বাবাকে কোনওদিন কি বোঝাতে পেরেছি ভালোবাসি? তোমার জীবনের শেষ কটা দিন তোমার পাশে থেকে না হয় মিথ্যে হোক সত্যি হোক, বুঝিয়েছি ভালোবাসি। বাবার সেবা করা আমার পক্ষে সম্ভব হয়নি মা। সুইডেনের বাংলাদেশ দূতাবাসে গিয়ে আমার পাসপোর্টের মেয়াদ বাড়ানোর জন্য আবেদন করলাম, শেখ হাসিনার কাছে চিঠিও লিখলাম যেন আমাকে কিছুদিনের জন্য অনুমতি দেন দেশে ফেরার। জানিয়েছি, বাবা ভীষণ অসুস্থ, তাকে না দেখলেই নয় আমার। তারপরও কোনও উত্তর নেই। রাষ্ট্রদূত নিজে বেশ কয়েকবার স্বরাষ্ট্রমন্ত্রণালয়ে চিঠি পাঠালেন এর গুরুত্ব বুঝিয়ে, সেসবেরও কোনও উত্তর নেই। উত্তর নেই ঠিক বলবো না, উত্তর হচ্ছে, না। অথচ দেখ, উঠতে বসতে শেখ হাসিনা কী কান্নাই না কাঁদছেন তাঁর নিজের বাবার জন্য! অথচ আমার বাবাকে দেখতে যেতে দিতে তাঁর আপত্তি। ওদিকে বাবা আমাকে যে কথা আগে কখনও বলেনি, বলছে যেন দেশে ফেরার চেষ্টা করি। বুঝি আমাকে দেখার জন্য বাবা ব্যাকুল হচ্ছে। ভয় নাপাওয়া বাবাও, বুঝি যে ভেঙেপড়েছে। আমারআর্তনাদ, আমারআকুলতা কিছুই বাংলাদেশ সরকারকে স্পর্শ করে না। বাবা তার মেয়েকে ডাক্তার বানালো, বাবার অসুস্থতার পাশে সবাই আছে, শুধু তার ডাক্তার মেয়েটি নেই। ডাক্তারির কিছুই না জানা দুই পুত্রধন বাবার পাশে আছে, যারা অনেকটা বাবার চিকিৎসকের ভূমিকা নিয়েছে। বিশেষ করে দাদা। দাদা নিজেকে প্রায়শ ডাক্তার বলে মনে করে। নিজের ডাক্তারি পড়া হয়নি, ওষুধ কোম্পানিতে চাকরি করেছে, গ্রামে গঞ্জে ওষুধ নিয়ে গেছে, গ্রামের অশিক্ষিত লোকেরা দাদাকে ডাক্তার বলে ডেকেছে। তারপর চাকরি ছেড়ে বাবার ফার্মেসিতে বসেছে, ওষুধ নিয়ে কারবার বলে বাজারের মাছওলা, তরকারিওলা ভাবতো ডাক্তারের ছেলে বুঝি ডাক্তারই হয়েছে। তারাও দাদাকে ডাক্তার ঠাওরাতো। ও কারণেও দাদারও ধারণা হয়েছে দাদা বুঝি ডাক্তারই। এখন বাবার অসুখের চিকিৎসা দাদা নিজ দায়িত্বে নিজের হাতে তুলে নিয়েছে। দাদাই সিদ্ধান্ত নেয় বাবাকে কখন হাসপাতালে যেতে হবে, বা ডাক্তার দেখাতে হবে। বাবা, কী কারণে জানিনা নিজের কোনও অসুখের জন্য বড় কোনও ডাক্তার দেখাতো না। নিজের চিকিৎসা নিজেই করতো। জানতে চিকিৎসা, কিন্তু কখনও কখনও তো অভিজ্ঞ ডাক্তারের কাছে যেতে হয়। শহরে নতুন নতুন বিলেত ফেরত ডাক্তার এসেছে। অনেকে বাবার ছাত্র। ডাক্তারি বিদ্যায় বাবার জ্ঞান এমন ছিল যে বিলেত ফেরত এফ আর সি। এস পাশ করা ডাক্তারের হাতে রোগী মরতে বসলে বাবার কাছে এসে বাঁচতো। বাবাকে অনেক বলতাম বড় ডাক্তার দেখাতে, কখনও রাজি হত না। কলকাতার ডাক্তার যে ওষুধ দিয়েছিলো সেগুলো কখন কোনটা খেতে হবে, বড় কাগজে লিখে দিয়েছিলাম, যেন ভুলে না যায় বাবা, প্রয়োজনে যেন ঘরের দেয়ালে টাঙিয়ে রাখে। দেশে ফিরে বাবা ওই কাগজও ফেলে দিয়েছে, ডাক্তারের দেওয়া ওষুধও খায়নি। নিজের যা পছন্দ তাই খেয়েছে। খেয়ে তো দিব্যি ভালো ছিল মা। হৃদপিণ্ডের কোনও অসুখে তাকে ভুগতে হয়নি। রক্তচাপ নিজের মতো করে ওষুধ খেয়ে কমিয়ে রেখেছে। গোলটা বাধলো ডায়বেটিস নিয়ে। ওটাও ঠিক থাকতো যদি খাবারটা বাবার ঠিক থাকতো। বাড়িতে সবার জন্য যে খাবার রান্না হয়েছে সেগুলোই তো বাবাকে খেতে হয়েছে। কোনওদিন মদ সিগারেট খায়নি। শাক সবজি খেতো। স্বাস্থ্যকর বা পুষ্টিকর খাবার বাড়িতে আনতো। যখন দাদা বা সিনা দায়িত্ব নিয়ে নিল বাড়ির সব ব্যাপারের, সংসার খরচের টাকা পয়সাও তখন তাদের হাতে, তারাই সিদ্ধান্ত নেয় কী তারা খাবে। বাজার থেকে মাছমাংস অঢেল আসে। দই মিষ্টি আসে। বাবার খাবারের জন্য কিছু আসার চল ছিল না। ক্ষিধে পেলে বাবা হয়তো’সামনে যা পেতো খেয়ে নিতো। কলকাতায় যখন এসেছিলো, বাবাকে শর্করামুক্ত খাবার খাওয়ানোর দিকে খেয়াল করিনি। বাবার ডায়বেটিস ধরা পড়ার পর, তুমি যতদিন অবকাশে ছিলে, শাক সবজিই বেশি খাওয়াতে। তুমি বাবার খাবারটা ঠিকঠাক দিতে, তুমি না থাকলে দেওয়ার কেউ নেই। বাবার সবকিছু ওলোট পালোট হয়ে গেলো। চেম্বার নেই। রোগী দেখা নেই। বাড়িতে যখন বসেছিলো, বাড়িতে দুটো তিনটে রোগী আসতো। কিন্তু বাড়ি তো আর চেম্বার নয়, এতকালের চেম্বারের স্বাধীনতা বাবা বাড়িতে পেতো না, সেই আনন্দও আর ছিল না। কারও ওপর নির্ভরশীল বাবা কোনওকালেই ছিল না। নিজের অসুখ নিয়ে অন্যের মাথাব্যথাও কোনওদিন সইতে পারতো না।
একসময় শুনি বাবাকে ঢাকায় নিয়ে আসা হয়েছে। কী করে এলো বাবা? না, যে গাড়ি বাবার জন্য কেনা হয়েছিল, সেটায় নয়, বাসে করে। আমার দেওয়া সেই গাড়ি হাসিনার এদিক ওদিক ঘোরার কাজে লাগবে, অসুস্থ বাবার জন্য গাড়ি ব্যবহার করলে চলবে কেন! বাবাকে ঢাকার হাসপাতালে নিয়ে গেল দাদারা। আমি সারাক্ষণ ফোনে খবর নিচ্ছি বাবাকে সান্ত্বনা দিচ্ছি। এত কালের প্রতাপশালী মানুষের বিষঃ কণ্ঠস্বর। বাবার মতো মানুষকে ভীত হওয়া মানায় না। বাবাকে জানাতে খুব কষ্ট হয়, যে, আমাকে দেশে যেতে দিচ্ছে না সরকার। বাবা যে কী অসহায় বোধ করছে, সে আমি বুঝি। বাবা তো আমার জন্ম থেকে চেনা। তারশক্তি যেমন জানি, তার দুর্বলতাও জানি। চিরকাল শক্তিমান হিসেবেই বাবা থেকেছে সবার কাছে। ভেতরে কোনও কারণে দুর্বল হলেও প্রকাশ করেনি কোনওদিন। কিন্তু ভালোবাসলে টেরপাওয়া যায়। যায় না মা? শক্তিমানেরও হৃদয় থাকে, সেই হৃদয় একসময় ভাঙে। বাবা যে কত অভিমানী ছিল, তা আমি আগে না বুঝলেও এখন বুঝি। বাবা অনেকটা শিশুর মতোও ছিলো। নিউইয়র্কের হাসপাতালে যখন চেকআপের জন্য ধরে বেঁধে ভর্তি করিয়েছিলাম, মনে আছে একবার ডাক্তার এসে জিজ্ঞেস করেছিলেন, আপনার জন্ম তারিখটা বলুন তো! বাবা বললো, কোনটা বলবো? পাসপোর্টেরটা, সার্টিফিকেটেরটা, নাকি অরিজিনালটা। আমি হাসবো না কাঁদবো, বুঝিনি। বাবার কথা শুনে ডাক্তাররা মুখ টিপে হেসে বলেছিলেন, অরিজিনালটা বলুন।