তোমার অবর্তমানে শুনেছিলাম কোন এক বিধবা ভদ্রমহিলার সঙ্গে নাকি বাবার বিয়ে জাতীয় কিছুকরিয়ে নেওয়া হয়েছিল, বৈধভাবে তারা মেলামেশা করতে পারবে এরকম কিছু। অবকাশে দাদারাই এটি ঘটার ব্যবস্থা করেছিলো। ভদ্রমহিলা নাকি অবকাশে প্রায়ই যেত, বাবাও যেতে তার বাড়িতে। যার সঙ্গে বাবা ঢাকায় বসে ফোনে কথা বলেছিলো, শুনে তুমি কেঁদেছিলে, তার সঙ্গেই এই ঘটনা। মেলামেশা করার আর কোনও রকম আইন আছে কিনা বিয়ে ছাড়া, আমার জানা নেই। তবে মুসলমানের আইন তো, পুরুষের বহুগামিতার সুযোগ সুবিধে বিস্তর। আমি তো দূরের মানুষ, দেশে আর কোনও দিন ফিরতে না পারা মানুষ। আমাকে খুব বেশি কিছু। জানানোও হয় না। নিজে ফোন করে বার বার জিজ্ঞেস করে করে যদি কিছু জানি তো জানি।
বাবা যা কিছুই করুক, তোমার অসুস্থতার সময় বাবার ওপর আমার যত রাগছিল, তুমি না থাকার পর কী করে যেন সব জল হয়ে গেল। তাকেই আঁকড়ে ধরে তোমার শূন্যতাকে আড়াল করতে চাইতাম মনে মনে। আমার সব মনে মনেই ছিল মা। তোমার সঙ্গে তোমার জীবনের বেশির ভাগ সময়ই বাবা অন্যায় ছাড়া আর কোনও আচরণ করেনি জানি মা। কিন্তু তারপরও বাবাকে আমি শ্রদ্ধা না করে পারি না। তুমিও তো চাওনি বাবার সঙ্গে কোনও অশোভন আচরণ করি। চিরকাল ভয়ে সিঁটিয়ে থেকেছি। বাবা আমাদের পেটাতো, ভয় দেখাতো। কিন্তু ভালোও তো বাসতো। তার ভালোবাসা কখনও অন্য বাবাদের ভালোবাসার মতো ছিল না। বাবারশাসনে জানি না ছেলেমেয়েরা কতটুকু মানুষ হয়েছে। দাদা তো চিরকালই বাবার ওপর নির্ভর করেই জীবন কাটালো। ছোটদাও অনেকটা। বাবার স্বপ্নপূরণ এক আমিই করেছিলাম। হুট করে ঢাকা মেডিকেল কলেজের চাকরি ছেড়ে দেওয়ায় বাবা মাথায় হাত দিয়ে বসেছিলো। কিন্তু আমার সিদ্ধান্ত আমার সিদ্ধান্ত। আমি সম্ভবত বাবার মতো হয়েছিলাম। আমার মনোবলটা বাবার কাছ থেকে পাওয়া। ঝড় ঝঞ্জার সামনে ঋজু দাঁড়িয়ে থাকা বাবা। ভয় না পাওয়া, রুখে ওঠা, প্রতিবাদ করা বাবা। স্বনির্ভর হওয়া, মাথা উঁচু করে বাঁচা, বাবা। অহংকার, আত্মবিশ্বাস, বাবা। আর তুমি হচ্ছ আমার ভেতরে যে অবিশ্বাস্যরকম যে এক নরম হৃদয় আছে, মানুষের জন্য কাঁদা, কেঁদে বুক ভাসানো, সেটা বিলিয়ে দেওয়া, ভালোবেসে অকাতরে দান করা, তুমি। মাঝে মাঝে তীব্র হতাশায় যখন ডুবে থাকি, মনে হতে থাকে পৃথিবীতে কেউ বুঝি আমাকে ভালোবাসে না, আমি একা, একটি বিন্দুর মতো আমি একা, মনে হতে থাকে কী দরকার এই বেঁচে থাকার–সেটা তুমি। ছেলেমেয়েদের আর কারও মধ্যে এত তীব্র ভাবে তোমাদের দুজনের উপস্থিত নেই। ইয়াসমিন একটা সময় দুর্বিনীত দুরন্ত মেয়ে ছিল। কিন্তু ধীরে ধীরে বয়স বাড়ার পর বাবার সব গুণ চলে গিয়ে তুমি এসে উপস্থিত হয়েছে ওর মধ্যে। ঠিক তোমার মতোই অশান্তির সংসার ও করে যাচ্ছে। প্রায়ই স্বামীকে ত্যাগ করার কথা বলে, কিন্তু সন্তানের জন্য পারে না। আত্মবিশ্বাসের এক ফোঁটা কিছু নেই। নিজেকে কুৎসিত বলে মনে করছে, যদিও কুৎসিত নয়। তোমার আত্মবিশ্বাস ছিল, কিন্তু তোমার উপায় ছিল না। ইয়াসমিনের উপায় থাকলেও মনের জোর নেই। আসলে তোমার গুণগুলো ওর মধ্যে গিয়ে দোষে পরিণত হয়েছে। গুণএর মাত্রা অতিরিক্ত হলে সেটা আর গুণ থাকে না। ধরো মানুষের জন্য জীবন দেওয়ার গুণ যদি আমার ভেতরে আরও বেশি মাত্রায় থাকে, আমাকে হয়তো আত্মহত্যা করতে হবে। আর, বাবার গুণই ধরো, শক্তি সাহস, সংকল্প, দৃঢ়তা ঋজুতা ইত্যাদি অতিরিক্ত হলে জানি না কী করবো, হয়তো মৌলবাদীর সশস্ত্র মিছিলের সামনে বুক চিতিয়ে দাঁড়িয়ে বলবো, সাবধান এক পা এগোবি না। দাদা আর ছোটদার মধ্যে আমি তোমাকে দেখি না। বাবার মেয়েমানুষের দোষ দ্বিগুণ বা ত্রিগুণ হয়ে ছোটদাকে ধরেছে। একসঙ্গে বেশ কটি সুন্দরীর সঙ্গে গোপন সম্পর্ক রাখতে সে পারদর্শী। বাবার সেদিক থেকে কপাল ভালো ছিল না। বিবাহিতা, অসুখী, অসুন্দরী, নিগুণ, এমনই দুএকটি ছিল হয়তো কপালে, কেউই কিন্তু তোমার চেয়ে দেখতে ভালো, তোমার চেয়ে বুদ্ধিমতী বা কম বয়সি ছিলো না, অন্তত যে দুজনের কথা শুনেছি। দাদার মাথা থেকে পা পর্যন্ত বাবার একটি গুণই দোষের মতো দেখা দেয়। বাবার মিতব্যয়িতা দাদার ভেতরে প্রবল পরিমাণে ঢুকে কৃপণতার আকার ধারণ করেছে। বাকিগুণ বা দোষ অত প্রকাশিত নয়। কৃপণতা অবশ্য তার বউ ছেলেদের ক্ষেত্রে তত নেই, যতটা বাকি পৃথিবীর জন্য।
মা, মাঝে মাঝে মনে হয় বহুগামিতা মানুষ নামক প্রজাতির স্বাভাবিক প্রবৃত্তি। আমরা সমাজের বিধি নিষেধ নিজেদের ভেতর ধারণ করে আমাদের স্বভাবজাত বহুগামিতাকে শরীরের না হলেও মনের শক্তি দিয়ে রোধ করি। ভালোবাসা নামক একটি দেয়াল এসে আমাদের সামনে অনড় দাঁড়ায়। সেই দেয়াল ডিঙিয়ে আমরা তথাকথিত পরনারী বাপরপুরুষের কাছে যেতে পারি না। বাবা যদি বহুগামিনা হতো, তোমরা দুজনেই খুব সুখী হতে পারতে। হঠাৎহঠাৎ যখন বাবার সঙ্গে তোমার ঘনিষ্ঠতা হতো, দুজনকেই কী প্রফুল্ল দেখতাম। ওরকম যদি সবসময় থাকতে পারতে। জানি তোমার উদ্যোগে কোনও কাজ হত না। বাবা যদি এগিয়ে আসতো, তবেই সম্ভব হত সম্পর্ক মধুর করা। তুমি তো একপায়ে সারাজীবন খাড়াই ছিলে বাবার সামান্য ভালোবাসা পেতে। তোমার অসুখ ধরা পড়ার পর বাবা যে বাধ্য স্বামীর মতো তোমাকে আদরযত্ন করতে শুরু করলো, নিজের বাড়িঘর, রোগী দেখা, বান্ধবী, সব ফেলে সব ভুলে–জানি না ওর পেছনে কী কাজ করেছিলো? অপরাধবোধ! মনে হয়। দুজনই তোমার অসুস্থতার সময় সবচেয়ে বেশি নিঃস্বার্থভাবে সেবা করেছে, সে বাবা আর আমি। বাবার আর আমার আরও গুরুত্বপূর্ণ মিল বোধহয় এটাও।