ওখানকার অনেক বিশেষজ্ঞই বাবার ছাত্র। দাদার কাছে এসব শুনে খানিকটা স্বস্তি হয়। কিন্তু একদিন অন্তর অন্তর শরীরের রক্ত পাল্টেনতুন রক্ত ভরতে বাবা কি আদৌ কোনও স্বস্তি পাবে, আমি বুঝে পাই না কী করবো। অকেজো কিডনির জায়গায় নতুন কিডনি বসানোর ব্যবস্থা যে করেই হোক করতে হবে। বাবাকে বলি কিডনি পাওয়া যাবে, অনেকে কিডনি দান করে, বিক্রি করে, কোনও একটা কিডনি তার জন্য পাওয়া যাবেই। একটুও যেন না ঘাবড়ে যায় বাবা। প্রতিদিনই মানুষের কিডনি ট্রান্সপ্লান্ট হচ্ছে। ট্রান্সপ্লান্টের জন্য তাকে বিদেশে নিয়ে আসবো, ইওরোপের কোনও দেশে নয়তো ভারতে। ওখানে কিডনি বিক্রি করার জন্য প্রচুর গরিব বসে আছে। কড়ি ফেললেই কেনা যায়। বাবা শুনে ভরসা পায়, কিন্তু বুঝি কী ভীষণ কষ্টকরই না এই অনিশ্চয়তার মধ্যে থাকা। টাকা পয়সার ব্যাপারে একদম না ভাবতে বলি বাবাকে। কিডনি নিয়ে দরদাম করার কোনও দরকার নেই। যত টাকা দরকার হয় কিডনি ট্রান্সপ্লান্টের জন্য, সব আমি দেব। বাবা একদিন জানালো, নান্দাইলএর এক লোক টাকার বিনিময়ে কিডনি দিতে রাজি। তাহলে কী আর ভাবনা, ওই লোককে নিয়ে বিদেশে যেতে হবে ট্রান্সপ্লান্টের জন্য। আমিও বসে নেই, বিভিন্ন দেশে হাসপাতাল আর ডাক্তারদের সঙ্গে কথা বলে কিডনির ব্যাপারে পাকাঁপাকি একটা ব্যবস্থা করতে থাকি। বাবার ডায়ালাইসিস এবং হাসপাতাল খরচের টাকা ব্যাংকের মাধ্যমে পাঠিয়ে দিই দাদার অ্যাকাউন্টে। বাবার কি টাকা নেই মা? তবে এই টাকা কেন আমাকে পাঠাতে হয়? এই প্রশ্নটি নিজে আমি করি না। কেউ চায়নি টাকা, তারপরও পাঠিয়ে দিই। পাঠিয়ে দিই এই কারণে যে বাবার টাকা পয়সার তদারকি এখন দাদা করছে। আর দাদার মতো কল্পণ লোক টাকা খরচের ভয়ে যদি চিকিৎসায় গাফিলতি করে, এই আশংকায় আমি পাঠাই। আমার টাকা নিয়ে অন্তত কৃপণতা করবে না এই একটি বিশ্বাস আমার। কিন্তু যারই টাকা হোক, যার পকেটে যখন যায়, সেটি তখন তার নিজের টাকা। আমার পাঠানো টাকা তখন দাদার হাতে, সে টাকা তখন দাদার, সুতরাং স্বভাবজাত কৃপণতা তার শুরু হয়ে গেল। দ্বিতীয়দিন যখন বাবা ডায়ালাইসিস করতে গেল বারডেমে, ডাক্তার বলেছিলো অ্যান্টিবায়োটিক দিতে হবে স্যালাইনের সঙ্গে। কিন্তু দাদা বাবাকে হাসপাতালে রাখতে রাজি নয়। রাজি নয়ের কারণ একটিই, খামোকা টাকা খরচ। বাবার গলায় ফুটো করে নল ঢুকিয়েছে ডাক্তার, কড়া অ্যান্টিবায়োটিক সরাসরি রক্তে ঢোকাতে হবে, মুখের ওষুধে কাজ হবে না। হাসপাতালে ডাক্তারদের কড়া নজরে রাখতে হবে বাবাকে। কিন্তু ডাক্তারদের কথা দাদা শুনবে কেন? বাবার নিজের কি আর মত দেওয়ার সামর্থ্য আছে, দাদা যা ভালো বোঝে তাই করবে। বাবা এখন দাদার সম্পত্তি। আমি যে ফোন করে বারবার বলছি, ডাক্তার যা বলে তাই করো, নিজে কোনও সিদ্ধান্ত নিও না। দাদা আমাকে শান্ত করতে বলে দিল, ডাক্তার নাকি বলেছে বাড়ি নিয়ে যেতে পারে, মুখের ওষুধ দিয়ে দিয়েছে। গলায় কাঁচা ফুটো নিয়ে বাড়ি যাবে, আমার কিছুতে মন সায় দেয় না। কিন্তু দূর থেকে কতটুকুই বা করতে পারি আমি! বাবার সঙ্গে কথা কী বলবো, শরীরের ওই অবস্থায় বাবা শারীরিক ভাবে যত না, মানসিক ভাবে তার চেয়ে অনেক দুর্বল। ডাক্তার যখন দেখলো রোগীকে বাড়ি নিয়ে যাবেই দাদা, বললো পারলে বাড়িতে যেন স্যালাইনে কড়া অ্যান্টিবায়োটিক ইনজেকশান দেওয়ার ব্যবস্থা করে। না তা দেওয়া যাবে না, অগত্যা দাদা মুখে খাওয়ার কড়া ওষুধ লিখিয়ে নিয়ে এলো। কিন্তু ওই ওষুধের দাম যদি একটা পাঁচ টাকা হয়, দাদা নিশ্চিতই ভাববে ওষুধ কোম্পানিগুলোর মাথা খারাপ, লোক ঠকানোর ব্যবসায় নেমেছে ওরা। কী করবে দাদা? দেশি কোনও কোম্পানির অ্যান্টিবায়োটিক কিনে আনবে যেটার পঞ্চাশ পয়সা করে দাম। তাই করলো দাদা। সাংঘাতিক বুদ্ধিমানের কাজ করলো বটে। নিজের অতিবুদ্ধির জন্য দাদা নিজে বেশ গর্বিতও। সাধারণের চেয়ে বুদ্ধি তার বেশি, তাৎক্ষণিক সিদ্ধান্ত নিতে দাদার মতো খুব বেশি কেউ আর নেই।
কী হল তারপর, বাড়িতে ভীষণ জ্বরে পড়লো বাবা। জ্বরে অনেকটাই অজ্ঞান। তখন হাসপাতালে নিয়ে গেলে ডাক্তার বলে দিল, সেপটিসেমিয়া। সারা শরীরে, সারা রক্তে তখন ব্যাকটেরিয়া ছড়িয়ে পড়েছে। বাবার মাথাও অকেজো করে দিয়েছে। সেপটিকশকে চলে গেছে বাবা। যেন মুহূর্তের মধ্যে হয়ে গেল এমন। বাবা তখন কিছু বুঝতে পারে না, কিছু বলতে পারে না, মুখ দিয়ে শুধু গাঁ গ্যাঁ শব্দ বেরোয়। ভেবেছিলাম বেঁচে থাকলে বাবাকে কোনও না কোনও একদিন বাবা বলে ডাকবো, ভেবেছিলাম বাবাকে তুমি বলে ডাকবো। ডাকি বাবাকে। বাবার কানের কাছে ফোন দেওয়া হয়। বাবা তখন তো বোবা, বধির। বাবাকে বাবা বলে ডেকেছি, বলেছি বাবা তুমি জেগে ওঠো। হ্যাঁ, যখন সত্যি ডাকলাম, বাবা আমার এই ডাক শুনতে পায়নি। বড় দেরি হয়ে গেল মা।
বড় মামা, ঝুনু খালা সব গেছে দেখতে। তারা এই বোবা বাবাকে দেখে বিমূঢ়। আমি স্তব্ধ হয়ে আছি দূর বিদেশে। আমার সারা গা কাঁপছে আশংকায়। যদি আমাকে দেশে ফিরতে দেওয়া হত, বাবার এই অবস্থা হতে পারতো না মা। তুমি ভাগ্যে বিশ্বাস করতে পারো, আমি করি না। আমি মনে করি না কোথাও কেউ মানুষের জন্ম মৃত্যুর তারিখ লিখে রেখেছে। এবং সেই তারিখ অনুযায়ী সব ঘটছে। বাবা আজও বেঁচে থাকতে পারতো, বিদেশে তার কিডনি ট্রান্সপ্লান্ট হতে পারতো, দিব্যি আগের মতো জীবন যাপন করতে পারতো। জীবন তো মানুষের একটাই। এই জীবনটাকে যে করেই হোক বাঁচিয়ে রাখতে চাই আমরা। কিন্তু তুমি যদি জীবনের মূল্য না বোঝে, তবেই তুমি টাকা পয়সার হিসেব করবে, হাসপাতালে অসুস্থ মানুষকে চিকিৎসার জন্য না রেখে তুমি বাড়ি নিয়ে আসবে, কারণ এতে সুবিধে, দৌড়োদৌড়িটা কম হয়।