তোমাকে দেখতে দেওয়া হয়নি। সব নাকি গুছিয়ে রাখা হয়েছে, কেউ যেন স্পর্শ না করে তার ব্যবস্থা হয়েছে। তুমি দেখনি! পড়োনি। বোঝোনি। আমাকে নিয়ে বিশ্ব তোলপাড়, এ নিয়ে বাবা আর দাদার প্রচণ্ড আগ্রহ, তোমার নেই। তুমি চাও ঘরের মেয়েকে ঘরে ফেরাতে, তুমি চাও সে নিজের দেশে, নিজের বাড়িতে ফিরুক, আত্মীয় স্বজনের মধ্যে থাকুক, নিজের ভাষায় কথা বলুক, ভাত মাছ খাক, তুমি চাও আগের মতো। কিন্তু কিছু যে আগের মতো নেই তা বুঝতে চাও না। তোমার একটাই অনুরোধ, আমি যেন ঘোষণা করে দিই, ইসলামের বিরুদ্ধে আমি কিছু আর লিখবো না, সুতরাং আমাকে যেন দেশে ফিরতে দেওয়া হয়। তোমাকে যত বলি, যে, এটা আমি লিখবো না, তাহলে আমি আর আমি থাকি না। তুমি বোঝো না। তুমি এমনকী বলো, যেন ক্ষমা চাই। আমি বলে দিই কোনও দোষ তো আমি করিনি। তোমার তারপরও ইচ্ছে, আমাকে না নিয়ে দেশে তুমি একা একা ফিরবে না।
ছোটদাদের নোভোটেল হোটেলে ছোটদাই শুধু খেতে পারবে নাস্তা। তাতে কী! আমার কি টাকা ছিল না তোমার আর আমার জন্য নাস্তা কিনে আনা? না একে ফাঁকি দেওয়ার একটা ব্যবস্থা ছোটদা বার করলো। আমাকে নিয়ে নাস্তা খেতে গেল হোটলের ব্রেকফাস্ট রুমে, আর তোমার জন্য পকেটে করে দু চাক রুটি আর একটা সেদ্ধ ডিম নিয়ে এল। তুমি হলে বাড়তি, বুঝলে মা, তোমাকেও আমরা বুঝিয়ে দিচ্ছিলাম তুমি হলে বাড়তি একটা মানুষ যার নাস্তার টেবিলে বসে আর সবার মতো কোলের ওপর ন্যাপকিন রেখে চামচে করে ওটমিল, বা ব্রেডের ওপর বাটার আর চিজ বা জ্যাম লাগিয়ে খাওয়ার উপায় নেই। কেউ লুকিয়ে কিছু খাবার দিলে তোমার পক্ষে খাওয়া সম্ভব হতো না। তুমি অপরাধবোধে ভুগতে। তুমিও ভয়ে লুকিয়ে রাখতে ওই দু চাকু রুটি বা ডিম বা কলা। অবৈধ জিনিস তুমি কোনওদিন খাওনি। এখনই বা খাবে কেন? কিন্তু উপায় না দেখে ক্ষিধেয় তুমি কামড় দিয়েছো ওসবে। স্বস্তি ছিল কি ওই কামড়ে? ছিল না মা। বিদেশে ওই ছিল তোমার নাস্তা। আর আমি? তোমাকে ঝকঝকে জগৎ দেখাবো বলে নিয়ে গিয়েছি ব্রাসেলস শহরে। গ্র্যান্ড প্লাজার সামনে দাঁড় করিয়েছি, দূর দূরপথ তোমাকে হাঁটিয়েছি। হাঁটতে তোমার কষ্ট হতো। তুমি পিছিয়ে পড়লে তিরস্কার করেছি। কেন দ্রুত হাঁটতে পারছে না? তুমি তোপঙ্গু নও বা এমন কিছু বুড়ো হয়ে যাওনি। এই মুশকিল তোমাদের নিয়ে। এখানে সবাই হাঁটে। হাঁটাটা স্বাস্থ্যের জন্য খুব ভালো। আমি তো দশ মাইল কুড়ি মাইল দিব্যি হাঁটি, প্রতিদিনই হাঁটি। তোমাকে বললাম হাঁটা শিখতে। বলেছিলে ঢাকার রমনায় প্রতিদিন হাঁটতে যেতে। তোমার হাঁটার নমুনা দেখে আমার মনে হয় না রমনায় কোনওদিন হেঁটেছে। বেদনাকে কী প্রাণপণে আড়াল করেছো, বুঝিনি তখন যে আড়াল করেছো। আড়াল তুমি করেই চলতে। স্বাস্থ্য ভালো হবে, আমি, তোমার ডাক্তার মেয়ে ভরসা দিচ্ছি, তুমি তাই যে করেই হোক হাঁটছে। পিছিয়ে না পড়ার আপ্রাণ চেষ্টা করেছে। তবুআমার বিরক্তি প্রকাশে কোনও বিরতি ছিল না। না হাঁটলে তোমার ডায়বেটিস ভালো হবে না, বারবার সতর্ক করে দিই। আমার উপদেশ মতো ডায়বেটিস দূর করার চেষ্টাও হয়তো করেছিলে। কিন্তু শেষপর্যন্ত পারোনি, কোনও ট্যাক্সি ডাকা যায় কিনা জিজ্ঞেস করেছে। ছোটদা বলেছে, ওতে প্রচুর টাকা। এরপর তুমি আর ট্যাক্সির কথা বলোনি। তুমি চাও না তোমার জন্য কারও টাকা খরচ হোক। রাস্তায় মানুষ হাঁটছে, সব বয়সের মানুষ, বিদেশের মানুষের বুদ্ধি আছে বলে হাঁটে, তাদের স্বাস্থ্যও তাই ভালো থাকে। এদেশের মানুষ আমাদের দেশিদের মতো গণ্ডমূর্খ নয়, এই জ্ঞান দিতে দিতে তোমাকে হাঁটালাম। গ্র্যান্ড প্লাজা থেকে ধমকে টাউন হলের পাশ দিয়ে কয়েকশ মিটার তোমাকে হাঁটিয়ে মানেনকেন পিস নামের বিখ্যাত ন্যাংটো একটা বাচ্চার পেচ্ছাব করা মূর্তির কাছে আনলাম। ষোলোশা আঠারো সালে মূর্তিটি ওখানে বসানো হয়েছিল, নানারকম গল্প আছে মূর্তি নিয়ে। কিছু গল্প তোমাকে বলি। মানেনকেন পিস দেখে আমি যে খুশি হচ্ছি, তাই দেখে বোধহয় তোমার আনন্দ হচ্ছিল, যদি হওয়া সম্ভব সামান্য আনন্দ আদৌ। ব্রাসেলসের বড় বড় প্রাসাদ দেখে তুমি মুগ্ধ হও, উচ্ছ্বাস প্রকাশ করো, চাইছিলাম। এমন ভাবে সব দেখাচ্ছিলাম যেন শহরটা আমার। দেশটা তোমার, বিদেশটা আমার, যেন এমন। দেশের অভাব, অশিক্ষা, অসুন্দর, অজ্ঞতা সব তোমার। বিদেশের বৈভব, বিত্ত, বিশালতা, বিলাসিতা, বিচিত্রতা, বিজ্ঞতা আমার। তোমাকে রেস্তোরাঁয় নিয়ে গেলাম, যে রেস্তোরাঁর খাবার আমি আর ছোটদা খেতে পারলেও তুমি পারোনি। ওসব কাঁচা বা প্রায় কাঁচা মাছ তুমি খেতে পারো না। ঝিনুক নিলাম। ইচ্ছে করেই। দেখাতে যে যে খাবারগুলোকে অসম্ভব ভাবো-খাওয়া, সেগুলো খাওয়া কত সম্ভব। ছোটদা কিছু ঝিনুক খেল, আমিও কি আর ওসব খুব খেতে পারি! তোমাকে দেখানোর উদ্দেশ্যটাই ছিল আসল। খুব যে উৎসাহী চোখে তুমি খাবার দেখলে, তা নয়। তুমি প্রায় কিছুই খেতে চাইলে না। স্বাদ পেতে পারো, এমন কিছু খাবারও দেখলাম খেলে না। রেস্তোরাঁর বিল বেলজিয়ান ফ্রাঁয়ে দিয়ে টাকায় কত হয়, তাও তোমাকে বলতে ভুলোম না। তোমার মুখ সঙ্গে সঙ্গেই খুব মলিন হয়ে উঠলো। কেন শুনিয়েছিলাম তোমাকে টাকার অংক, আমি খুব ধনী তা বোঝাতে, নাকি বিদেশের রকম সকম বোঝাতে! আমার একবারও মনে হয়নি টাকার অংক শোনারপর তুমি এমনই সতর্ক হয়ে উঠবে যে রেস্তোরাঁয় আর খেতে চাইবে না। তার চেয়ে না খেয়ে থাকবে।