বাবা কেমন আছে, কী করছে খোঁজ নিতে প্রায়ই ফোন করি। বাবা বলে বটে যে ভালো আছে, কিন্তু বাবার কণ্ঠস্বরে আমি টের পাই বাবা ভালো নেই। বাবা কোনওদিনই তার অসুখের কথা কাউকে জানায় না। একদিন দাদা খুব সহজ শান্ত গলায় বললো বাবার কিডনি নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। শুনে আমার বুকের ভেতর থেকে ঠাণ্ডা একটা, জানি না কী নাম তার, মুহূর্তে সারা শরীরে ছড়িয়ে গেল। কিডনি কবে থেকে নষ্ট হচ্ছে? দাদার বক্তব্য আমার নাকি জানার কথা সব। সেই যে বাবা কলকাতায় এসেছিলো, তখনই নাকি কলকাতার ডাক্তাররা বলেছিলো কিডনি নষ্ট হচ্ছে। এসবের কিছুই জানি না আমি। কোনও ডাক্তার আমাকে বাবার কিডনি নষ্ট হওয়ার কথা কিছু বলেনি। ঘরে বাইরে সারাদিন অস্থির পায়চারি করলাম। ভেতরে বুদবুদের মতো দেশে ফেরার ব্যাকুলতা। বাবার এই দুঃসময়ে যদি পাশে না থাকতে পারি, তবে বেঁচে থাকার কী অর্থ! আশংকায় আমি কুঁকড়ে থাকি। অন্ধকারে নিজেকে মুড়ে একাপড়ে থাকি ঘরের কোনও কোণে। ফোন বাজলে বুকের ধুকপুক এমন বাড়ে যে মনে হয় দৌড়ে পালাই। একদিন অভিমানের গায়ে পাথর চাপা দিয়ে ইয়াসমিনকেই কাতর অনুনয় করি, যত তাড়াতাড়ি সম্ভব যেন সে দেশে যায়। ইয়াসমিনেরও নিজের সমস্যার অন্ত নেই। বলতেও পারতো সে যাবে না, কিন্তু তোমার মৃত্যু তার স্নায়ুর ঘরবাড়িতে ভূকম্পন তুলে জানিয়ে গেছে মৃত্যু জিনিসটা ঠিক কী। কারও মৃত্যু না হলে আমরা বোধহয় দেখতে পাই না মৃত্যুর সত্যিকার চেহারা। ইয়াসমিন তড়িঘড়ি বাবার জন্য খাবার দাবার কাপড় চোপড় আর নানারকম উপহার কিনে রওনা হলো দেশে।
দাদার অভিযোগ শুরু হয়েছে বাবার নাকি হরেকরকম বান্ধবী আছে। বান্ধবীরা বাবার সঙ্গে দেখা করতে বাড়িতে ঢুকতে চায়। ওদের অর্ধচন্দ্র দিয়ে বাড়ি থেকে প্রতিদিনই বিদেয় করে দাদা। বিদেয় করার ঘটনা দাদা বেশ বীরত্বের সঙ্গে বর্ণনা করে। তার বীরত্ব আমাকে মোটেও পুলকিত করে না। দাদাকে বলি যা ইচ্ছে হয় বাবার, তাই যেন তাকে করতে দেওয়া হয়। বান্ধবীদের সঙ্গে বাড়িতে বসে বাবা কথা বলতে চাইলে বলবে। শুতে চাইলে শোবে। বাবার চরিত্র সংশোধনের গুরুদায়িত্ব দাদাকে নিতে বারবার বারণ করি। জীবন একটিই, এই জীবনটি যেমন ইচ্ছে যাপন করার অধিকার আরসবারমতো বাবারও আছে। সারা জীবন স্বাধীনতা ভোগ করে আসা মানুষকে অসুখের দোহাই দিয়ে টেনে হিঁচড়ে একটি বন্ধ ঘরে ঢুকিয়ে বন্দি করা হলে কেমন অস্থির হয় তার ভেতর বাহির, তা বাবা না হয়েও আমি অনুভব করি। বাবার মন ভেঙে যাচ্ছে, শরীর ভেঙে যাওয়ার চেয়েও তা অনেক বেশি ক্ষতিকর। শরীর যখন যাবার, যাবে। মনকে মরতে দিতে নেই। তুমি নেই মা, এখন আর বাবাকে তার বান্ধবীদের কাছ থেকে জোর করে দূরে সরিয়ে কার কী ভালো দাদা করছে! তুমি থাকাকালীন যে কাজটা কেউ কোনওদিন করেনি, তুমি না-থাকাকালীন কেন? বাবাকে এরকমও আর আশ্বাস দেওয়া হচ্ছেনা যে সে তার হারিয়ে যাওয়া জগৎটি ফিরে পাবে একদিন। অবকাশের অন্দরে বন্দি করে বাবার মতো কাজপাগল মানুষকে বুঝিয়ে দেওয়া হয়েছে, মৃত্যুর জন্য অপেক্ষা করা ছাড়া বাবার আর কাজ কিছু নেই। কী ভয়ংকর নিষ্ঠুর এই আচরণ। বাবার চেম্বারে চিরতরে তালা লাগিয়ে দেওয়ার পরিকল্পনা দাদার একার। ধীরে ধীরে বাবাকে নিজের মুঠোয় নিয়ে দাদা কী খেলা খেলছিলো কে জানে! কারও কথায় বাবা উঠছে বসছে, দৃশ্যটি বড় অচেনা ঠেকে। কী করে জানিনা দাদার হাতের ক্রীড়নক হয়ে পড়েছিল বাবার মতো ভয়ংকর একগুঁয়ে মানুষ! সম্ভবত কিডনি নষ্ট হওয়ার খবর বাবাকে বদলে দিয়েছিলো আগাগোড়া। মনে আছে, অবকাশের একটি ঘরে মৃত্যুর সঙ্গে রোজ যুদ্ধ করে চলেছো, বাবা বাড়ির বাইরে যেতে চাইলে আমি কালো ফটকে তালা দিয়ে রাখতাম, চাইতাম বাবা বাড়ি থাকুক। দিন দিন তুমি যুদ্ধে হেরে যাচ্ছো, মৃত্যু তোমার শরীর জুড়ে উলঙ্গ নৃত্য করছে, আমি চাইনি বাবা এ সময় বাড়ি ছেড়ে অন্য কোথাও যাক। কিন্তু বাবার ওপর জোর চালিয়ে শেষ পর্যন্ত আমি জিততে পারিনি। যে করেই হোক বেরিয়ে গেছে বাবা। কেঁদে কেটে, অনশন করে, অভিমান করে, রাগ করে, চিৎকার করে হলেও বেরিয়েছে। তুমি মরে যাচ্ছে, তাতে কী, বাবা তো বেঁচে আছে, বেঁচে থাকতে হলে সবার আগে তাকে তার জগতে ফিরতে হবে। সেই জগৎ আমাদের সবার জগৎ থেকে আলাদা। সেখানে রোগী আছে, রোগিণী আছে। রোগ শোক চিকিৎসা বন্ধু বান্ধব আড্ডা গল্পগুজব চানাচুর বাদাম ইত্যাদি আছে। বহুঁকাল ধরে গড়ে তোলা বাবার নিজস্ব এই জগৎ। কোনও কিছুই তাকে সেই জগৎ থেকে সরাতে পারে না। তোমার মৃত্যুও নয়। সেই জগৎটি বাবার কাছ থেকে হঠাৎ কেড়ে নেওয়া হল। অনেককাল আগে বাবা আমাকে বলেছিলো তার মৃত্যু যেন হয় ওই চেম্বারের ওই চেয়ারে বসে, রোগীর প্রেসক্রিপশান লিখতে লিখতে, হঠাৎ। যে বাবা কোনওদিন একটি মুহূর্তের জন্য অবসরে বিশ্বাস করতো না, তার কেন ভালো লাগবে ভয়াবহ অবসর! বাবা যতটা অসুস্থ ছিল, তার চেয়ে বেশি অসুস্থ হতে লাগলো। অস্থিরতা চরমে উঠে সর্বনাশ করতে লাগলো তার। জীবনে প্রথম তাকে ভোগ করতে হচ্ছে বন্দিত্ব, প্রথম তাকে বুঝতে হচ্ছে যে তার ইচ্ছের কোনও মূল্য নেই আর। পুরুষদের সঙ্গে দেখা করার অধিকার বাবার আছে, মহিলাদের সঙ্গে নেই। এই নেইটা দাদার আদেশ। প্রথম প্রথম উপদেশ দিতো হয়তো, সেই উপদেশ ধীরে ধীরে আদেশে পরিণত হয়েছে। বাবার শারীরিক বা মানসিক অবস্থার কথা ভাবার কারও সময় নেই তখন! দাদা আর ছোটদা অলক্ষ্যে হয়তো বাবাকে মৃত্যুর জন্য তৈরি করেছিলো। ইচ্ছে করে ছুটে যাই, বাবাকে বাবার মতো করে তার শেষ কটা দিন বাঁচতে দিই। কিন্তু বন্দি তো বাবার চেয়েও বেশি আমি। বাবার মন প্রফুল্ল থাকে, আনন্দময় থাকে, এমন পরিবেশই বাবাকে দেওয়া হোক, এক এক করে ভাইদের, আত্মীয়দের সবাইকেই বলি। কিন্তু দূরের মানুষের দীর্ঘশ্বাস বা উপদেশ কিছুই কেউ গ্রাহ্য করে না। খুব ভালো করে বুঝি যে বাবা আর আগের বাবা নেই। কণ্ঠে অবসাদ। আশার আঙিনাগুলো আশংকায় আচ্ছাদিত। দাদা আগে বাবার কানে কানে কথা বলতো, মামা খালাদের বিরুদ্ধে যা নয় তা বলে কান ভারি করতে বাবার। কানাকানি দাদা এখন বাবার সঙ্গে করে না, যদি করে, করে ছোটদার সঙ্গে। কী করে বাবাকে শেকলে বাঁধা যায় এ নিয়ে জল্পনা। বাবা নাকি কথা শোনে না, বাইরে বেরিয়ে যায়। বাবাকে হয়তো শেকল দিয়ে বাঁধারই বন্দোবস্ত হচ্ছিল। বেঁধেছিল কি না জানি না, তবে ঘরে ঢুকিয়ে বাইরে থেকে যে শেকল দিয়েছিল তা জানি। কেন, খুব নাকিপাগলামি করে বাড়ি থেকে বাইরে বেরোনোর জন্য? যদি বাইরে বেরিয়ে আবার ওই মহিলাদের বাড়ি চলে যায়! দুএকজন মহিলা নিয়ে দাদার তখন মাথা খারাপ হবার যোগাড়। কেন, মহিলারা বাবার বান্ধবী। এ বাবার ব্যক্তিগত ব্যাপার। তুমি যখন হা হুতাশ করে মরতে, বাবার বান্ধবী বা স্ত্রী নিয়ে তুমি যখন বছরের পর বছর কেঁদে বুক ভাসাচ্ছো, কই দাদা তো মোটেও বাবার বান্ধবী-নেশা ঘোচানোর কোনও চেষ্টা করেনি। এখন হঠাৎ কেন? কারণ তুমি কি অনুমান করতে পারছে না মা? দাদার একটিই কেবল দুশ্চিন্তা। ওই মহিলাদের কাউকে আবার বিয়ে টিয়ে করে বসেনি তো কখনও। তাহলে তো বাবার বিরাট সম্পত্তির কোনও অংশ ওদের কারও হাতে চলে যাবে।