এগুলোর পর আর কি কোনও কবিতা তোমাকে নিয়ে লিখেছি! নতুন কবিতার বইয়ে মাত্র একটি কবিতা। সম্ভবত ধীরে ধীরে তোমাকে ভুলে যাচ্ছি মা। হয়তো তোমাকে এখন আগের চেয়ে কম মনে পড়ে। আগের চেয়ে চোখের জলও ফেলি কম। আগে যেমন প্রতিরাতে স্বপ্ন দেখতাম তোমাকে, একটি স্বপ্নই দেখতাম, স্বপ্নটি অনেকদিন আর দেখি না। নতুন বইয়ের কবিতাটাও লিখে দিলাম, পড়ো।
আশ্চর্য একটা গাছ দেখি পথে যেতে যেতে, যে গাছে সারা বছর শিউলি ফোটে।
গাছটার দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে চোখে জল উপচে ওঠে,
শিউলি পড়ে শীত গ্রীষ্ম বর্ষা সাদা হয়ে থাকে মাঠ।
তার কথা মনে পড়ে, শিউলির মালা গেঁথে গেঁথে
শীতের সকালগুলোয় দিত,
দুহাতে শিউলি এনে পড়ার টেবিলে রেখে চলে যেত।
শীত ফুরিয়ে গেলে দীর্ঘ দীর্ঘ শ্বাস ফেলতে, তাকে মনে পড়ে।
একবার যদি দুনিয়াটা এরকম হতে পারতো যে নেই সে আসলে আছে,
একবার যদি তাকে আমি কোথাও পেতাম, কোনওখানে,
তার সেই হাত, যে হাতে শিউলির ঘ্রাণ এখনও লেগে আছে,
এখনও হলুদ জাফরান রং আঙুলের ফাঁকে, ছুঁয়ে থাকতাম,
মুখ গুঁজে রাখতাম সেই হাতে।
সেই হাত ধরে তাকে নিয়ে যেতাম নতুন গাছটার কাছে,
মালা গেঁথে গেঁথে তাকে পরাতাম, যত ফুল আছে তুলে
বৃষ্টির মতো ছড়াতাম তার গায়ে।
দুনিয়াটা যদি এরকম হয় আসলে সে আছে,
শিউলির ঋতু এলে কোনও একটা গাছের কাছে সে যাবে,
মালা গেঁথে মনে মনে কাউকে পরাবে, দুহাতে শিউলি নিয়ে
কারও পড়ার টেবিলে চুপচাপ রেখে দেবে,
তাহলে পথে যেতে যেতে যে গাছটা দেখি, সেটায়
হেলান দিয়ে আমি দাঁড়িয়ে থাকবো, যতদিন ফুল ফোটে ততদিন।
তুমি শিউলি ভালোবাসতে খুব মা। শিউলি ফুল দেখলেই তাই তোমাকে মনে পড়ে। বুক ফেটে যায়। এই বোবা কষ্টের কোনও নাম নেই মা। আমি এই কষ্টের হাত থেকে নিজেকে বাঁচাতে পারি না। আমি আত্মায় বিশ্বাস করি না, তুমি তো জানো। আমি পরকালে বিশ্বাস করি না। যে হাশরের ময়দানের কথা ভেবে তুমি শিউরে উঠতে, সেই হাশরের ময়দানেও আমার বিশ্বাস নেই। কিন্তু প্রাণপণে আমি এখন বিশ্বাস করতে চাই ওসবে। আমার মতো সুখী আর কেউ হবে না যদি আমি দেখি যে আসলে আল্লাহ বলে কেউ কোথাও আছেন, আমার মতো সুখী আর কেউ হবে না যদি দেখি আখেরাত বলে, পুলসেরাত বলে কিছু আছে। যদিও জানি ওসবের অস্তিত্ব নেই, যদিও আমি ভীষণ ভাবে বিবর্তনে, বিজ্ঞানে বিশ্বাসী, তারপরও আমি চাই বিজ্ঞান মিথ্যে হোক, ধর্ম সত্যি হোক। আমি আমার সমস্ত জীবন দিয়ে চাই, আমার সমস্ত লেখা আমার সমস্ত বিশ্বাস, আমার দর্শন ধসে যাক ভূমিকম্পে যেমন ধসে যায় ইমারত। আমি চাই, তুমি সুখী হও, তুমি বেহেস্তবাসী হও, আমি চাই তুমি সুখভোগ করো। এই কামনাই এখন আমার জীবনের সবচেয়ে বড় সত্য। আমি চাই আমি মিথ্যে হই, আমি ভুল হই, তুমি সত্য হও, তোমার এতদিনকার ইবাদত সত্য হোক, তোমার স্বস্তি হোক। আমি চাই অনন্তকাল তুমি আনন্দ করো।
.
মা
অনেকে আমার মা হতে চেয়েছে, অনেকে বাবা
অনেকে মামা কাকা খালা ফুপু
অনেকে সেসব বন্ধু, যাদের হারিয়েছি।
চেষ্টা চরিত্তির করে অনেকে বাবা হয়েছে অনেকটাই
কষ্টেসৃষ্টে মামা কাকা খালা ফুপু।
অনেকে বন্ধু হয়েছে নিমেষেই, কায়ক্লেশে নয়।
মা হতে অনেকে চেষ্টা করেছিল, মা হতে সেই অনেকের পর
আরও অনেকে চেষ্টা করেছিল
সেই আরও অনেকেরপর আরও অনেকে। দিনের পর দিন অকথ্য পরিশ্রম
করেছিল মা হতে তবু কেউ মা হতে পারেনি
ছিটেফোঁটা মা কেউ হতে পারেনি
এক ফোঁটা মা কেউ হতে পারেনি।
এক বিন্দু মা হতে পারেনি।
১১. শেফালিকে অবকাশে রেখে
মা, শেফালিকে অবকাশে রেখে চলে গেছে, আমিও ওকে রেখে এসেছি অবকাশে। শেফালির সৎমার সংসারে আপন বলতে একটি মাত্র ভাই, সে ভাইও জানি না কী অপরাধ করে এখন জেলখানায়। শেফালি তার বেতনের টাকা জমিয়ে ভাইকে দিয়ে আসতো দুতিন মাস পর পর। একদিন ভাইটি বেরোবে জেল থেকে, বিয়েথা করে সংসার শুরু করবে, শেফালির এই একটিই স্বপ্ন। তার আর কোনও স্বপ্নের কথা আমি জানি না। বয়স আঠারো বা উনিশ, ছিলো বোধহয় কোনও স্বপ্ন, তুমি সম্ভবত জানো। এক শেফালি ছাড়া আর কেউ তোমার ওপর নির্ভর ছিলো না, তুমি ওকে একা রেখে চলে যাওয়ার পর বাবার দেখাশোনা করার দায়িত্ব শেফালি নিজেই নিলো। সে কাজটা বাড়তি কাজ, বাড়ির সবার জন্য সারাদিনের খাটাখাটনির পর বাবার ঘরটা গুছিয়ে রাখবে, বাবাকে খাবার দেবে। শেফালিকে প্রায়ই ফোন করে খুব আদর করে বলি, যেন বাবাকে দেখে রাখে, বাবার যেন কিছুতে খুব মন খারাপ না হয়। সেই হাসিখুশি শেফালি, ছুটে ছুটে বাড়ির সব কাজ একাই সেরে ফেলা শেফালি, হঠাৎ শুনি, মারা গেছে। সকালে কাপড় কাঁচতে গিয়ে কলের পাইপে হাত দিতেই ইলেকট্রিক শক লেগে ঠায় দাঁড়িয়ে রইলো। চিৎকার করেছিলো, সে চিৎকারে বাড়ির লোক দৌড়ে গিয়েছে বটে কাছে, কিন্তু ওকে বাঁচাবার চেষ্টা করতে কেউ সাহস পায়নি। মা, যে মেয়েটা তোমার কাছে কাছে থাকতো অনেক বছর, তুমি মারা গেলে সবচেয়ে বেশি কেঁদেছে যে মেয়ে, যে মেয়ে বাড়ির সবার আরামের জন্য দিন রাত পরিশ্রম করেছে, তাকে ইচ্ছে করলেই বাঁচানো যেত, কিন্তু সবাই দূর থেকে দাঁড়িয়ে দেখেছে ওর মরে যাওয়া। শেফালির ভাই মোটা অংকের একটা টাকা দাবি করেছিলো, নাহলে মামলা করবে বলেছিলো। দাদা নানা রকম আয়োজন করেছে টাকা না দিয়ে মীমাংসা করার। অথবা যদি দিতেই হয় টাকা, দাদার মাথায় শুধু যত কম দিয়ে পার পাওয়া যায় সেই ভাবনা। আমি টাকার পরিমাণ দাদাকে বারবার বলি বাড়াতে। কিন্তু আমার বলায় কী যায় আসে বলো! ওদের সবার কাছে আমি তোমার মতোই মৃত। আমার কণ্ঠস্বরকে ওরা কণ্ঠস্বর বলে মনে করে না। কণ্ঠস্বরের ওপারে যে জলজ্যান্ত একটা মানুষ আমি, তা তাদের আচরণে কোনওদিন প্রকাশ পায়নি। টাকা জিনিসটা চারদিকের সবার কাছে অত্যন্ত প্রিয়। শেফালির চলে যাওয়া সবচেয়ে বেশি ভুগিয়েছে বাবাকে। তুমি নেই, আমি নেই, ইয়াসমিন নেই, শেফালি নেই। বাবাকে নিঃস্বার্থভাবে ভালোবাসার আর কেউ তখন সংসারে নেই। দাদা আর হাসিনার ইচ্ছের মুঠোয় বাবাকে বন্দি হতে হল।